সিলেটে করিম উল্লাহ মার্কেটে যুক্তরাজ্য প্রবাসীর ৭০ লাখ টাকা মূল্যের দোকান জবরদখল
পত্রিকা প্রতিবেদন
লণ্ডন, ০৯ জানুয়ারী: সিলেট নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় অবস্থিত করিম উল্লাহ মার্কেটে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া দোকানকোঠা মার্কেটের মালিকপক্ষ জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৬ জানুয়ারী লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিযোগ করেছেন বন্দোবস্তীয় (লীজ) সূত্রে দোকানটির মালিক আমিরুল ইসলাম নজমুল। লণ্ডনের স্থায়ী বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম নজমুলের মূল বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের গোপশহর গ্রামে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আমিরুল ইসলাম নজমুল জানান, ২০০১ সালে যখন করিমউল্লাহ মার্কেটের নির্মাণ কাজ শুরু হয় তখন তিনি মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ১০৪ স্কয়ার ফিটের একটি দোকানকোঠা কেনার জন্য মার্কেটের মালিকপক্ষ (জমিদার)-এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হন এবং ২০০৩ সালে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে মূল চুক্তিপত্র সম্পাদন করে তাকে দোকান বুঝিয়ে দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণকালীন তিন বছরে তিনি দোকানকোঠার মূল্য বাবদ কিস্তিতে ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। বর্তমানে এই দোকানকোঠার বাজারমুল্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা। দোকান মালিক আমিরুল ইসলাম নজমুল বলেন, দোকানকোঠা স্থায়ী বন্দোবস্ত নেয়ার পর পর আমি যথারীতি জমিরদাবী ভাড়া পরিশোধ করে আসছিলাম। আর আমি অন্য পক্ষকে অস্থায়ী ভাড়া দিয়ে মাসিক ভাড়া আদায় করে দোকানটি স্বত্ব উপস্বত্ব ভোগ করে আসছিলাম। ২০২০ সালে এসে আমি টের পাই আমার ভাড়াটিয়া দোকানটি দখলের উদ্দেশ্যে মার্কেটের ম্যানেজারের যোগসাজসে মার্কেট মালিক (জমিদার) একটি জাল দলিল করে নিয়েছেন। এটি জানতে পেরে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আমি ঐ অস্থায়ী ভাড়াটিয়াকে দোকান থেকে বের করে দেই এবং ১ অক্টোবর ২০২০ থেকে অন্য এক ব্যবসায়ীকে নতুন ভাড়াটিয়া হিসেবে দোকান বরাদ্দ করি। আমি তখন বাংলাদেশে ছিলাম। নতুন ভাড়াটিয়া দোকানটিতে ব্যবসা শুরুর মাত্র ৫দিনের মাথায় ৫ অক্টোবর আমি খবর পাই যে, আমার নিযুক্ত ভাড়াটিয়াকে বের করে দিয়ে মার্কেটের একাংশের মালিক ছানাউল্লাহ ফাহিম দোকানকোঠায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এরপর আমি ৬ অক্টোবর দুপুরে মার্কেটের অফিসে গিয়ে ছানাউল্লাহ ফাহিমের সাথে দেখা করে দোকান তালা দেয়ার কারণ জানতে চাই। তখন তিনি বলেন, ‘আপনি জমিদারী ভাড়া পরিশোধ করেন নাই। অর্থাৎ আপনি ডিফ?ার বা ভাড়াখেলাপী। আপনি নিয়মিত জমিদারীর চাঁদা পরিশোধ করেন নাই। তখন আমি নিয়মিত জমিদারির চাঁদা পরিশোধের রশিদ প্রদর্শন করি। এসময় মার্কেট মালিক ছানাউল্লাহ ফাহিম উত্তেজিত হয়ে বলেন যে, আপনি বেশি কথা বলেন। এখান থেকে চলে যান, নতুবা দোকান ভেঙ্গে ফেলবো, প্রবাসীরা দেশে আসেন কুকীর্তি করার জন্য। তখন সেখানে তাঁর আরো কিছু সহযোগী ছিলেন। সকলেই আমাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। আমি প্রাণ ভয়ে সেখান থেকে চলে আসি। ওইদিন সন্ধ্যায় আমার লণ্ডনের ফ্লাইট ছিলো তাই আমি লণ্ডন ফিরে আসি।
