নজরুল ইসলাম বাসন
একাত্তরে সালুটিকর এলাকার ক্যাম্প গড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাসহ বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতন করা হতো এখানে। হত্যার পর বর্তমান ক্যাডেট কলেজের পেছনেই গণকবর দেয়া হয়েছিলো তাদেরকে। সালুটিকরের এই গণকবরটি সবার কাছে বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত থাকলেও এতদিন এটি পড়েছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল এই টিলাভূমি। ছিল না কোনো স্মৃতিচি?ও। সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকায় এই বধ্যভূমির অবস্থান হওয়ায় সাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিল না। অবশেষে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর দুই মুক্তিযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবদুস সালাম বীর প্রতীক ও শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদের উদ্যোগে এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে এখানে নির্মাণ করা হয়েছে নান্দনিক শহীদ স্মৃতিউদ্যান।
“এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা তোমাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না”Ð যাদের রক্তের ঋণে মুক্ত স্বদেশ সেই সব শহীদ সারা বাংলার প্রত্যন্ত মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন। তাদের সমাধি অযতেœ অবহেলায় লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। এই রকম প্রায় শতাধিক শহীদ ঘুমিয়ে আছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজের পেছনে পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত বধ্যভূমিতে। গত ৫২ বছর ধরে এই বধ্যভূমি ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে বনজঙ্গলে ঘেরা ভূমিতে।
ইতিহাস বলে, ১৯৭১ সালে সালুটিকরের রেসিডেন্সিয়েল স্কুল ছিল (বর্তমানের ক্যাডেট কলেজ) পাকিস্তানি মিলিটারীদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। নিরপরাধ বাঙালীদের ধরে নিয়ে গিয়ে সেখানে প্রথমে নির্যাতন ও পরে হত্যা করা হত, নারী নির্যাতন করা হত সেখানে। ৫২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে ঐতিহাসিক এই ৭১-এর গণকবরকে শহীদ স্মৃতি উদ্যানে রূপান্তরিত করার দাবী উঠে। শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়া উদ্দিন আহমদ ও মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আব্দুস সালাম বীর প্রতীক (অব:) শহীদ স্মৃতিউদ্যান নির্মাণের কাজে উদ্যোগী হন। তাদের সাথে তাদের পরিবারের সদস্যরা এগিয়ে আসেন আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে। তবে মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আব্দুস সালাম বীর প্রতীক সেনাবাহিনীর নিকট থেকে অনুমতি লাভসহ সকল কাজ তাঁর টিম নিয়ে সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন।
৭১-এর এই বধ্যভূমি সিলেট ক্যাডেট কলেজের আওতাধীন ভূমি হওয়ায় এখানে স্মৃতিউদ্যান নির্মাণ করতে হলে সেনাসদরের অনুমতি প্রয়োজন ছিল বিধায় স্মৃতিউদ্যান নির্মাণের অনুমতি লাভের জন্যে কর্নেল সালাম বীর প্রতীক (অব), সেনা প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমদ বরাবরে আবেদন পেশ করেন। সেনা প্রধানকে লেখা এক আবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, সিলেট ক্যাডেট কলেজের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত গণকবরকে আনুষ্ঠানিকভাবে চি?িত করা হয়নি, তবে শহীদদের স্বজনদের উদ্যেগে গণকবর এলাকাটি নির্ধারণ করে ছোট একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে যা যথাযথ নয়। ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ জায়গাটি সম্পর্কে অবগত আছেন ও সাধারণ মানুষের মনে ও এই বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। তার আবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার হিসাবে সব সময় দেশের স্বার্থে ক্রমাগত উন্নতির লক্ষ্যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় আমার দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টা আজও অব্যহত রয়েছে।”
