।। সাগর রহমান।।
লোকটা বেশ গলা ছেড়েই গান গাচ্ছিল। বব মার্লির বিখ্যাত গান: নো উইমেন নো ক্রাই/ আই রিমেম্বার, হোয়েন উই ইউজড টু সিট/ ইন দ্য গভেরমেন্ট ইয়ার্ড …। মনে এবং গলায় মাঝে মাঝে গানের দমক আসলে অনেকেই নিজেকে সামলাতে পারেন না, জায়গায়-অজায়গায় গেয়ে ওঠেন। তারওপর আজকালকার হেডফোন কিংবা ইয়ারবাডের যুগে অনেককেই দেখেছি ভীড়ের ট্রেনেও আচমকা দুয়েক চরণ গেয়ে ওঠেন। তার কানে বাজতে থাকা গানটি যে আর কারো কানো বাজছে না, ফলে এমন আচমকা ছেঁড়া ছেঁড়া দুয়েকটা চরণ শুনতে বেশ পাশেরজনের ‘বাজে’ লাগে, সেই খেয়ালটুকু অনেকের থাকে না। অবশ্য তাতে কী, মনে আনন্দ হলে গান গাওয়া যেতে পারে- তা সুরে কিংবা বেসুরে, ট্রেনের ভীড়ে, কিংবা পার্কের জনবিরল বেঞ্চিতেই হোক না কেন। তারওপর গানই তো গাচ্ছে, বকাবকি তো আর নয়(অবশ্য কেউ কেউ আজকাল বকাবকির গানও গান, কিন্তু সে তর্ক এখানে না)। কিন্তু যার কথা দিয়ে শুরু করেছি, তার কানে কোনো হেডফোন কিংবা ইয়ারবাড দেখিনি। যথেষ্ট সুরেলা গলা। গাচ্ছেও বেশ গলা খুলে। সময়টা দুপুরের একটু আগে হওয়ার কারণে লন্ডন ব্রিজ স্টেশান বেশ খানিকটা নির্জন। ট্রেন থেকে নেমে চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসতেই এই বব মার্লি। আফ্রিকান মানুষ। মাথায় জ্যামাইকানদের ট্রেডমার্ক টুপি। বব মার্লির মতোই দলা-পাকানো লম্বা চুল ঘাড় অব্দি পড়ে আছে। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কজ্বিতে বেশ কয়েকটা বালা। একটা ‘ঝাড়–-মেশিন’ চালাতে চালাতে, টুরিস্ট-প্রবণ লন্ডনব্রিজের বিশাল স্টেশানটির মেঝে পরিষ্কার করতে করতে নিজের আনন্দে গান গেয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। আমি হাতের কফি কাপটি চাইলে অদূরের ডাস্টবিনে ফেলতে পারতাম। তা না করে ইচ্ছে করেই ঐ ঝাড়–-মেশিনের দিকে এগিয়ে গেলাম। মেশিনটার এক পাশে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট ডাস্টবিন লাগানো আছে। ওটাতে কাপটি ফেলতে গেলাম, উদ্দেশ্য – আরেকটু কাছে থেকে ওর গান শোনা। এই ঝাড়–-মেশিনগুলো বেশিরভাগ কাজ নিজেরাই করে থাকে। নিচের দিকে লাগানো দুটো ঘূর্ণায়মান পেল্লাই-আকারের খেংরাকাঠির ঝাড়– মেঝের ময়লা তুলে নিজের উদরে প্রবেশ করিয়ে ফেলতে না ফেলতেই কোথা থেকে যেন পানি ছিটকে বের হয়। ওপারেটর কাজ মূলত পেছনের হ্যান্ডেলটা ধরে ধরে ওকে প্রয়োজনমত এদিকে-ওদিকে পরিচালনা করা। যেহেতু বেশিরভাগ সময় স্টেশানে প্রচুর লোকের আনা-গোনা করেন, ফলে বেশ ধীরে-সুস্থে রয়ে-সয়ে মেশিনটিকে চালাতে হয় যাতে কারো গায়ে না লেগে অনাকাঙ্খিত বিপত্তি না ঘটে। যাই হোক, কাছ থেকে গান শুনতে যেয়ে উল্টো গানে বাধা দিয়ে ফেললাম আমি। কাপ ফেলে সরে আসতে না আসতেই সে গান থামিয়ে গমগমে গলায় বলল, থ্যাংক ইউ। আমি বললাম, নো, থ্যাংক ই-উ। কাছে গিয়ে বুঝলাম, কেবল বেশভূষা আর গায়ের রঙে নয়, এর চেহারার সাথেও বব মার্লির আশ্চর্য মিল! সে হাসল। আমি বললাম, লেট মি গেস। তোমার নাম বব মার্লি। আমার এই সামান্য কৌতুকে সে কাজ থামিয়ে, গলা কাঁপিয়ে, স্টেশান ফাটিয়ে হাসতে লাগল। ওমন প্রাণখোলা হাসি আমি আফ্রিকান ছাড়া অন্য মানুষদের খুব একটা হাসতে দেখিনি। সাদা ঝকঝকে দাঁত ঝলসে উঠল কালোরঙের ভেতর থেকে। আমার অভিজ্ঞতায়, অতি সামান্য কারণেও জায়গা-অজায়গার ভেদাভেদ ভুলে কালো মানুষেরা হাহা করে হেসে উঠতে পারে। একসময় হাসি থামিয়ে