সাগর রহমান
চারতলার ঐ ফ্ল্যাটে মোট রুম সংখ্যা তিন। আর এই তিন রুমে থাকতেন অন্তত তেইশ জন বাংলাদেশি! নিহত মিজানুর রহমানের বাড়ি বাংলাদেশের সেনবাগ এলাকায়। ধারদেনা করে প্রায় ষোলো লাখ টাকা খরচ করে ভিজিট ভিসা ‘ম্যানেজ‘ করেছেন, এবং এদেশে মাত্র দুই সপ্তাহ আগে এসেছেন উন্নত জীবনের আশায়! অন্যান্য ভাড়াটিয়াদের বেশিরভাগই স্টুডেন্ট ভিসায় বিভিন্ন কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যারা পুলিশ বা দমকল কর্মী আসার আগেই বাসা ত্যাগ করে যান। তাদের ওভাবে বাসা থেকে পালিয়ে যাবার কারণ কেবল আগুন নয়, ওভারক্রাউডিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত হবার ভয়ও। একটি বাসায় নির্দিষ্ট বাসায় নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের চেয়ে বেশি থাকাটাই হচ্ছে ওভারক্রাউডিং, এটি এক ধরনের অপরাধ।
খবরটি হয়তো আপনাদের অনেকের চোখেই পড়েছে। গত ৫ মার্চ রাতে, পূর্ব লণ্ডনের শ্যাডওয়েল এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে (ধারণা করা হচ্ছে, ইলেট্রিক বাইকের চার্জার হতে) আগুন লাগে। এ অগ্নিকাণ্ডে মিজানুর রহমান নামক এক ব্যক্তির মৃত্যূ হয়েছে। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। চারতলার ঐ ফ্ল্যাটে মোট রুম সংখ্যা তিন। আর এই তিন রুমে থাকতেন অন্তত তেইশ জন বাংলাদেশি! নিহত মিজানুর রহমানের বাড়ি বাংলাদেশের সেনবাগ এলাকায়। ধারদেনা করে প্রায় ষোলো লাখ টাকা খরচ করে ভিজিট ভিসা ‘ম্যানেজ‘ করেছেন, এবং এদেশে মাত্র দুই সপ্তাহ আগে এসেছেন উন্নত জীবনের আশায়! অন্যান্য ভাড়াটিয়াদের বেশিরভাগই স্টুডেন্ট ভিসায় বিভিন্ন কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যারা পুলিশ বা দমকল কর্মী আসার আগেই বাসা ত্যাগ করে যান। তাদের ওভাবে বাসা থেকে পালিয়ে যাবার কারণ কেবল আগুন নয়, ওভারক্রাউডিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত হবার ভয়ও। একটি বাসায় নির্দিষ্ট বাসায় নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের চেয়ে বেশি থাকাটাই হচ্ছে ওভারক্রাউডিং, এটি এক ধরনের অপরাধ।
শে?ার.ওআরজি.ইউ-এর মতে, একটি বাসায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ বসবাসের সাধারণ নিয়মটি হচ্ছে, ১ রুম = ২ জন মানুষ, ২ রুম = ৩ জন মানুষ, ৩ রুম = ৫ জন মানুষ। এখানে যদিও পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ মানুষজনের কথা বলা হচ্ছে, এবং এই নিয়মের নানান হিসেব-নিকেশ আছে, তবে মোটামুটি ৩ রুমের একটি বাড়িতে সর্বোচ্চ থাকতে পারার কথা ঐ ৫ জনেরই। এই হিসেবে, শ্যাডওয়েলের ঐ বাড়িতে মোটামুটি ৪.৬ গুণ বেশি মানুষ ছিলেন। পত্রিকার (লণ্ডন থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক পত্রিকা’, ১৪-২০ মার্চ, ২০২৩) বিস্তারিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ঐ ফ্ল্যাটের প্রতি রুমে সাত থেকে আটজন মানুষ বাস করতেন। কেউ কেউ বেড শেয়ার করতেন। ছিলো বাংক বেড বা দোতলা বেড। কেউ কেউ থাকতেন ফ্লোরে। এমনকি রান্না ঘরেও কেউ কেউ ঘুমাতেন বলে জানা গেছে। এমন অনেকে আছেন যারা কেবল রাতে ঘুমানোর জন্য আসতেন। প্রতি রাতের জন্য ভাড়া গুনতে হতো বিশ পাউণ্ড। এ ধরনের ওভারক্রাউডিং বাড়িগুলোতে যা হয়, অপরিচ্ছন্ন-নোংরা পরিবেশ, তেলাপোকা-ছারপোকার সংক্রমণÐ তার সব দোষেই দুষ্ট ছিল ঐ ফ্ল্যাটটি। পাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন এ বাসার ওভারক্রাউডিং বিষয়ে কাউন্সিলকে অবগত করেছেন বলেও জানা গেছে, যদিও বিষয়টি কাউন্সিল খুব একটা আমলে নেয়নি। সমস্যাটা আরেকটু ঘোরালো হয়েছে যখন বিবিসির পক্ষ থেকে এ ফ্ল্যাটের বাড়িওয়ালার সাথে যোগাযোগ করা হয়। ভদ্রলোক ওভারক্রাউডিং বিষয়ে তার দায় পুরোপুরি অস্বীকার করে যা বলেন, তা হলো: তিনি ফ্ল্যাটটি তিনজন মানুষকে ভাড়া দিয়েছিলেন, এবং জানতেন ঐ তিনজনই ওখানে বসবাস করে। তারা যে বাসাটি অন্যদের কাছে ভাড়া দিয়ে হাউজিং ব্যবসা করছে Ð তা তিনি বিন্দুমাত্রও জানতেন না।
