।। নজরুল ইসলাম বাসন।।
১৯৭০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পূর্ব লণ্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালীদের (সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল থেকে আসা বাঙালি পরে বাংলাদেশী) অস্তিত্বের লড়াইয়ের এক সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এই ইতিহাসের প্রধান তিনটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে গত পাঁচ দশকে। লণ্ডনের একজন মিডিয়া কর্মী হিসাবে গত সাড়ে তিন দশকে কমিউনিটিতে যে চড়াই-উৎরাই দেখেছি তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই প্রতিবেদনে তুলে ধরার চেষ্টামাত্র। আমার দৃষ্টিতে এই ঘটনাগুলোর একটি হলো- ১৯৭০ সাল থেকে গৃহহীন বা হোমলেস বাঙালীদের কাউন্সিল ফ্লাট দখল বা স্কোয়াটিং ছিল একটি র্যাডিক্যাল মুভমেন্ট।
গৃহহীন বাঙালীর নিজেদের জন্যে বাসস্থান দখলের এই পদক্ষেপের পাশাপাশি এরপর ছিলো তাদের সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের অর্থনৈতিক সংগ্রামে নারী দর্জি শ্রমজীবীদের অংশগ্রহণ ও আরেকটি নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব। ৭০ দশক থেকে ২০০০ পর্যন্ত বাঙালী মহিলারা ঘরে বসে ব্রাদার বা সিঙ্গার মেশিন দিয়ে পোষাক সেলাই করে যে উপার্জন করতেন তাদের এই উপার্জন এদেশে নিজেদের সাংসারিক ব্যয় নির্বাহে যেমন লাগতো তেমনি দেশে অবস্থানরত পরিবার-পরিজনদের ভরণপোষণের জন্যে অর্থ পাঠানো হত। এই পাঠানো অর্থের নাম র্যামিট্যান্স, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দিতে এই রেমিট্যান্সের ভূমিকা খুবই শক্তিশালি।
২০১০ সালে লেবার পার্টি মনোনীত রুশনারা আলি এমপি প্রথম বাঙালি এমপি নির্বাচিত হন। তাঁর এমপি নির্বাচিত হবার মাধ্যমেই মূলস্রোতের রাজনীতির কেন্দ্রে বাঙালীদের প্রতিনিধিদের অভিষেক হল। টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রথম নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হন লেবার পার্টির মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক কাউন্সিল লীডার লেবার কাউন্সিলার লুতফুর রহমান। রুশনারা ও লুতফুর দুজনেই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এবং টাওয়ার হ্যামলেটসে বেড়ে উঠা প্রথম প্রজন্মের সিলেটী বাংলাদেশীদের সন্তান।
১৯৭০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শ্রমজীবী বাঙালীদের আত্ম“প্রতিষ্ঠার লড়াই থেকে হাউস অব কমন্সের সদস্য হওয়া এবং একজন বাঙালীর লকেল কাউন্সিলের নির্বাহী ক্ষমতা পাওয়া, লণ্ডনের আগামী দিনের ইতিহাসের এক বিশেষ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
অর্থনৈতিক সংগ্রামে হোম মেশিনিস্ট সিমস্ট্রেস বা মহিলা দর্জি
১৯৭০ দশক থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের বাঙালীদের ঘরে ব্রাদার বা সিঙ্গার এর ইণ্ডাস্ট্রিয়েল সেলাই মেশিনের দেখা পাওয়া খুব একটা বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল না। এসব সেলাই মেশিন দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা গৃহবধুরা ঘরে বসে ব্রাণ্ড বা লেভেলের পোষাক সেলাইয়ের কাজ করতেন। সংসারের জন্যে বাড়তি অর্থ উপার্জন করার জন্যে তাদেরকে এই কাজ করতে হয়েছে।
লণ্ডনের স্টেপনি কমিউনিটি ট্রাস্টের উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণা প্রকল্পের প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আই সউড আই স’উড: দি আনটোলড স্টোরি অফ বাংলাদেশী সিমস্ট্রেস ইন লণ্ডনস ইস্ট’ গ্রন্থটি প্রকাশিত না হলে মহিলা দর্জিদের জীবন সংগ্রামের গল্প অগোচরেই রয়ে যেতো। গবেষণাধর্মী এই প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী ২০ জন সিমস্ট্রেস বা মহিলা দর্জি, তাদের স্বামী, তাদের সন্তান-সন্ততি, তাদের এম্পলয়ার ও সাপ্লাইয়ার সকলের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে ১৯৭০ থেকে ২০০০ হাজার সাল পর্যন্ত মহিলা দর্জিদের কাজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। দর্জি পেশায় নিয়োজিত নারীদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। তাদের সন্তানরাও সে সময়কার একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন।
