মুহাম্মদ তাজ উদ্দিন, সিলেট থেকে
২৫শে সেপ্টেম্বর: স্বাধীনতার একান্নতম বর্ষে অবশেষে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সিলেটের অন্যতম বৃহৎ বধ্যভূমিটি। শত শত নাম না জানা শহীদের রক্তে ভেজা সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হচ্ছে স্মৃতিস্তম্ভ। এখানে স্থান পাবে বৃহত্তর সিলেটের সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নমের তালিকা। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত নানা স্মারক নিয়ে স্থাপন করা হবে একটি যাদুঘর। স্থাপন করা হবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি পাঠাগারও। সংরক্ষণ করা হবে শহীদদের গণকবর।
দেশে-বিদেশে অবস্থানরত সুশীল সমাজের প্রচেষ্টায় এবং?বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে এই দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ। অর্ধশত বছর পরে হলেও সিলেটে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগেকে মাইলফলক, ঐতিহাসিক আর স্বপ্নের বাস্তবায়ন বলে মন্তব্য করেছেন দেশে-বিদেশে বসবাসরত বিশিষ্টজনেরা।
উল্লেখ্য, সিলেট ক্যাডেট কলেজের পার্শববর্তী বড়শালা এলাকার কাকুয়ারপার নামক স্থানে প্রায় ১১ দশমিক ৪৮ শতক ভূমিকে চিহ্নিত করা হয়েছে বধ্যভূমি হিসেবে। এই বধ্যভূমিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুরো ৯ মাসে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এখানে গণকবর দেয় পাক হানাদার বাহিনী। বহু নারীকেও পাশবিক নির্যাতনে হত্যার পর কবর দেয়া হয় এখানে। কৃতি ব্যক্তিত্ব সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল, কর্ণেল জিয়াউর রহমান (সুপার সিলেট মেডিক্যাল কলেজ), ইপিআর সদস্য শহীদ নুরুল হক খানসহ আরো অনেক নাম না জানা কীর্তিমানকে হত্যা করে পাক বাহিনী এখানে কবর দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তৎকালীন সিলেট রেসিডেনসিয়াল স্কুল (বর্তমান সিলেট ক্যাডেট কলেজ)-এ ছিল পাক সেনাবাহিনীর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার হয়ে কত মুক্তিযোদ্ধা আর সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন তাদের কোন সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানও নেই কোথাও। নির্মম নির্যাতনে নিহত এসব মুক্তিযোদ্ধা, নিরীহ নারী ও সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস হয়ে মিশে গেছেন সিলেটের মাটিতে। এদের সবাইকেই পাক হানাদার বাহিনী কবর দিয়েছে বর্তমান ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন কাকুয়ারপারের এই টিলায়।
স্বাধীনতার বহু বছর পরও এই টিলায় পাওয়া যেত মর্টার শেল, হেলমেট, রাইফেল, ম্যাগাজিন ভর্তি গুলি ও মাইন। যত্রতত্র পড়ে থাকতো মানুষের কঙ্কাল ও মাথার খুলি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই টিলা থেকে পরিত্যাক্ত এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করে।
শত শত মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত এই টিলার বধ্যভূমিকে সংরক্ষণের দাবী দীর্ঘদিনের। সর্বশেষ ২০২১ সালে বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে গুরুত্ব সহকারে এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবী উত্থাপন করা হয়। লেখালেখি চলে গণমাধ্যমে। কিন্তু বধ্যভূমির এই এলাকাটি সিলেট ক্যাডেট কলেজের আওতায় হওয়ায় প্রয়োজন পড়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনুমোদনের। বিষয়টি চিঠি লিখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানের নজরে আনেন লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে এক সময়ের মিনিস্টার কনস্যুলারের দায়িত্ব পালনকারী সিলেটের কৃতি সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল মোঃ আব্দুস সালাম বীরপ্রতীক (অবঃ)। আর এই বধ্যভূমি সংরক্ষণ উদ্যোগে তার সাথে ওতোপ্রোতভাবে কাজ করেন যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সিলেটের সুধীসমাজ। কর্ণেল সালাম ও তার সমমনা বিশ্ব সিলেট সম্মেলনের নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অবশেষে গত ২৫ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন টিলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই বধ্যভূমির সংরক্ষণ কাজ।
প্রকল্পটির নামকরণ করা হয়েছে ‘৭১ এর বধ্যভূমি ও স্মৃতি উদ্যান’। ২১ সেপ্টেম্বর এই বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও উদ্যান নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও এরিয়া কমাণ্ডার, সিলেট এরিয়া মেজর জেনারেল হামিদুল হক। প্রকল্পটির নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২১ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছে ১৭ পদাতিক ডিভিশন এবং সিলেট এরিয়া।
প্রকল্পটি অন্যতম উদ্যোক্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল মোঃ আব্দুস সালাম বীরপ্রতীক (অবঃ) এ সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের প্রায় আশি ভাগ অর্থ যোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এরিয়া কমাণ্ডারের মাধ্যমে। বধ্যভূমি ও এর আশপাশের পুরো টিলা এলাকাটিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। প্রকল্পটি সিলেট ক্যাডেট কলেজের অভ্যন্তরে হওয়ায় প্রকল্পটিতে যাতে সাধারণ মানুষও প্রবেশ করতে পারেন সেজন্য সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়ক থেকে একটি পৃথক সড়ক নির্মাণ করে দিচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। কমপ্লেক্সটির অবকাঠামোগত নকশা প্রণয়ন করে দিয়েছেন স্থপতি শাহরিয়ার আহমদ। প্রকল্পের অভ্যন্তরে প্রায় ২ বিঘা জমিতে থাকবে মূল বধ্যভূমি। এর পাশে থাকবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি লাইব্রেরী ও একটি মিউজিয়াম। থাকবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি তথ্য কেন্দ্র। এছাড়াও থাকবে অডিটোরিয়াম, গবেষণা কেন্দ্র, উন্মুক্ত প্রাঙ্গন, পায়ে হাঁটার পথ ও ক্যাফেটারিয়া ইত্যাদি। এখানে শহীদের দেয়ালে লেখা থাকবে সিলেট বিভাগের সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচিত।