বলল, আমার পরিবারের দেওয়া নাম একটা আছে। কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, বব মার্লিই আমার আসল নাম। আমি বললাম, বেশ, বেশ, এটাই থাকুক তাহলে। এটাই তোমাকে সবচেয়ে ভালো মানায়। বাট, হেই, আই এম সরি। সে বলল, কেন? আমি বললাম, তোমার গান থামিয়ে দিলাম। বেশ চমৎকার গাচ্ছিলে কিন্তু! এবারে খানিকটা লজ্জা দেখতে পেলাম মুখে। উচ্চস্বরে বলল, ওহ, থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ। আমি সরে যেতে যেতে বললাম, আবার শুরু করে দাও। ইটস এ প্লেজার টু হিয়ার বব মার্লি ইন দিস ক্রাউড। সে তার হাতে ধরা চিমটা দিয়ে মেঝে থেকে একটি পত্রিকার ছেঁড়া পাতা তুলে তার ডাস্টবিনে রাখতে রাখতে মাথাটা সামান্য ঝুঁকে নাটকিয় কায়দায় বলল, গুড ডে টু ইউ স্যার। গুড ডে টু ইউ।
ঘটনাটা বছর খানেক আগের। লন্ডন ব্রিজ স্টেশানটি আমার যাতায়াতের রাস্তায় পড়ে না। ফলে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া সাধারণত ঐ স্টেশানে যাওয়ার কথাও আসে না। গত সপ্তাহে একটা বিশেষ কাজে পরপর বেশ কয়েকদিন ঐ এলাকায় যেতে হলো। স্টেশানের সেই বব মার্লির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু স্টেশানের টিকেট-গেইট পেরিয়ে আসতেই বুঝলাম, আমার মস্তিষ্ক ঠিক ঠিক ওকে মনে রেখে দিয়েছে। নিজের অজান্তেই এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে সেই গান-গাওয়া পরিচ্ছন্নতা-কর্মীকে খুঁজতে শুরু করেছে। কিন্তু দেখলাম না। স্টেশান থেকে চটজলদি বেরিয়ে গেলাম। বিকেলে আবার যখন ঐ এলাকার কাজ সেরে বাড়ির পথ ধরার জন্য স্টেশানে ঢুকেছি, তখন বেশ লোকে-লোকারণ অবস্থা। যথেষ্ট ভীড়। হঠাৎ একটি যান্ত্রিক গলা শুনতে পেলাম নিজের ঠিক পেছনে, বি কেয়াফুল। প্লিজ মুভ এ-সাইড। ফিরে তাকিয়ে দেখি একটি গাড়ি। ক্লিনার গাড়ি। পেছনের দু’পায়ে চাকা। সামনের দিকেও হয়তো কোথাও চাকা আছে, তবে সেটা দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে দুটো ঘূর্ণায়মান ঝাড়–। থেকে থেকে নিচের দিকের কোথাও হতে সামান্য পানি ছিটকে আসছে। সেই পানির ওপরে ঝাড়– দুটো ঘুরে ঘুরে পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে করে তুলছে স্টেশানের মেঝে। একটা নীল আলো একটু পরপর চারপাশে ঘুরে আসে। চারপাশের ভীঢ়-বাট্টা কিংবা ময়লা-আবর্জনা ডিটেক্ট করার ব্যবস্থা বোধহয় ওটা। গাড়িটি একা একাই চলছে। চলতে চলতে আশে-পাশের লোকজনকে মেয়েলি গলায় যথেষ্ট উচ্চ স্বরে সাবধান করছে। পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ঝাড়–-মেশিন। গায়ে পরিচয় লেখা: সুইপার ১১১। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম এই মেশিনের কাজকর্ম। অতি ধীরে ধীরে, স্টেশানের প্রতিটি ইঞ্চি পরিষ্কার করতে করতে সেটি এগিয়ে যাচ্ছে লোকজনের ভীড়ের ভেতর দিয়ে। ভীড় বলে বোধহয় ওর সাবধানতাও বেশি। সেকেÐে সেকেÐে সেই ‘বি কেয়ারফুল’ হবার কথাটি মনে করিয়ে দিচ্ছে।