যুক্তরাজ্যের বাসস্থান সংক্রান্ত আইন ১৯৮৫ অনুযায়ী, যদি কোন বাসস্থানে নিয়মিত রাত্রিযাপনকারী ব্যক্তির সংখ্যা অনুমোদিত ব্যক্তির সংখ্যার (উপরের প্যারায় উল্লেখিত) চেয়ে বেশি হয়, তবে ‘স্পেস স্ট্যাণ্ডার্ড’ লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে ধরা হবে। সত্যি কথাটি হচ্ছে, লণ্ডন.গভ.ইউকে-এর দেয়া তথ্য মতে, অধুনা পরিচালিত ইংলিশ হাউজিং সার্ভের হিসেবে, লণ্ডনের অন্তত শতকরা ৯.২ বাড়ি (প্রকৃত সংখ্যাটি হচ্ছে ৩২২,০০০ টি বাড়ি) ওভারক্রাউডেড। আর শে?ার বলছে, লণ্ডনের প্রতি ছয় জনের একজন ওভারক্রাউডেড বাড়িতে বসবাস করে। করোনা পরিবর্তীকালে ইউকে স্টুডেন্ট ভিসা সহজ হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট হিসেবে এদেশে আসার যে হিড়িক পড়ে যায়, তাদের প্রায় সবাই (খুব ধনীদের কথা অবশ্য আলাদা), কোনোরকম জরিপ ছাড়াই বলে দেওয়া যায়, বাসস্থানের সমস্যায় পতিত হয়েছেন। প্রথম বাসা পাওয়া, এবং দ্বিতীয়ত পাওয়া বাসাটির ভাড়া নাগালের মধ্যে থাকা Ð দুটোই সোনার হরিণ পাওয়ার মতো র্দূলভ হয়ে ওঠেছে। অগ্নিকাÐ ঘটা ঐ ফ্ল্যাটের এক বাসিন্দা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি ছয়-সাত মাস আগে এদেশে এসেছেন। কিন্তু এতদিন চেষ্টা করেও কোনো থাকার জন্য রুম জোগাড় করতে না পেরে অনেকটা বাধ্য হয়েই এই ঠাসাঠাসি ভীড়ের ফ্ল্যাটে উঠেছেন। তার ফ্ল্যাটমেট আর সবার গল্পও মোটামুটি একই।
পূর্ব লণ্ডনের বিভিন্ন এলাকার অনেকগুলো দোকানের জানালায় বাসা ভাড়া সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন সাঁটা থাকতে দেখা যায় সবসময়। এসব বিজ্ঞাপনের সামনে উৎসুক মানুষের ভীড়ও লেগে থাকে সকাল-সন্ধ্যা। মনে আছে, আমি যখন এদেশে আসি, তখন আমিও এরকম দোকানের জানালায় সেঁটে রাখা ‘টু-লেট’ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেখে দেখে, একটার পর একটা ফোন করে, বাসা ম্যানেজ করার চেষ্টা করতাম। অর্থাৎ, সমস্যাটা তখনও ছিল। তখনও কিছু মানুষ বাসা ভাড়া করে সেখানে অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে বেশি মানুষকে ভাড়া দিয়ে দ্রæত মুনাফা লাভের ব্যবসায় নেমে পড়তেন। তবে গত কিছু বছরে সেটা ফুলে-ফেঁপে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মাত্র তিনরুমে তেইশ-চব্বিশজনকে ভাড়াটিয়া হিসেবে তুলে দেওয়ার প্রায় অকল্পনীয় অবৈধ ব্যবসা শুরু হয়েছে। এসব ফ্ল্যাটের জীবনযাপন প্রায় সবক্ষেত্রেই অনেকটাই মানবেতর। দুঃখের কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে আসা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই কিন্তু এসব বিষয়গুলো একেবারেই জানতে পারেন না। তাদের কলেজ কিংবা ইউনির্ভাসিটির প্রসপ্রেক্টাসে যেসব ছবি দেওয়া থাকে, লণ্ডন ব্রিজ কিংবা বাকিংহাম প্যালেসের যে লণ্ডন Ð সেটা উপভোগ করার সৌভাগ্য হয় আসলে খুব কম শিক্ষার্থীরই। এখানের কঠোর জীবন আর জীবনযাত্রা ব্যয়ের অসহনীয় বাস্তবতার সাথে যোগ হয় কিছুদিন পর পর এদেশের অভিবাসন নীতি, যার কবলে পড়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা কিংবা স্বপ্ন জলাঞ্জলী দিয়ে একসময় হয় ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়, কিংবা অবৈধ হয়ে পাড়ি জমাতে হয় ইউরোপের ভিন দেশে। মনে আছে, সেই দুই হাজার আট-নয় সালের দিকে ঠিক এখনকার মতোই লণ্ডনের স্টুডেন্ট ভিসা অতি সহজ করে দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা আইইএলটিসের বালাই ছাড়াই জলের মতো ছাত্র-ছাত্রী আনতে শুরু করে এখানকার সরকার। এতে এদেশের অর্থনীতির বুস্ট-আপ হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ঐ ছাত্র-ছাত্রীদের অতি অল্প সংখ্যকই শেষ পর্যন্ত এখানে সেটেলড হয়ে থাকতে পেরেছেন। প্রায় সবাইকেই ইউকে ছাড়তে হয়েছে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সরকারের ‘এভার চেঞ্জিং’ আইনের মারপ্যাঁচে। অতীত অভিজ্ঞতায় বলা চলে, গত এক দেড় বছরে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যও সরকার আগামী কিছু দিনের এমন সব আইন করতে থাকবেন, যাতে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী যে ভবিষ্যত পরিকল্পনা করে এদেশে এসেছেন, তাদের ব্যর্থ মনোরথ হতে হবে। এর ওপর অনেকেই আছেন যারা কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ভিসা প্রসেসের জন্য লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব মধ্যসত্ত¡ভোগকারীরা সঠিক তথ্য দেন না, বা সত্যের অপলাপ করেন। এমন অনেক কেইস আছে যেখানে স্টুডেন্ট এদেশে এসে দেখেন, তার নামে কোনো ভর্তিই নেই। কিংবা যে প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র দিয়ে তিনি এসেছেন, সেই প্রতিষ্ঠানটিই হয়তো তিনি আসতে না আসতে উঠে গেছে!
আমার এক বন্ধু মেসেঞ্জারে দুটো স্ক্রিনশট পাঠিয়েছেন আমাকে। দুটোতেই ফেইসবুকে ইউকে স্টুডেন্ট ভিসা এণ্ড ওপেন ডিসকাশন নামক একটি পেইজের ছবি। প্রথমটিতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে কেউ একজন ঐ পেজের সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে স্ট্যাটাস দিয়েছেন: “আমি লণ্ডনে স্টুডেন্ট ভিসায় আসতে চাচ্ছি। যারা ইতিমধ্যে গেছেন, তারা কেউ কি বলবেন, ওখানের অবস্থাটা কেমন?” এ প্রশ্নের উত্তরে নানান ধরনের মন্তব্য আছে। তার প্রায় সবই ঋণাত্বক। তবে বন্ধুটি একটি বিশেষ মন্তব্যে গোল দাগ দিয়ে পাঠিয়েছেন। সেখানে জনৈক ছাত্র লিখেছেন: “জাস্ট ডোন্ট কাম। লাইফ ইজ হেল হিয়ার। যে টাকা দিয়ে এখানে আসার কথা ভাবছেন, সেটা দিয়ে দেশেই ভাল কিছু করতে পারবেন।” বন্ধুর পাঠানো দ্বিতীয় স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে, এই মন্তব্য করা জনৈক ছাত্রটি মাত্র মাস দুয়েক আগে এদেশে পা দিয়েই ঐ পেজে নিজের আকর্ণ বিস্তৃত হাসির সেলফিসহ স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন: “শুকুর আলহামদুল্লিলাহ। অবশেষে স্বপ্নের দেশে পা রাখলাম।”
এসব জেনে বুঝেও আমি জানি, এখনও অনেক শিক্ষার্থীই এদেশে আসার প্রহর গুনছেন। তবে আসার আগে যতদূর সম্ভব সঠিক তথ্য জেনে, যেখানে আসছেন সেখানকার প্রকৃত অবস্থাটা বিবেচনা করে আসা উচিত বলেই মনে হয়। আজকাল সব তথ্য-উপাত্ত অনলাইনে পাওয়া যায়। কোন দালাল বা মধ্যসত্ত¡ভোগকারী ছাড়াই কিন্তু যে কেউই নিজের ভিসা প্রক্রিয়ার সব কাজ-কর্ম নিজেই করে ফেলতে পারেন। এখন সব প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার অবাধ সুযোগ আছে। এই সুযোগগুলো কাজে লাগান। ভিসা প্রসেসিংয়ের কাগজপত্র পূরণ করতে কারো সাহায্য লাগলে Ð নিন, তবে নিয়ন্ত্রণটা যেন থাকে নিজের হাতে।
লণ্ডন। ২৩ মার্চ, ২০২৩।
লেখক: কথাসাহিত্যিক