১৯৭০ থেকে ২০০০ হাজার সাল পর্যন্ত সময়কালে বিশেষ করে সিলেট এর গ্রাম অঞ্চল থেকে আসা গৃহবধুদের জীবন ছিল সহজ সরল, তাদের সকলের জীবনের রয়েছে একেক রকম গল্প। সিলেটের পল্লীগ্রামের সহজ সরল এই নারীরা যারা ৭০ এবং ৮০-এর দশকে স্বামীর সাথে লণ্ডনে এসেছিলেন তাদের না জানা ছিল ইংরেজী ভাষা, তীব্র ঠাণ্ডার সাথে লড়াই করার কোনো মানসিক প্রস্তুতিও তাদের ছিল না। তখনকার দিনে বর্নবাদি আক্রমনের প্রকোপ এতই বেশী ছিল যে, ঘরের ভেতরও সব সময় আতংকের মধ্যে থাকতে হত। এ ছাড়াও আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিল না। শুধুমাত্র স্বামীর উপার্জনে সংসার চালানো সম্ভব ছিল না। তাই বাড়তি উপার্জনের লক্ষ্যে গার্মেন্টস শিল্পে পোষাক সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন নারীরা।
মহিলাদের দৈনন্দিন সাংসারিক কাজ যেমন রান্নাবান্না, ছেলে মেয়েদের স্কুলে দেয়া ও আনার কাজটাও করতে হত। বাজার করা, ছেলেমেয়েকে আরবী পড়তে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কাজ তো করতেই হত। ডিনার শেষে রাতে না ঘুমিয়ে প্রায় ভোর পর্যন্ত মহিলা দর্জি সিমস্ট্রেসরা সেলাই মেশিনে পোষাক সেলাইয়ের কাজ করতেন। পোষাক সেলাইয়ের কাজের প্রকার ভেদে সপ্তাহে ১৫ থেকে ২০ পাউণ্ড তারা উপার্জন করতে পারতেন। কোনো কোনো সময় বেশী কাজ করলে ৩০ থেকে ৫০ পাউণ্ড আয় করতে পারতেন কেউ কেউ। তবে এদের সংখ্যা খুব বেশী ছিল না।
ইস্ট লণ্ডনের ব্রিকলেইনের আশে পাশেই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো গড়ে উঠেছিল। এসব ফ্যাক্টরির মালিকানা ছিল ইহুদি এবং গ্রীকদের হাতে। ফ্যাক্টরি থেকে বড় বড় বস্তা দিয়ে ঘরে ঘরে কাটা পোষাকের কাপড়, ভেতরের লাইনিং, বোতাম ইত্যাদি পৌছে দেয়া হত। সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হত, সেলাই করা পোষাক নেয়ার সময় হাতে সপ্তাহের বেতনের ছোট্ট ব্রাউন এনভেলপ বা প্যাকেট ধরিয়ে দেয়া হত। উপার্জনের অর্থ পাওয়ার পর স্বস্তিতে মন ভরে যেত, গ্রাম থেকে আসা এসব গৃহবধুরা সেলাই কাজে খুব দক্ষ ছিলেন এ কথা বলা যাবে না তবে কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই লণ্ডনের বড় বড় ব্রাণ্ড ও লেবেলের কাজ তারা করে দিয়েছেন। তাদের উপার্জনের অর্থ নিজেদের সংসারের কাজে লাগানো হত। একটি অংশ দেশে পাঠানো হত বর্ধিত পরিবারের ভরণ পোষণের জন্যে। ঐ সময় বৃহত্তর সিলেটের লণ্ডনী অধ্যুষিত থানাগুলোর এখন উপজেলার গ্রামগুলোর লণ্ডনী বাড়ীতে পুকুর খনন ও দালান নির্মাণের পেছনে যে অর্থ খরচ হয় তার অংশ ছিল এই নারী দর্জিদের উপার্জনের অর্থের একটি বিরাট অংশ। তখন জমি জমাও কেনা হত লণ্ডন থেকে পাঠানো অর্থে, মহিলা দর্জিদের উপার্জিত অর্থের অংশও এতে জড়িত ছিল। বৃহত্তর সিলেটের গ্রামীণ ঘরবাড়ির চিত্র পরিবর্তনে এ যেন ছিল এক নীরব বিপ্লব। আর এই বিপ্লবে যারা অংশ নিয়েছিলেন তারা ছিলেন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সহজ সরল পল্লীবালিকারা, যারা গৃহবধু হয়ে বিলেতে স্বামীর সংসারে এসেছিলেন।
সিলেটের গ্রাম থেকে ৭০ দশকে যারা এসেছিলেন সেসব মহিলাদের জন্যে লণ্ডনের ঠাণ্ডা আবহাওয়া ছিল অসহ্য। থাকার জায়গাও ছিল ছোট। মাসের পর মাস কালো মেঘে ঢাকা থাকত আকাশ। এখনকার মত ঘরের ভেতর বাথরুম বা টয়লেট ছিল না। টয়লেট ছিল ঘরের বাইরে আর পুরুষরা পাবলিক বাথ এ গিয়ে গোসল সেরে আসতেন। ধীরে ধীরে পরিবেশের উন্নতি হতে লাগলো, কেরোসিন, কয়লা, গ্যাস ও প্যারাফিনের হিটারের পরিবর্তে সেন্ট্রাল হিটিং বেশ পরে লাগানো হয়েছে।