আজ থেকে অন্তত সাড়ে আটশত বছর আগে ইসমাইল আল-জাজারি(১১৩৬-১২০৬) এক আরব একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম: The book of knowledge of ingenious machine বইটিতে তিনি একশটির মতো মেশিনের বর্ণনা দিয়ে সেগুলো কীভাবে তৈরি করা যাবে – তার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তখনকার টেকনোলজির সীমাবদ্ধতার কারণে যদিও সেগুলো তৈরি করা যায়নি, তবে ধারণা করা হয় যে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের চিন্তা সেই থেকে নানান বিজ্ঞানীকে যুগে যুগে ভাবিয়েছে। ইসমাইল আল-জাজারি’র একটি মেশিনের কথা বলি। মেশিনটির নাম হচ্ছে Ñ পরিচারিকা। এই মেশিন-পরিচারিকা কোন পার্টিতে চা কিংবা কফি ঢেলে অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করতে পারবে। একটি বড় ট্যাংকিতে রাখা পানিয়টি ফোঁটায় ফোঁটায় গিয়ে জমা হবে একটি কাপে। প্রতি সাত মিনিট অন্তর অন্তর একেকটা কাপ ভরে উঠবে। আর ঠিক তখুনি মেক্যানিক্যাল দরজা খুলে সেই পরিচারিকা বেরিয়ে এসে ঐ পূর্ণ হওয়া কাপটি অতিথিদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরবে। সেই যুগের বিবেচনায় অত্যন্ত চমকপ্রদ চিন্তা-ভাবনা – সন্দেহ নেই। আল-জাজারি’র মতোই শতকে শতকে অসংখ্য বিজ্ঞানীরা এমন অসংখ্য স্বয়ংক্রিয় মেশিন তৈরির কথা ভেবেছেন। কিন্তু অবশেষে, এই শতাব্দীতে এসে, গত কয়েক দশক ধরে মানুষের আজন্ম লালিত সেই স্বপ্ন এবং চেষ্টাগুলোর ফসল ফলতে শুরু করেছে। তৈরি হয়েছে সত্যিকারের ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’। হুড়মুড় করে সবকিছুতে ঢুকে পড়ছে মানুষদের চেয়েও হাজারো গুণ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন এই যন্ত্র-প্রাণীগুলো। এ.আই-য়ে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র।
মেশিনদের এই উত্থানের খোঁজখবর কিছুটা জানা থাকলেও স্টেশানের সুইপার রোবটটিকে দেখে আমার মন কেমন করে উঠল। মনে হতে লাগল, এই রোবটের কারণেই হয়তো এখানকার বব মার্লি চাকুরি খুইয়েছে। বেচারা একদিন সকালে এসে দেখেছে তার জায়গায় কাজ করতে শুরু করেছে একটি রোবট, চাকুরি দাতাদের চোখে যেই রোবট মানুষ তার চেয়ে অন্তত কয়েকগুণ বেশি কাজের। খানিকটা ইলেকট্রিসিটি ছাড়া এর আর কোন চাহিদাই নেই। নেই ছুটি-ছাটার আব্দার, পান-সিগারেট খাওয়ার অ-অনুমোদিত বিরতি নেবার বদভ্যাস, ক্লান্তি আর বকবক করার স্বভাবের জন্য যখন তখন কাজ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকা নেই, মাস শেষে বেতন দেবার ভয়ংকর ঝামেলা বিহীন। সহজ কথায়, এ এক কাজপাগল ‘গোপাল’ যে শত চড়েও রা করে না, যার কোনো চাহিদা নেই অথচ কাজটি উসুল করে দেয়ে ষোলো আনা – এর চেয়ে আর কী চাইতে পারে একজন চাকুরিদাতা।
তবে এই মেশিনরা আর খুব বেশিদিন ‘গোপাল’ হয়ে থাকবে বলে মনে হয় না। তার ইংগিত এবং আলামত ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ওরা নিজেরাই অনেক কিছুর ভার তুলে নিয়েছে। সায়েন্স ফিকশান শোনাচ্ছে বটে, তবে অতি বাস্তব। কিন্তু সে কথার অবকাশ আজকে আর নেই। যাযাবরের বিখ্যাত উক্তিটির কথা মনে হলো, আধুনিক বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। এই মেশিন-সুইপারের সাথে অচিরেই হয়তো কথোপকথন করা যাবে, তার ভেতরে একটি সিডি বসিয়ে দিলে সেও দিব্যি স্টেশান পরিষ্কার করতে করতে গলা ছেড়ে গান গাইতে পারবে। আর সেও যেমন তেমন গাওয়া নয়, ঢোল-বাদ্য সহকারে পরিশীলিত গলার গানই শোনা যাবে এর ভেতর থেকে। তবু একটি হেঁড়ে গলায় মনের আনন্দে গাইতে থাকা সেই ‘বব মার্লি’র গান না শুনতে পারার আক্ষেপ ভীড় করে এলো আমার মনে। মনের অজান্তে ভীড় করে আসা ‘অকারণ’ দীর্ঘশ্বাসটি বুকে চেপে স্টেশান চত্বর ত্যাগ করে বাড়ির পথ ধরলাম আমি।
লন্ডন। ১৮ মে, ২০২৩।
সাগর রহমান
কথাসাহিত্যিক
ইমেইল: : goddoshagor@gmail.com