আমিরুল ইসলাম নজমুল বলেন, লণ্ডনে আসার পর আমি প্রথমে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যাই এবং দোকানকোঠা দখলমুক্ত করতে সহযোগিতা চেয়ে লণ্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাঈদা মোনা তাসনিমের কাছে লিখিত আবেদন দাখিল করি। হাইকমিশনার আমার অভিযোগ পেয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, প্রবাসী সেল, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার, কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রেরণ করেন। বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সেলর দেওয়ান মাহমুদুল হক আমার অভিযোগটি তদারকি করেন। কিন্তু এতে কোনো কাজ হয়নি। নজমুল বলেন, ৭ মাস পর ২০২১ সালের ২১ মে আমি বাংলাদেশে যাই। সিলেট যাওয়ার তিনদিন পর ২৪ মে করিমউল্লাহ মার্কেটের একাংশের মালিক ছানাউরৗাহ ফাহিমের সঙ্গে বৈঠকে বসি। তখন আমার সঙ্গে সিলেট বারের একজন আইনজীবী এবং সিলেট মহানগর যুবগলীগের ছাত্রলীগের সভাপতি রাহাত তরফদারসহ ক’জন ছিলেন। উক্ত বৈঠকে আলোচনার পর ছানাউল্লাহ ফাহিম বলেন মার্কেটের অর্ধেকের মালিক তাঁর চাচাতো ভাই আতাউল্লাহ সাকের আজকের বৈঠকে আসতে পারেননি। তিনি ছাড়া সমাধান হবে না। তাই এক সপ্তাহ পরে আরো একটি বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করেন। কিন্তু নির্ধারিত তারিখে তারা বৈঠকে না বসে বারবার সময় ক্ষেপন করতে থাকেন। অনেক চেষ্টার পর একমাস পর বৈঠকে বসতে সমর্থ হই। দ্বিতীয় দফা বৈঠকে গিয়ে দেখি মার্কেট মালিক আতাউল্লাহ সাকের সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলার আজাদুর রহমান আজাদকে নিয়ে এসেছেন। ঐ বৈঠকে কিছুক্ষণ আলোচনার পর আজাদুর রহমান আজাদ বললেন, তিনি আগামী তিন দিনের মধ্যে বিষয়টি সমাধান করে দেবেন। তিনি তার সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু এরপর বার বার তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কাউন্সিলর আজাদ আমার ফোন রিসিভ করেননি। কখনো ফোন ধরলেও বলতেন ওমুককে পাওয়া যাচ্ছে না, তমুক পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি এভাবেই সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। নজমুল বলেন, আমি তখন সিলেট চেম্বার অব কমার্সের তৎকালীন সভাপতি এটিএম সুয়েবসহ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা চাই। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর কাছেও যাই। তাঁর কাছে সহযোগিতা চাই। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এরপর আমি নিরুপায় হয়ে লণ্ডন ফিরে আসি।
আমিরুল ইসলাম নজমুল বলেন, এরপর ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আবার দেশে যাই। অনেক চেষ্টার পর যুবলীগ নেতা রাহাত তরফদারের সহযোগিতায় আজাদুর রহমান আজাদের সাথে দেখা করি। তিনি আগের মতোই সমাধানের আশ্বাস দিয়ে বারবার সময় ক্ষেপন করতে থাকেন। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। এরপর আবার চলে আসি। গত ২ অক্টোবর ২০২২ ইং তারিখে আমি আবার দেশে যাই। যাওয়ার এক মাস পর যুবলীগ নেতা সাকিবের সহযোগিতায় আজাদুর রহমান আজাদের সঙ্গে দেখা করার আশ্বাস পাই। আমাকে রাত ১১টায় আজাদুর রহমান আজাদের টিলাগড়ের বাসায় যাওয়ার জন্য বলা হয়। রাত ১১টায় সেখানে গেলেও তাঁর সাথে দেখা করার জন্য তিন ঘণ্টা সময় টিলাগড়ের অপেক্ষা করতে হয়। অবশেষে রাত ২টায় তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার সুযোগ হয়। সেখানে আজাদুর রহমান আজাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের দুই জন নেতা ছিলেন। আমার সঙ্গে আমার এলাকার দুই জন লোক ছিলেন। তাদেরকে রুমের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তখন আজাদুর রহমান আজাদ আমাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ”মার্কেট কর্তৃপক্ষ আপনাকে দোকানের মালিকানা দেবে না। আপনি চাইলে আমি তাদের কাছ থেকে কিছু টাকা আদায় করে দিতে পারি। তখন আমি বলি আমার টাকার প্রয়োজন নেই। আমি আমার দোকানকোঠা চাই। তখন উপস্থিত যুবলীগের নেতারাও আমাকে আজাদুর রহমান আজাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দেন। তারা বলেন, আপনি মেনে নিলে কিছু টাকা পেতেন। না মানলে তাও হারাবেন। আজাদুর রহমান আজাদ বলেন, আপনি কাউকে বাদ রাখেননি। সকলের কাছে বিচারপ্রার্থী হয়েছেন। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর কাছেও গিয়েছেন। এখন শুধু প্রধানমন্ত্রী বাকি আছেন। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউই এই সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদের এরূপ মন্তব্যের পর আমি হতাশ হয়ে সেখান থেকে ফিরে আসি। এরপর আমাকে সিলেট-ছাড়া করতে মার্কেটের মালিকপক্ষ আমার পেছনে সিলেট শহরের একটি চি?িত সন্ত্রাসী চক্রকে লেলিয়ে দেন। এই সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় মার্কেট কর্তৃপক্ষ আরো প্রবাসীদের দোকানকোটা দখল করে রাখার অভিযোগ রয়েছে। তাদের দাপটে ভাড়াটিয়া ও ব্যবসায়ীরা সবসময় তটস্থ থাকেন। আমাকে অপরিচিত লোক দ্বারা টেলিফোনে হুমকি ধামকি দেয়া হয়। এছাড়া আমার অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকারি কোন ব্যক্তি তদন্তে গেলে তাদেরকে ছোটবড় খাম ধরিয়ে বিদায় দেয়ারও তথ্য পাওয়া গেছে। আমিরুল ইসলাম নজমুল বলেন, দোকানকোঠা নিয়ে চলমান সংকট নিরসনে আমি গত দুই বছরে তিনবার বাংলাদেশে গিয়েছি। তিন বারে বিমান টিকিট, যাতায়াত, থাকা-খাওয়া ও করোনার সময় কোয়ারিন্টিন করা বাবদ প্রায় ২১ লাখ টাকা খরচ করেছি । তাছাড়া, ২০২১ সালের মে মাস থেকে অদ্যাবধি আমি আমার দোকানের কোনো ভাড়া পাচ্ছি না। ভাড়া বাবদ মাসে ২০ হাজার টাকা করে ২০ মাসে ৪ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। দেশে যাতায়াত ও দোকানের ভাড়া বাবদ সর্বসাকুল্যে ইতোমধ্যে আমার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ টাকা । ব্রিটিশ নাগরিক আমিরুল ইসলাম নজমুল করিম উল্লাহ মার্কেটে তার দোকানকোঠাটি ফিরে পেতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উর্ধ্বতন মহলের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও করিম উল্লাহ মার্কেটের অন্যতম স্বত্বাধিকারী আতাউল্লাহ সাকের টেলিফোন রিসিভ করেননি। তবে, তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, লণ্ডনে আমিরুল ইসলাম নজমুলের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি তিনি অবগত হয়েছেন। দুয়েক দিনের মধ্যেই তিনি সিলেটে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে তার অবস্থান তুলে ধরবেন। আমিরুল ইসলাম নজমুলের অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য নেয়ার জন্য সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কয়েক জন নেতার মাধ্যমে বিষয়টি আপোষে নি?ত্তির প্রস্তাব নিয়ে আমিরুল ইসলাম নজমুল তার কাছে এসেছিলেন। তাদের অনুরোধে তিনি উভয়পক্ষকে নিয়ে সালিশে বসেন। কিন্তু উভয়পক্ষ নিজ অবস্থানে অনড় থাকায় দোকানের বিষয়ে কোন আপোষ রফায় উপনীত হওয়া যায়নি।