সাগর রহমান
যে কোনো নতুন প্রযুক্তিই কিছু সুবিধার সাথে কিছু অসুবিধা নিয়ে আসে। বিষয়টা নির্ভর করে প্রযুক্তিটিকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তার গতিবিধিকে কতোটা মানুষের কল্যাণের সাথে সমন্বয় করে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে Ð তার উপর। ইউরোপের দুয়েকটা দেশে ইতিমধ্যে চ্যাট জিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যাপগুলোর ব্যবহার বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়েছে। ঐ ফটোটি দেখেছেন? ছিয়াশি বছর বয়সী পোপ ফ্রান্সিস একটি ধবধবে সাদা পাফার জ্যাকেট পরে রোমের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফোলা বড়সড় জ্যাকেটের সাথে সাথে তার ঋজু হাঁটার ভঙ্গি, হাতে কোনো একটা কফি বা পানিয়ের মগ ধরে রাখা, মুখের উপরে পড়া রোদ ঝলমল করছে, জ্যাকেটের উপরে ঝোলানো ক্রুশÐ সবমিলিয়ে বেশ চমকপ্রদ এই ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ার সংগে সংগে ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়। পোপের এই অত্যাধুনিক পোশাক পরা ছবিতে লাইক, কমেন্ট শেয়ারের বন্যা বয়ে যায়। একটাই সমস্যা। ছবিটি – ফেইক। পোপ ফ্রান্সিস অমন কোনো পোশাকে জীবনেও অমন পোজ দেননি। এ বয়সে এসে তাঁর পক্ষে অমন ঋজু ‘রাফ এÐ টাফ’ ভঙ্গিতে হাঁটাও অসম্ভব। অথচ ছবিটি দেখে অসংখ্য মানুষ বিশ্বাস করে বসে যে, সত্যিই এটি পোপ ফ্রান্সিসের আসল ছবি। অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, সাদা চোখে ছবিটিতে কোনো জোচ্চুরি আছে বলে ধরা প্রায় অসম্ভব। এই ছবিটি কোনো মানুষ তৈরি করেনি, করেছে মিডজার্নি নামক একটি ছবি আঁকার প্রোগ্রাম। চ্যাট জিপিটি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মিডজার্নিও তাই। চ্যাট জিপিটি কাজ করে টেক্সট নিয়ে, মিডজার্নির কাজ আঁকা–আঁকি নিয়ে। যে ভদ্রলোক পোপের ঐ ছবিটি এঁকেছে ( কিংবা বলা ভালো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দিয়ে আঁকিয়েছেন), তার নাম পাবলো জাভিয়ার। একত্রিশ বছর বয়সী জাভিয়ার মূলত একজন নির্মাণ–কর্মী, বাড়ি শিকাগো। অবসর সময়ে নেট ঘাঁটাঘাঁটি করা তার বিনোদনের অংশ। ছবিটি তৈরি করতে তার সময় লেগেছে বড় জোর ত্রিশ সেকেণ্ড। মিডজার্নি ওয়েবসাইটে ঢুকে তাকে শুধুমাত্র লিখতে হয়েছে: The Pope in Balenciaga uffy coat,Monicier,walking the streets of Rome,Parisকথাটি মিডজার্নির চ্যাট বক্সে লিখে কফিতে এক চুমুক দিয়ে দ্বিতীয় চুমুক দেবার আগেই ছবি তৈরি। এই একই ছবি যদি আপনি ফটোশপ বা এ জাতীয় কোনো প্রোগ্রাম দিয়ে ম্যানুয়ালি করতে যেতেন, তবে আপনাকে ফটো সম্পাদনার কাজে অতি দক্ষ একজন তো হতে হতোই, কাজটাতে সময় লাগতো ঘন্টার পর ঘন্টা। মিডজার্নিতে একাউন্ট করে যে কেউই যে কোনো ধরনের ছবির ‘আব্দার’ লিখে দিলে মুহূর্তেই এই অ্যাপটি এত সুন্দর সুন্দর সব ছবি এঁকে দিবে, যা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না যে মাত্র কয়েকটা শব্দ লিখেই এই ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। পোপের এই ছবিটি ভাইরাল হতে না হতেই চারদিকে হৈ হৈ রব উঠেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আঁকা ও সম্পাদনা করা ছবির বিপদাপদ নিয়ে নতুন করে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে নেট কমিউনিটি। মিডজার্নি এতদিন যে কাউকেই ফ্রি একাউন্টে ছবি আঁকার কিছু সুবিধা দিতো। পোপের ছবির ইস্যুতে সুবিধাটির অপব্যবহারের কথা সামনে এনে তারা ফ্রি একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। মিডজার্নিতে এখন কেবল নির্দিষ্ট সাবস্ক্রিপশানের বিনিময়ে ছবি আঁকার কাজ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনা? ট্রাম্পের গ্রেফতার হওয়ার খবর চাউর হতে না হতেই মিডজার্নির আঁকা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় একদল পুলিশ তাকে ঘিরে ধরে গ্রেপ্তার করতে চাচ্ছে। ডোনা? ট্রাম্প তাদের মাঝখানে পুলিশদের সাথে ধস্তাধস্তি করছেন। এখানেও সেই একই ব্যাপার। বলে না দিলে, এটি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে, চ্যাট বক্সে স্রেফ কয়েকটা শব্দ লিখে সম্পাদনা করা ছবি, তা সাধারন মানুষের বোঝার প্রায় অসাধ্য! এরকম অসংখ্য ছবি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে নেট দুনিয়ায়। পাবলো জাভিয়ারের মতো বেশিরভাগ মানুষই মূলত মজা করার জন্য এ ধরনের ছবি তৈরি করছেন বটে, কিন্তু তার প্রভাব যে কত সুদূর প্রসারি হতে পারে, তা যদি একটুখানি ভাবা যায়, তবে শংকিত না হয়ে আসলেই উপায় নেই। সমস্যাটা কেবল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আঁকা ছবি নিয়ে নয়, মূল সমস্যা এ ধরনের একটি ছবি ভাইরাল হয়ে যাওয়া এবং কোনো রকম কোনো প্রশ্ন না তুলে তাকে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস করাটাতে! আমাদের চারপাশের পৃথিবীটা খুব দ্রæত বদলাচ্ছে বেশ কয়েক দশক ধরেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিও খুব একটা পুরনো নয়। কিন্তু তার ব্যবহার যেই সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয় ঢুকে পড়েছে, সংগে সংগে যেন বদলানোর পালে জোর হাওয়া লেগেছে। আমার বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচরণ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জীবনবোধÐ সবকিছুতেই হু হু করে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে এই প্রযুক্তি। ভয়ের বিষয় হচ্ছে, এই পরিবর্তনটার জন্য পৃথিবীর কোনো দেশই তৈরি নয়। সত্য এবং মিথ্যার, প্রকৃত এবং ভেজালের পর্দা সূ² হতে হতে প্রায় না দেখতে পাওয়ার সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। একসময় মানুষ মুখের কথাকে বিশ্বাস করতে না পারলে লিখিত প্রমাণ চাইতো। সেটা যেহেতু খুব সহজেই জাল করা যায়, তার পরে চাওয়া চাওয়া শুরু হলো ফটোগ্রাফিক সত্যতার। সেই কালের অবসানও হয়ে যাচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায়। মিডজার্নি, ডালি–২, স্ট্যাবল ডিফিউশান কিংবা এডোবির ফায়ার–ফ্লাই নামক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ছবি