কর্নেল আব্দুস সালাম বীর প্রতীকের চিঠি পাওয়ার পর সেনা প্রধান সহযোগিতার হাত বাড়ান, তাঁর নির্দেশে স্থানীয় সেনাবাহিনীও এগিয়ে আসে। এগিয়ে আসেন শহীদ ডা: শামসুদ্দিন আহমদের পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা ডা: জিয়া উদ্দিন আহমদ। এই ধারাবাহিকতায় কর্নেল আবদুস সালাম বীর প্রতীকের নেতৃত্বে তার টিম ৭১ এর বধ্যভূমিকে বর্তমানে নান্দনিক স্মৃতিউদ্যানে রূপান্তরিত করেছে। স্মৃতিউদ্যানের স্তম্ভে শহীদদের কাহিনী লেখা রয়েছে। পরিদর্শকরা সেই সব কাহিনী থেকে ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত ধারনা পেতে পারবেন। সম্প্রতি অন্যতম উদ্যোক্তা কর্নেল আব্দুস সালাম বীর প্রতীক লণ্ডনের টাওয়ার হিল মেমোরিয়াল পরিদর্শন করে গেছেন, যেখানে বিশ্বযুদ্ধে শহীদদের নামফলক রয়েছে। কুমিল্লার সেমিট্রি ও তিনি পরিদর্শন করেন একই সাথে। তিনি ভবিষ্যতে শহীদ স্মৃতিউদ্যানকেও আগামীতে এই রকম রূæপ দিতে পারেন বলে আমরা আশা করতে পারি।
উল্লেখ্য যে, এলাকাটি চা বাগানের টিলা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর। এই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অক্ষুন্ন রেখে কয়েকটি ধাপে স্মৃতিউদ্যান নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। আরো অনেক কাজ বাকী রয়ে গেছে। ব্যয় সাপেক্ষ এসব কাজ ব্যাক্তি উদ্যোগে করা সম্ভব না-ও হতে পারে। তবে স্মৃতি উদ্যানের নির্মাণ কাজের প্রথম ধাপ গত ৪ঠা মার্চ ২০২৩ সফলভাবে শেষ হয়েছে এবং দেশ-বিদেশ থেকে গিয়ে শতাধিক শহীদ স্বজন ম্মৃতিউদ্যানে প্রতীকী কবরে পু?স্তবক অর্পণ করেছেন। শহীদ সিরাজুল আব্দালের স্ত্রী সকিনা আব্দাল এই শহীদ স্মৃতি উদ্যানের নাম ফলক উন্মোচন করেন ও সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ফিতা কেটে শহীদ স্মৃতিউদ্যানের উদ্বোধন করেন। ৫২ বছর পর শহীদের স্বজনরা তাদের স্বামী, পিতার কবর খুঁজে পেলেন। ১৯৭১ সালে পাক হানাদারদের হাতে নিহত এ পর্যন্ত ৬৬ জনের লাশের গণকবরের তথ্য পাওয়া গেছে। আরো তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ৪ঠা মার্চের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শহীদ কর্নেল ডা: জিয়াউর রহমানের কন্যা শাহরীন ইসলাম, গকুল চন্দ্রের কন্যা রীনা চক্রবর্তী, মোগলটোলার সোনওর আলীর পুত্র বাপনসহ প্রায় ৬৬টি শহীদ পরিবারের স্বজন প্রতীকী কবরে পু?স্তবক অর্পণ করেন। ২১শে ফেব্রæয়ারী, ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসে শহীদ স্মৃতি উদ্যানে অনুষ্ঠান হবে এ প্রত্যাশা করা যায়।
৪ঠা মার্চের শহীদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে আরেকটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হল সিলেটে। সারা বাংলাদেশে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষসহ ও যারা প্রাণ দিয়েছে ও যেসব মা-বোনেরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে দেশজুড়ে এ ধরনের স্মৃতিউদ্যান নির্মাণ এখন সময়ের দাবী। এই প্রতিবেদন শেষ করার আগে যে কথা বলতে চাই তাহলো সিলেটের শহীদ স্মৃতিউদ্যানের প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি- বলা যায় শুরু হল মাত্র। এখন থেকে যে কাজ শুরু করতে হবে তাহলো এই উদ্যানের আশেপাশে অনেক পতিত ভূমি রয়েছে এসব ভূমি আইনানুগভাবে অধিগ্রহণ করে এখানে লাইব্রেরি, অডিটোরিয়াম, যাদুঘর, গবেষণা কেন্দ্র, উন্মুক্ত প্রাঙ্গন, ওয়াকওয়ে, ক্যাফে ইত্যাদি নির্মাণ করতে হবে। যাতে পরিদর্শকরা এখানে পরিবার নিয়ে ভ্রমণ করতে পারেন সে জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে।
বিশ্ব সিলেট সম্মেলন এই ধরনের একটি মহতী কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করায় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই মহতী উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করায় তাদেরকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও সংগ্রামী অভিনন্দন। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা ডা: জিয়া উদ্দিন আহমদ যিনি শহীদ পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আব্দুস সালাম বীরপ্রতীক যিনি নিরলস শ্রম ও সময় দিয়েছেন এবং এই প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছেন আমরা তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ রইলাম।
লণ্ডন, ২৬ মার্চ ২০২৩
লেখক: সাবেক মিডিয়া অফিসার, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল
. . . .