পত্রিকা ডেস্ক লন্ডন, ০৯ জানুয়ারি: উন্নত দেশের মূল্যস্ফীতির হার যেন প্রতি মাসেই রেকর্ড গড়ছে। গত বছরের অধিকাংশ সময় এমনটাই হয়েছে। বছরের শেষ মাসেও সেই ধারা অব্যাহত আছে। ব্রিটিশ রিটেইল কনসোর্টিয়াম (বিআরসি) ও ডেটা প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান নিয়েলসেনের তথ্যানুসারে, গত ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার রেকর্ড ১৩ দশমিক ৩ শতাংশে উঠেছে। আগের মাস নভেম্বরে যা ছিল ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। বিআরসির ভাষ্য, ২০০৫ সাল থেকে রেকর্ড সংরক্ষণ শুরু হওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি। প্রাণী খাদ্য, সার ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার এতটা বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিআরসি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, বিআরসি বলছে, ২০২৩ সালেও খাদ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা বজায় থাকতে পারে। গত বছরের বড়দিন যুক্তরাজ্যের পরিবারগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল বলে মন্তব্য করেছেন বিআরসির প্রধান অর্থনীতিবিদ হেলেন ডিকিনসন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির ধারা এখনই গতি হারাবে-এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালও খারাপ যাবে বলে মনে করেন ডিকিনসন। খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের মানুষ পাতের খাবার কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, সে দেশে সেভ দ্য চিলড্রেনের মতো এনজিওকে তৎপর হতে হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মীরা জানাচ্ছেন, যুক্তরাজ্যের পরিবারগুলো ফল ও শাকসবজি কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। এমনকি শিশুদের জন্য গরম কাপড় কিনতেও কষ্ট হচ্ছে তাদের। এক সাহায্যগ্রহীতা পরিবারের কথা বলেছেন তাঁরা, যে পরিবার সম্প্রতি সোশ্যাল হাউজিং বা সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্থান পেয়েছে, কিন্তু তারা বাড়ির নিচতলায় কার্পেট বিছাতে পারেনি। শীতের দেশে ঘরের মেঝেতে কার্পেট না থাকা কতটা কষ্টকর, তা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের বয়স এক বছর হতে চলল। যুদ্ধ কমে থামবে, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে বিশ্বের খাদ্যসংকট। জাতিসংঘ ও তার সহযোগী সংস্থাগুলোও উদ্বেগ জানাচ্ছে। গত ডিসেম্বর মাসে তারা উদ্বেগ জানিয়েছে, ২০২৩ সালে মানবিক সাহায্য বাবদ অন্তত ৫ হাজার ১৫০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে, যা ২০২২ সালের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে ৬৯টি দেশে আনুমানিক ৩৩ কোটি ৯০ জন মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে, ২০২২ সালের তুলনায় যা ৬ কোটি ৫০ লাখ বেশি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। যুদ্ধের কারণে গত বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে খাদ্য পরিবহন ব্যাহত হয়। ফলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মূল্যসূচক রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। এরপর জাতিসংঘের মহাসচিবের উপস্থিতিতে কৃষ্ণসাগর দিয়ে খাদ্যশস্য পরিবহনে রাশিয়া ও ইউক্রেনের চুক্তি হয়। উভয় পক্ষই সম্মত হয়, শস্যবাহী জাহাজে রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউ হামলা করবে না। এই অঙ্গীকারের বরখেলাপ যে একেবারে হয়নি, তা নয়। তবে সমুদ্রপথে খাদ্যশস্য রপ্তানি একেবারে বন্ধ হয়নি কখনো। চুক্তির ধারা অনুযায়ী, এর সময়সীমা ছিল গত বছরের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত। তবে ১৭ নভেম্বরের পর তা আরও ১২০ দিন বাড়ানো হয়েছে। ফলে কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী বন্দরগুলো থেকে শস্যদানা, খাদ্যসামগ্রী ও সার রপ্তানি চলমান আছে।
৩৩ ভাগ দেশে মন্দার আশঙ্কা
এদিকে নতুন বছরে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলছে, ২০২৩ সালে মন্দার কবলে পড়বে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশ, যার প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে। এমনকি যারা সরাসরি মন্দার কবলে পড়বে না, তাদের গায়েও আঁচ লাগবে।
আইএমএফ বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুদহার বেড়ে যাওয়া ও চীনে নতুন করে করোনাভাইরাসের বিস্তার-এসব কারণে বিশ্ব অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছে। এতে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশের অর্থনীতি চলতি বছর মন্দার কবলে পড়তে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি সিবিএস নিউজের এক অনুষ্ঠানে আইএমএফের প্রধান এ আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন। এর আগে গত অক্টোবরে প্রকাশিত আইএমএফের অর্থনৈতিক আউটলুকে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমানো হয়েছে। দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো গড়ে মোট খরচের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ খাদ্যের পেছনে খরচ করে। গ্রামীণ প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিশ্বের সবখানেই বিষয়টি কমবেশি এ রকম। অর্থাৎ প্রান্তিক মানুষের খাদ্য ব্যয় বেশি। সে কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিম্ন আয়ের মানুষ। তার মধ্যে আবার সবচেয়ে প্রভাব পড়বে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের ওপর। ভবিষ্যতে শিশুদের কর্মক্ষমতা কমে যাবে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা থাকবে। মূল্যস্ফীতিও থাকবে বাড়তি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, তীব্র খাদ্যসংকট কাটিয়ে উঠতে বিশ্বের অন্তত ৫৩টি দেশের ২২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন হবে। ফলে বিশ্বের অনেক মানুষের রাতের বেলা ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘুমাতে যাবে। তাদের করোটিতে শিস কেটে যাবে ক্ষুধার বাতাস।