বিশেষ প্রতিবেদন:
লণ্ডন, ২২ মে: অমর একুশের গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হল এবং ঢাকায় একটি সড়কের নামকরণের দাবী জানানো হয়েছে।
সভায় বক্তারা বলেছেন, তিনি আমৃত্যু বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার সংগ্রাম করে গেছেন। আপসহীন এ ভাষা সংগ্রামী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একজন অনড় কলমসৈনিক ছিলেন। তাঁর স্মৃতি ও আদর্শ রক্ষা করা আমাদের ও দেশবাসীর দায়িত্ব।
পূর্ব লণ্ডনের লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখা আয়োজিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রথম প্রয়াণবার্ষিকের আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সহসভাপতি সাংবাদিক নিলুফা ইয়াসমীন। সাধারণ সম্পাদক মুনিরা পারভীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের প্রবীন সংগঠক, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ। বিশেষ অতিথি ছিলেন গাফফার চৌধুরী তনয়া তনিমা চৌধুরী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেইন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর জীবনের শেষ লেখা গান পরিবেশন করেন একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, বিশিষ্ট গণ সংগীতশিল্পী হিমাংশু গোস্বামী। কবিতা আবৃত্তি করেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব উর্মী মাজহার।
অনুষ্ঠান শুরু করতে গিয়ে সঞ্চালক মুনিরা পারভীন বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদদের কথা স্মরণ করে বলেন, আজ ১৯ মে আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদ দিবস। ১৯৬১ সালে এই দিনে বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পুলিশের গুলিতে বরাকের শিলচরে ১১ জন প্রাণ হারান। সর্বপ্রথম যিনি প্রাণ দেন তিনি ছিলেন কমলা ভট্টাচার্য, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ হিসেবে যিনি আজ ইতিহাসের অংশ। এই এগারোজন ভাষা শহীদের মধ্যে দশজনেরই জন্মস্থান বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে। মুনিরা বলেন, কাকতালীয় বিষয় হলো, যে গাফফার চৌধুরী ৫২ এর ভাষা শহীদদের স্মরণে কালজয়ী কবিতা লিখে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলে নিয়ে আজীবন বিশ্বব্যাপী ছিলেন সমাদৃত, সেই গাফফার চৌধুরীর প্রয়াত হন আরেক ভাষা দিবস বরাক উপত্যকার ভাষা সৈনিকদের জীবন বিসর্জনের দিন। আমার মনে হয় একেই বলে ইতিহাসের কাকতাল। আজকের দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই আবদুল গাফফার চৌধুরীসহ বিশ্বের সকল ভাষা শহীদদের প্রতি।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সুলতান শরীফ তাঁর বক্তব্যে গাফফার চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা বাংলা ভাষা ধ্বংস করতে চেয়েছিলো তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মানুষদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ রক্ষার জন্য কাজ করেছেন, লেখনির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জন্য দেশের মানুষের আবেগ তৈরি করার কাজ করেছেন। তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন তার নিজস্ব কর্মগুণে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কন্যা তনিমা চৌধুরী স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার বাবাকে প্রথম কাঁদতে দেখি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। বাবা চিৎকার করে কেঁদেছেন।
বাবার বিশ্বাসের জায়গাটা অটল ছিলো। যা বিশ্বাস করতেন তাই লিখতেন। অন্যের বিশ্বাসে বা চিন্তায় প্রভাবিত হতেন না। একজন মানুষই তাকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের আরেক সংগঠক, ষাটের দশকের ছাত্রনেতা ও জেসিডাবিøউ আই-এর সাবেক চীফ এক্সিকিউটিভ হাবিব রহমান, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক আবু মুসা হাসান, বিবিসি বাংলার সাবেক সাংবাদিক উদয় শংকর দাশ, সাপ্তাহিক জনমত-এর প্রধান সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা, লেখক সাংবাদিক হামিদ মোহাম্মদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক সভাপতি সৈয়দ এনামুল ইসলাম, আওয়ামী লীগনেত্রী হুসনা মতিন, সাংবাদিক আসম মাসুম, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রাজিয়া বেগম, আমরা একাত্তরের যুক্তরাজ্য সংগঠক সত্যব্রত দাস স্বপন, চলচ্চিত্রকার মোস্তফা কামাল, লেখক মঈনুর রহমান বাবুল, মো. আব্দুল আজিজ, জামাল আহমেদ খান, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম খান, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আহাদ চৌধুরী, নির্মূল কমিটির শাহ বেলাল, শম্পা দেওয়ান, নজরুল ইসলাম অকিব, মুজিবুল হক মনি, হিলাল সাইফ, আব্দুল বাসির, নাজমা হুসেন, প্রীতি গোস্বামী ও সাংবাদিক রুমানা রাখি। সভাপতি নিলুফা ইয়াসমীন হাসান তাঁর স্বাগত বক্তব্যে বলেন, এই নগরে আলো হাতে স্বপ্ন নিয়ে কিংবদন্তী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এসেছিলেন। তিনি আমৃত্যু সেই আলো, সেই স্বপ্ন দু’হাতে বিলিয়েছেন। বিনিময়ে কুড়িয়েছেন মানুষের ভালবাসা আর শ্রদ্ধা। তিনি বলেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র উপদেষ্টা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাঙালির স্বাধিকার, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ ও একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণের আন্দোলনে আমৃত্যু ছিলেন সক্রিয়। তিনি আমাদের বাতিঘর। ধ্রুবতারার মত এখনও পথ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করেই তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন।
সভাপতির সমাপনী বক্তব্যে তিনি উপস্থিত সবাইকে স্মরণ সভায় যোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছাত্রাবস্থায় ১৬ বছর বয়সে দৈনিক ইনসান পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। প্রবাসে বসেও তিনি নিয়মিত বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিকে এবং লণ্ডনের সাপ্তাহিকে নিয়মিত লিখেছেন। তাঁর সব লেখা পুনর্মুদ্রণ করার জন্য বিশেষ করে সাপ্তাহিক জনমত ও সাপ্তাহিক পত্রিকার সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। আবদুল গাফফার চৌধুরীর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল ও ঢাকায় একটি সড়কের নামকরণ, লণ্ডনে একটি আর্কাইভ বা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার নানা প্রস্তাব করেন বক্তারা। এছাড়া লণ্ডনে স্মৃতিপরিষদ গঠন ও তাঁর নামে স্মারকস্মৃতি বক্তৃতা প্রচলনের প্রস্তাব করা হয়।
অনুষ্ঠান সমাপনীর আগে আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রয়াণের পরের দিন বিশিষ্ট লেখক ও রাজনীতিক মোনায়েম সরকারের লেখা একটি হৃদয়স্পর্শী কবিতা আবৃত্তিকার মুনিরা পারভীন পাঠ করে শোনান। অনুষ্ঠানের শুরুতে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। অমর একুশের গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।