শাবনা বেগমের গ্রন্থ বাঙালি অভিবাসী জীবন-সংগ্রামের অনবদ্য দলিল
পত্রিকা প্রতিবেদন
লণ্ডন, ২৮ মার্চ: বাঙালি-ব্রিটিশ লেখক শাবনা বেগম রচিত ‘ফ্রম সিলেট টু স্পিটালফি?স’ গ্রন্থখানা বাঙালি অভিবাসী-জীবনের সংগ্রামের অনবদ্য ইতিহাস। বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচকবৃন্দ এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
গত ১৪ মার্চ বিশপসগেইট ইনস্টিটিউটের গ্র্যাণ্ড লাইব্রেরী হলে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন সত্তর দশকের ‘স্কোয়াটার’ ও আবাসন আন্দোলনের অন্যতম প্রবীণ ব্যক্তিত্ব, লেখক ও গবেষক তাজ আলী। আরো ছিলেন আবাসন আন্দোলনের অন্যতম নেতা মো. গোলাম এহিয়া খসরু, গো?স্মিথ কলেজের এডুকেশন স্টাডিজের লেকচারার, বাঙালির অভিবাসন সংগ্রাম এবং আত্মপরিচয় নিয়ে গবেষণা করা ব্যক্তিত্ব আমিনুল হক।
গ্রন্থের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান লোরেন্স উইশার্ট-এর জুমানা ইউনিসের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে বাঙালি ও মূলধারাসহ ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের গবেষক, লেখক ও অনুসন্ধানী পাঠকের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। দুই পর্বে অনুষ্ঠিত প্রকাশনানুষ্ঠানে প্রথমপর্বে গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা, পরে ছিল প্রশ্নোত্তরপর্ব।
উপস্থিত দর্শক ও শ্রোতাদের প্রশ্নোত্তরপর্ব ও আলোচনাপর্বে লেখক শাবনা বেগম বিলেতে সত্তর দশকের বাঙালি কমিউনিটির টিকে থাকার লড়াইয়ের পাশাপাশি তার গবেষণায় উঠে আসা অভিবাসী সংগ্রামের নানা তথ্য ও লোমহর্ষক ঘটনাবলির বর্ণনা দেন।
উল্লেখ্য, শাবনা বেগম সম্প্রতি লণ্ডনের কুইনমেরী ইউনির্ভাসিটি থেকে সত্তর দশকে আবাসন সংকটে-পড়া বাঙালি স্কোয়াটার ও স্কোয়াটিং করে ঘরের তালা ভেঙে ঘর দখল করার সংগ্রাম ও আন্দোলন নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তার এই গবেষণাকাজ নিয়ে ‘ফ্রম সিলেট টু স্পিটালফি?স’ গ্রন্থখানা প্রকাশ করেছে বিলাতের বিখ্যাত পাবলিশার্স ‘লোরেন্স উইশার্ট’।
অনুষ্ঠানে প্রবীণ ব্যক্তিত্ব লেখক ও গবেষক তাজ আলী সত্তর দশকে সংঘটিত বর্ণবাদ ও আবাসন সংকট সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, তখন বাঙালিরা ছিল ব্রিটেনে ভাসমান একটি অভিবাসীপ্রত্যাশী সম্প্রদায়। মানবেতর জীবনযাপনকরা এই বাঙালিদের খালিঘর থাকা সত্তে¡ও কোনো ঘর দেওয়া হতো না। এটা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ। এছাড়া রাস্তাঘাটে চলাচল ছিল দুঃসাধ্য। বর্ণবাদী ন্যাশনাল ফ্রন্ট যেখানে-সেখানে আমাদের লোকদের মারধর করতো, এমনকি অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। এরকম একটি বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হয়ে আলতাব আলী নামক গার্মেন্টসকর্মী পূর্ব লণ্ডনের এলডার স্ট্রিটে নিহত হন। গৃহহীন বাঙালিরা পূর্ব লণ্ডন শুধু নয়, অন্যান্য বারায়ও নিরুপায় হয়ে তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে আশ্রয় নিয়েছেন। শাবনা বেগম বলেন, পূর্ব লণ্ডনের ডীল স্ট্রিটের একটি স্কোয়াটিং করা ঘরে তার জন্ম হয়েছে। তিনি তার পিতার নিকট থেকে সে সময়ে তাদের পরিবার ও অন্যান্য বাঙালিদের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের বর্ণনা শুনেছেন। বাঙালির জীবন সংগ্রামের কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হওয়া থেকেই
তার আগ্রহ জাগে গবেষণা কাজের। প্রায় চার বছর তিনি বাঙালির এই সংগ্রাম সম্পর্কে ভুক্তভোগী নানা মানুষ ও পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ, আলাপ, সংগ্রাম করা ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার ও তথ্য সংগ্রহ করে এই গবেষণাকাজ সম্পন্ন করেন। তিনি বলেন, আমি যতই মানুষের কাছে তাদের সংগ্রামের কথা শুনেছি, ততই আমি বিস্মিত হয়েছি, সেদিনগুলো কত ভয়ংকর ছিল। আমাদের নতুন ও আগামী প্রজন্ম আমার এ কাজ থেকে প্রকৃত ইতিহাস জেনে যদি সামান্য উপকৃত হয়, তবে আমি তৃপ্তিবোধ করবো।
প্রশ্নোত্তর পর্বে আবাসন সংকট নিরসনে সফল আন্দোলন নিয়ে এক প্রশ্নে জবাবে শাবনা বলেন, আমার গবেষণায় উঠে এসেছে বা আমি যে তথ্য পেয়েছি, তাতে বেরিয়ে এসেছে বাঙালি যুব সম্প্রদায়সহ সাধারণ বাঙালির কয়েকটি সংগঠন প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এবং আবাসনসংকট সমাধানসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায়ে লাগাতার আন্দোলন করেছেন। এর মধ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে সামগ্রিকভাবে সর্বস্তরের অভিবাসী বাঙালি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় দু শতাধিক শ্রোতা ও দর্শকবৃন্দ আবেগঘন পরিবেশে ব্রিটেনে বাঙালি অভিবাসনের তথ্যবহুল কাহিনী শোনেন এবং তুমুল করতালির মাধ্যমে লেখককে অভিনন্দন জানান। জানা গেছে, অনুষ্ঠানে প্রায় শতাধিক গ্রন্থ বিক্রি হয়েছে। ক্রেতারা অত্যন্ত আগ্রহভরে লেখক শাবনা বেগম স্বাক্ষরিত ‘ফ্রম সিলেট টু স্পিটালফি?স’ বইটি কেনেন। সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠান শেষ হয় রাত ৯টায়।
উল্লেখ্য, শাবনা বেগমের বাড়ি ছাতক উপজেলার দোলারবাজার ইউনিয়নের চেলার চর গ্রামে। পিতা মো. আবদুল মছব্বির ও মাতা গুলজাহান বেগম। এছাড়া কবি হামিদ মোহাম্মদ হলেন শাবনা বেগমের চাচা।