সময়টা যখন বৈরি
সাগর রহমান
ইদানীং রাস্তায় বেরুলেই মনে হয় যেন কোন বড়সড় ফ্রিজের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। এখানকার প্রায় সব ঘরেই যেহেতু সেন্ট্রাল হিটার ব্যবহারের সুবিধা যুক্ত আছে, লাগামছাড়া বিদুৎ বিলের চোখরাঙানো উপেক্ষা করে ঘন্টার পর ঘন্টা সেটিকে অন করে রাখলেই কেবলমাত্র শীতের এই সময়টাতে আরাম পাওয়া যায় খানিকটা। আপাতত এ গোলার্ধের প্রাকৃতিক হিটারের সুইচ বন্ধ, সকাল সন্ধ্যা হু হু করে থার্মোমিটারের পারদ নেমে যাচ্ছে শূণ্য ডিগ্রিতে। আগামী সপ্তাহে কোথাও কোথাও সেটি জিরোর বেশ খানিকটা নিচে নেমে যাবার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে আবহাওয়া অফিস থেকে। তুষার ঝরার কথা আছে আসছে সপ্তাহান্তেই। রাতভর ঝরে থাকা শিশিরকণা সব জমে বরফ কণা হয়ে জমে থাকে। আমাদের এখন সকাল না হতেই দুপুর হয়, দুপুরকে আলাদা করে চিনে নেবার আগেই আকাশ অন্ধকার করে রাত নেমে যায়। না আছে সাঁঝ হবার বালাই, না বিকেল হবার। বেশিরভাগ দিনই আকাশ মেঘলা, গোমড়া মুখ, হয় বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরিঝিরি, কিংবা বৃষ্টি হবার আশংকায় কাঁপছে চারপাশ। কম্পনটা ঠাণ্ডার কামড়ের। কনকনে শীতের সাথে কালচে-ধূসর আকাশের ব্যাকগ্রাউ- হতে সময়-অসময়ে নেমে পড়া বৃষ্টি – কী যে বিচ্ছিরি যোগাযোগ, ঐ দৃশ্যপটে না থাকলে বিরক্তিটা বোঝানো সম্ভব হবে না। মানুষজন যেন একেকজন জম্বি। গা মাথা ঢেকে, দুইহাত পকেটে ঢুকিয়ে, বেশ খানিকটা কুঁজো হয়ে পারলে অনেকটা দৌড়ের ভঙ্গিতে চলাফেরা করছে। না আছে চলতি পথে অপরিচিতের সাথে চোখাচোখি হয়ে পড়ার মৃদু হাসি, না আছে প্রাণ চাঞ্চল্য। পুরো বিশ্বের সাথে সাথে যুক্তরাজ্য এ মুহুর্তে অর্থনৈতিক বিচারে খুব কঠিন সময় পার করছে। পত্রিকার পাতা কিংবা টিভির নব ঘোরালে বিশ্বকাপ ফুটবলের খবর পাওয়া যাক, আর না যাক, ঐ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সংবাদটি অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির পাগলা ঘোড়ার পায়ে বেড়ি পরানোর কথা ভাবাও যাচ্ছে না।
ক্রিসমাসের মাস, অথচ দোকানপাটে সেরকম উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না বলে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বেশিরভাগ পরিবারের জন্যই যেখানে দুধ এবং ডিমের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, সেখানে ক্রিসমাসের শপিংয়ে গরহাজির হবার ব্যাপারটা খুব অপ্রত্যাশিতও নয়। এর সংগে শুরু হয়েছে ধর্মঘটের তোড়জোড়। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং পেশাজীবিরা তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ‘স্ট্রাইক’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্রিসমাসের এই সময়টাতে স্বভাবতই লোকজনের আনাগোনা বাড়ে। প্রচুর মানুষ পরিবার পরিজনের সাথে ক্রিসমাসের আনন্দ উপভোগ করতে কিংবা ছুটি কাটাতে নানান দিকে ভ্রমণ করেন। কিন্তু আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকটি দিন রেল বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে আরএমটি (দ্য নেশনাল ইউনিয়ন অব রেইল, মেরিটাইম এ- ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার)।
