
পত্রিকা ডেস্ক
লণ্ডন, ৩০ মে: চীনের বিরুদ্ধে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ের বিভিন্ন বন্দিশিবিরে উইঘুর জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর গণহত্যা এবং নির্যাতন চালানোর অভিযোগ নতুন নয়। তবে বেইজিং সরকার বরাবর এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। সম্প্রতি নির্যাতনের ঘটনার ওপর হাজার হাজার ছবি ও কিছু সরকারি গোপন নথি ফাঁস হয়েছে। এসব ছবি ও নথি নির্যাতনের অভিযোগের সত্যতাকেই যেন বিশ্ববাসীর সামনে আরেকবার তুলে ধরেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ফেলো ও জার্মান নৃবিজ্ঞানী আদ্রিয়ান জেনজ এসব গোপন সরকারি নথি সংগ্রহ করেছেন। এগুলো এমন একসময় প্রকাশিত হয়, যখন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাসেলেট জিনজিয়াংয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও আলোচিত এক সফর শুরু
করেন। চীন উইঘুর মুসলিমদের ওপর ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ চালাচ্ছে- এ অভিযোগের প্রেক্ষাপটে তাঁর এ সফরকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জিনজিয়াংয়ের সরকারি তথ্যভাণ্ডার হ্যাক করে ফাঁস করা নথিতে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংসহ বেইজিংয়ের শীর্ষ নেতারা উইঘুরদের জোর করে ধরে আনার নির্দেশ দিচ্ছেন।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, চীনা কর্তৃপক্ষ জিনজিয়াং প্রদেশের অনেক বন্দিশিবির ও কারাগারে অন্তত ১০ লাখ উইঘুর এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষজনকে আটকে রেখেছে। তবে এ প্রসঙ্গে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বেইজিংয়ের যুক্তি হলো, তাঁদের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি করতে এসব শিবিরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ‘চরমপন্থা’ মোকাবিলায় এর প্রয়োজন রয়েছে।
কিন্তু পুলিশের তোলা ছবি ও অভ্যন্তরীণ নথিপত্র যেগুলো অজ্ঞাতনামা সূত্র বিশেষজ্ঞ জেনজকে সরবরাহ করেছে, সেগুলোতে এমন প্রমাণই পাওয়া যায়, প্রশিক্ষণ নিতে বন্দিশিবিরের বাসিন্দারা এখানে বিন্দুমাত্র স্বেচ্ছায় আসেননি। জিনজিয়াংয়ের সরকারি তথ্যভাণ্ডার হ্যাক করে ফাঁস করা নথিতে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংসহ বেইজিংয়ের শীর্ষ নেতারা জোর করে তাঁদের ধরে আনার নির্দেশ দিচ্ছেন।
আদ্রিয়ান জেনজ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘(উইঘুর নির্যাতন বিষয়ে) ওই অঞ্চল থেকে ফাঁস হওয়া নথি ও প্রমাণের মধ্যে এখন পর্যন্ত এগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ব্যাপক ও উল্লেখযোগ্য। আমরা ইতিপূর্বে যত প্রমাণ পেয়েছি, সেগুলোর চেয়ে এসব আরও বেশি উল্লেখ করার মতো। কেননা এসব ছবি ও নথিতে নির্যাতনের বহুমাত্রিক প্রমাণ রয়েছে।’
নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে সমালোচনা হলেও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিনজিয়াংয়ের হাতেুগোনা কিছু কর্মকর্তাকে শুধু নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ জেনজ বলছেন, ফাঁস হওয়া নথিপত্রে চীনের প্রেসিডেন্ট ও দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
বন্দিশিবিরের নির্দেশনা
‘ভিকটিমস অব কমিউনিজম মেমোরিয়াল ফাণ্ড’ নামের এক বিশেষ প্রজেক্ট হিসেবে অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে ফাঁস হওয়া নথিপত্র ‘দ্য জিনজিয়াং পুলিশ ফাইলস’। নৃবিজ্ঞানী জেনজও এই প্রজেক্টে কাজ করছেন।
বন্দিশিবিরগুলো কীভাবে পরিচালনা করতে হবে, শিবিরের বাসিন্দাদের ওপর বলপ্রয়োগের ধরন কী হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত, যেমন স্নাইপার রাইফেল ও মেশিনগান নিয়ে একজন প্রহরী কীভাবে ওয়াচটাওয়ার থেকে নজর রাখবেন, তার বিশদ নির্দেশনা রয়েছে এসব নথিপত্রে।
নথিতে চেন কুয়ানগুয়ো নামে জিনজিয়াংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যও রয়েছে। ২০১৭ সালে সরকারের দায়িত্বশীলদের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় ওই বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি।
বক্তব্যে বন্দিশিবির থেকে পালানোর চেষ্টা করা ব্যক্তিদের গুলি করতে নিরাপত্তারক্ষীদের নির্দেশ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে ‘ধর্মবিশ্বাসীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে’ রাখতে জিনজিয়াং অঞ্চলের কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন চেন কুয়ানগুয়ো।
গোপন নথির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে চীনের জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ঝাও কেঝি আরেক অভ্যন্তরীণ আলোচনায় বন্দিশিবির নিয়ে কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যে বন্দিশিবিরের কার্যক্রমের আওতা বাড়াতে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সরাসরি আদেশ দেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।
নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে ফাঁস হয়েছে পাঁচ হাজারের মতো ছবি। শঙ্কা জাগানো এসব ছবি বন্দিশিবিরগুলো থেকে তোলা। সেগুলোর মধ্যে ২ হাজার ৮৮৪টি উইঘুর মুসলিমদের। ছবিগুলো তুলেছিলেন শিবিরে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তারা।
বন্দিশিবিরের বিষয়টি প্রথমে মানতে নারাজ ছিল চীন। তবে পরে ২০১৮ সালে এসে বেইজিং জানায়, শিবিরগুলোতে আদতে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আর উইঘুরসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা সেখানে স্বেচ্ছায় প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন।
তবে চীনা নেতারা এসব সংখ্যালঘুকে যে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবেই দেখেন, তা ফাঁস হওয়া ছবি ও নথিপত্রে উঠে এসেছে। এর একটি প্রমাণ জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ঝাও কেঝির বক্তব্য। ফাঁস হওয়া ওই বক্তব্যে তাঁকে সতর্ক করে বলতে শোনা যায়, দক্ষিণ জিনজিয়াংয়ের ২০ লাখের বেশি বাসিন্দাকে ‘ধর্মীয় চরমপন্থা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।’