কর্ণেল সালাম জানান, বাংলাদেশে এ ধরনের একটি উদ্যোগ এই প্রথম। এ ধরনের একটি প্রকল্পে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আসার জন্য কর্ণেল সালাম ধন্যবাদ জানান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফি উদ্দিন আহমদ ও স্থানীয় এরিয়া কমাণ্ডারের প্রতি, যিনি তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। তিনি জানান, সিলেট বিভাগের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রদানের জন্য ইতোমধ্যে টিম গঠন করা হয়েছে। যারা এই বধ্যভূমিতে সমাহিত হওয়া শহীদদের পাশাপাশি সিলেট বিভাগের সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ করছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল সালাম জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হলে আগামী জানুয়ারী মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করার আশা করছেন তারা। তিনি জানান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মাণ কাজের সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে গত ২১ সেপ্টেম্বর। অনুষ্ঠানে সিলেটে অবস্থানরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রায় সকল শীর্ষ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে হানদারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত এবং এই গণকবরে সমাহিত শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আবদালের পুত্র মেজর জামিল আবদাল, সিলেট কিডনী ফাউণ্ডেশনের পরিচালক ডা. মুশফিক হোসেন, সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের আহমদ চৌধুরী, ফরিদা নাসরিন, নৃত্যশৈলী সংগঠনের বিভাষ শ্যাম পুরকায়স্থ যাদন, নীলাঞ্জনা দাস জুঁই, সাংবাদিক অপূর্ব শর্মা প্রমুখ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সিলেটের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. সামসুদ্দিন আহমদের আত্মজ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়া উদ্দিন বলেন, এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ আমাদেরকে গর্বিত করেছে। ক্ষুদ্র হলেও এ স্মৃতি উদ্যান লাখো শহীদের আত্মাহুতির কথা মনে করিয়ে দেবে। সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এই স্মৃতিসৌধ একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
উল্লেখ্য, শহীদ পরিবারের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে ডা. জিয়া উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারগুলোর দুঃখ-কষ্ট লাঘবে নিবেদিতপ্রাণ। নিজের অনুভূতির প্রকাশ হিশেবে এই প্রকল্পের উদ্বোধন উপলক্ষে তাঁর রচিত একটি আবেগঘন কবিতাও শহীদদের স্মৃতিফলকে স্থান পাবে।
সিলেটের এই বধ্যভূমিকে সংরক্ষণের উদ্যোগকে ঐতিহাসিক আখ্যায়িত করেছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক, টাওয়ার হ্যামলেটস-এর সাবেক মিডিয়া অফিসার নজরুল ইসলাম বাসন। তিনি বলেন, তৎকালীন সিলেট রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের পাক হানাদারদের নির্যাতন কেন্দ্র সংলগ্ন ১৯৭১-এর শহীদদের এই গণকবর দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ছিল প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে এই গণকবর ও বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উত্থাপন করা হয়। কিন্তু স্মৃতি সৌধ নির্মাণের জন্য সেনা সদরে অনুমতি প্রয়োজন। এই অনুমতি লাভের জন্য কর্ণেল সালাম বীর প্রতীক (অব:) সেনা প্রধান বরাবরে আবেদন করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু এই প্রকল্পে অনুমোদনই দেয়নি, সিলেটের এরিয়া মেজর জেনারেল হামিদুল হক ও তাঁর সহকর্মীরা নিজেরাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছেন। তিনি আরো জানান, সেনাবাহিনীর অর্থায়নে প্রকল্পটিতে প্রবাসী সিলেটীরাও অনুদান প্রদানে সংকল্পবদ্ধ আছেন।
ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন এই গণকবরেই নাম না জানা আরো অনেক শহীদের সাথে শায়িত আছেন যুক্তরাজ্য যুব লীগের যুগ্ম সম্পাদক জামাল আহমদ খানের পিতা তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স (ইপিআর)-এর নায়েক শহীদ নুরুল হক খান। দীর্ঘ ৪৮ বছর জামাল আহমেদ খান বা তার পরিবারের কেউ জানতেন না এই গণকবরেই তার পিতাকে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তার পিতার সমাধিটি খুঁজে পেয়েছিলেন তারা। জামাল আহমদ খান ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন এই গণকবরটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়ায় সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমরা মত আরো অনেকের স্বজন-প্রিয়জনের শেষ ঠিকানা হয়েছে এই গণকবরে। আমার পিতাসহ এখানে সমাহিত শহীদদের শেষ ঠিকানাটিকে একটি স্মৃতিসৌধে রূপ দেয়ার উদ্যোগকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সাধুবাদ জানাই।
একাত্তরের এই বধ্যভূমিতে শহীদ সমাধি সৌধ নির্মাণে এগিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রাশেদা কে. চৌধুরী বলেছেন, এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন। বেসরকারী হাসপাতাল এসোসিয়েশন, সিলেট-এর সভাপতি ডা. নাসিম আহমদ এই বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতি সৌধ নির্মাণের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ। এর মাধ্যমে শহীদদের অবদানের প্রতি সিলেটবাসী কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ পেয়েছেন।