সরকারের সাথে দফায় দফায় আলোচনার টেবিলে বসেও কোন সুরাহায় পৌঁছাতে পারেনি দুই পক্ষ। রেল ও টিএফএল কর্মীদের সাথে সরকারের এই ঝামেলাটা বহুদিন ধরেই ভোগাচ্ছে লণ্ডনকে। গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকবারই কার্যত অচল করে দেওয়া হয়েছে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। টিএফএলের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য মতে, প্রতিদিন প্রায় ৫ মিলিয়ন বার (পঞ্চাশ লক্ষ!) যাতায়াত ঘটে লণ্ডনের টিউবে। এ হিসেব কেবল আণ্ডারগ্রাউণ্ড (টিউব) ট্রেনগুলোর। তার সাথে যদি যোগ করা হয় এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটে চলা ট্রেনের হিসেব, তবে সংখ্যাটি নিশ্চয় আরো অবিশ্বাস্য ঠেকবে। এহেন ব্যস্ত একটি ব্যবস্থা যদি হঠাৎ করে তাদের স্টেশান বন্ধ করে দেয়, তবে লণ্ডনের রাস্তায় যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তা বলে বোঝানো যাবে না। এসব দিনে চাপ কমানোর জন্য বেশ কিছু অতিরিক্তি বাস নামানো হয় রাস্তায়। কিন্তু, তাতে ক্ষতি-বৃদ্ধি যে খুব একটা হয় না, তাতো বলাই বাহুল্য। বিশেষত সকালের অফিসে যাবার, এবং বিকেলে বাড়ি ফেরার সময়টাতে রাস্তায় রাস্তায় লোকজনের যে ভোগান্তি, তার কোন তুলনা হয় না। ফলে আরএমটি কর্তৃপক্ষের স্ট্রাইকের সিদ্ধান্তে লণ্ডনবাসী স্বভাবতই আতংকিত হয়ে পড়ে। ক্রিসমাসের এই উৎসবমুখর সময়টাতে সেই আতংকের মাত্রাটা দ্বিগুন হয়ে উঠেছে। এদিকে হাসপাতালের নার্সরাও নিজেদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন নিয়ে মাঠে নামছে। আগামী পনের ডিসেম্বর ও বিশ ডিসেম্বর – এই দুইদিন স্ট্রাইক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরসিএন (রয়্যাল কলেজ অব নাসিং)।
একই সময়ে আন্দোলনে নামছেন ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা। আন্দোলনে নামছেন পোস্ট অফিসের পোস্টম্যানরা। বাস ড্রাইভাররাও কর্মবন্ধের ডাক দিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে এগারো শতাংশ বেতন বৃদ্ধির আশ্বাসে নিবৃত্ত করা গেছে। আগামী বাইশ ডিসেম্বর কাজ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলসের এম্বুলেন্স ও এনএইচএস-এর অন্যান্য কর্মীরা। সদা ব্যস্ত হিথ্রো, গেইউইক, ম্যানচেস্টার, গ্লাসগো, কার্ডিফ এবং বার্মিংহামের এয়ারপোর্টগুলো স্বভাবতই বছরের এই সময়টাতে ব্যস্ততর হয়ে ওঠে। আর্ন্তজার্তিক ও আভ্যন্তরীন – সব ধরনের যাতায়াতই বেড়ে যায় এই ছুটির সময়টাতে। আর বছরের এই বিশেষ সময়টাকে বেছে নিয়ে স্ট্রাইকের ঘোষণা দিয়েছেন বর্ডার ফোর্সের কর্মীরা। তাদের স্ট্রাইকের ফলে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, তা রীতিমত বিপর্যয়কর (দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নেও) বলে আখ্যা দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। সরকার এই অনাকাঙ্খিত স্ট্রাইক সামাল দিতে ছয়শ সৈন্যকে ট্রেনিং দিচ্ছেন, এবং কর্মীদের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা চালিয়ে চাচ্ছেন একটি কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে। তালিকা এখানেই শেষ নয়। স্ট্রাইক করার ঘোষণা এসেছে হাইওয়ে ওয়ার্কাসদের কাছ থেকে। স্কটল্যাণ্ডের টিচার্সরা গত চব্বিশ নভেম্বর ‘ওয়াকড আউট’ করেছিলেন বেতন বৃদ্ধির দাবীতে। তাদের দশ পার্সেন্ট বেতন বৃদ্ধির বিপরীতে সরকারের প্রস্তাবিত ছয় দশমিক আট পার্সেন্টকে অপ্রতুল মনে করে সেটি প্রত্যাখ্যান করেছেন ইউনিয়ন। ফলে সামনে আরো স্ট্রাইকের ষোষণা আসছে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সমস্ত যুক্তরাজ্যে একশত পঞ্চাশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফরা গত নভেম্বরের তিনদিনের জন্য স্ট্রাইক করেছিলেন। তাদের সমস্যাটি এখনও মেটেনি। এয়ারপোর্ট লাগেজ-হ্যাণ্ডেলিংয়ের দায়িত্বে থাকা স্টাফরা আগামী ষোলো ডিসেম্বর বাহাত্তর ঘন্টার জন্য স্ট্রাইকের ডাক দিয়েছে। তেরো ডিসেম্বর থেকে ষোলো জানুয়ারি পর্যন্ত কোনোরকম ড্রাইভিং টেস্ট নিবেন না বলে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন যুক্তরাজ্যে ড্রাইভিং পরীক্ষকরা। তালিকায় যুক্ত হচ্ছে আরো নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। দাবী সেই একটাই: বেতন ও ভাতা বৃদ্ধি। ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস হিসেব কষে দেখিয়েছে, গত সেপ্টেম্বরে যেসব স্ট্রাইক সংঘটিত হয়েছিল, তাতে অন্তত দুইশত পঞ্চাশ হাজার কর্মদিবসের কর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সব মিলিয়ে সাধারণ জনগণের ভোগান্তি এ মূহূর্তে চরমে। ‘বাজারে আগুন’ শব্দ দিয়েও এখন আর বাজারদরের লাগামহীন উর্ধ্বগতিকে বোঝানো সম্ভব নয়। এই যখন প্রেক্ষাপট, যখন প্রকৃতির বৈরিকাল তাল মিলিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দাকালের সাথে, তখন দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ – ফুটবল বিশ্বকাপ এবং বছর ভরে অপেক্ষায় থাকা বড়দিনও খুব একটা আনন্দ-উত্তেজনা জাগাতে পারছে না জনগণের মনে। চারদিক কেমন ভেজা ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে, কনকনে। কেমন মারমুখি, শোকগ্রস্ত, উদ্বিগ্ন। এ পর্যন্ত লিখে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম, রোদ উঠছে। দূর আকাশে লালের আমেজ। উজ্জ্বল নীলের চারদিক। কোথাও এক কণা মেঘের ছিঁটেফোঁটাও নেই। কম্পিউটারের আবহাওয়ার এ্যপটি যতই মনে করিয়ে দিক এখন তাপমাত্রা মাইনাস ওয়ান, বাইরে রোদ ওঠার আয়োজনের দিকে তাকিয়ে তা মনে রাখার কোনো কারণ নেই। বাড়ির সামনের রাস্তায় আচমকা হৈ-হট্টগোল। তাকিয়ে দেখি, স্কুলের বাচ্চারা বেরিয়ে পড়েছে। কানটুপি, হাতমোজা, ভারী জ্যাকেট নিয়ে শীত মোকাবেলায় প্রস্তুত। এবং মুখের হা হতে শীতের ধোঁয়া বের করতে করতে জীবনের আনন্দে, তুচ্ছ খুঁনসুটিতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে পরস্পরের সাথে। তাদের হাসির শব্দে নির্জন রাস্তাটি কেমন চনমনে হয়ে উঠল হঠাৎ। দেখলাম, ঘাসের ডগায় যেসব শিশির লেগে ছিল, যারা রাতের কনকনে ঠাণ্ডায় জমে ছোট ছোট বরফকুঁচি হয়ে রয়েছে, এখন রোদের ঝিলিকে তারা সব হীরকখণ্ডের মতো ঝলসে উঠছে। আমি মনে মনে লুইস আর্মস্ট্রংয়ের গান গাইতে শুরু করলাম, I see skies of blue/ and clouds of white/ The bright blessed day,/the dark sacred night./And I think to myself/ What a wonderful world!
লণ্ডন। ৯ ডিসেম্বর, ২০২২।
লেখক: কথাসাহিত্যিক