বাংলাদেশী কমিউনিটিতে অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে এবং ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে মহিলাদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এখনকার অবস্থার সাথে ৭০ বা ৮০ দশকের অবস্থার কোন তুলনাই করা যাবে না কারন তখন গ্রাম থেকে আসা মহিলাদের ইংরেজী ভাষা জানার কোন সুযোগই ছিলোনা। ১৯৮৬ সালে ব্রিটিশ হোম অফিস সিলেক্ট কমিটি ‘বাংলাদেশীজ ইন ব্রিটেনে’ শিরোনামে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে এই রিপোর্টে সুপারিশ করা হয় বাংলাদেশীদের ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দিতে হবে। হাউজিং, হেলথ, এম্পলয়মেন্ট এবং এডুকেশনের ব্যাপারে করণীয় কী এ ব্যাপারেও সুপারিশ করা হয়েছিল। এই রিপোর্ট প্রকাশের ৩৬ বছর চলে গেছে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার বা কাউন্সিল কি কি সুপারিশ বাস্তবায়ন করেছে তা জানা যায়নি। ব্রিটেনে এখন শতাধিক কাউন্সিলার এবং রাজকীয় খেতাবপ্রাপ্ত ওবিই, এমবিই ও মেয়র রয়েছেন। আছেন চার জন বাঙালী এমপি। হোম অফিস সিলেক্ট কমিটির সুপারিশ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে এগুলো ফলোআপ করার কোন দায়িত্ব কি তাদের নেই?
ফ্রম সিলেট টু স্পিটালফিল্ডস: বাসস্থানের জন্যে কাউন্সিল ফ্লাট দখলের লড়াই
১৯৭০ সালের দিকে পূর্ব লণ্ডনের স্পিটালফিল্ডস এলাকায় কিছু সাহসী বাঙালি নিজেদের বাসস্থানের অধিকার আদায়ের জন্যে কাউন্সিলের খালি পড়ে থাকা ফ্লাট দখল করা শুরু করেন। কাউন্সিল ফ্লাট দখল করা খুব সহজ কাজ ছিল না। কারণ তখন বাঙালিরা এক বৈরি পরিস্থিতিতে বসবাস করতেন। ঘরে বাইরে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদি গুণ্ডাদের অত্যাচার নির্যাতনতো ছিলই, পাশাপাশি ছিল কাউন্সিল ও পুলিশের আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা। তারপরও পূর্বলণ্ডনের বেথনালগ্রীন, শেডওয়েল, স্পিটালফিল্ডস ও স্টেপনি এলাকায় গৃহহীন বা হোমলেস বাঙালীরা কাউন্সিলের খালি ফ্লাটগুলো দখল করেন। ৭০ থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত এই স্কোয়াটিং বা দখল পর্ব চলে। যার ফলশ্রুতিতে টাওয়ার হ্যামলেটসে অন্তত হাজার তিনেক সিলেট থেকে আসা বাঙালী তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা নিজেরাই করে ফেলেছিলেন। টাওয়ার হ্যামলেটসে বা পূর্ব লণ্ডনে বাঙালীদের বাসস্থানের অধিকার আদায়ের এই সংগ্রাম নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন শাবনা বেগম। গবেষক শাবনা বেগম নিজেও একজন স্কোয়াটার পরিবারের সন্তান।
শাবনা বেগমের এই গবেষণামূলক তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বর্ণবাদি মানসিকতার বশবর্তী লকেল কাউন্সিল বৃহত্তর ৬০ ও ৭০ দশকে সিলেট থেকে বৈধ ভাবে আসা বাঙালিদের বাসস্থানের কোন ব্যবস্থা করতেই রাজী ছিল না। পরিবার পরিজন নিয়ে গৃহহীন বা হোমলেস বাঙালীরা তখন বাসস্থান সমস্যার সমাধানের ভার নিজেরাই নিয়েছিলেন। ৭০ দশকে কাউন্সিল ফ্লাট দখলের তাদের এই র্যাডিক্যাল পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বাঙালীরা স্পিটালফি?স এলাকায় তাদের নিজেদের বসতি স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলো।
সংখ্যালঘু শ্রমজীবী মানুষের এই সংগ্রামী ভূমিকা লণ্ডনের বা ব্রিটেনের আর্থ সামাজিক ও রাজনীতিতে পরবর্তীকালে ভূমিকা দৃশ্যমান ভূমিকা রেখেছে। এই এলাকায় বাঙালী মিলিওনার, কুটনীতিক, ও পেশাজীবীদের ও জন্ম হয়েছে।
গবেষক শাবনা বেগম তার গ্রন্থে বেশ কিছু স্কোয়াটারদের সাক্ষ্কাার গ্রহন করেছেন এই সাক্ষাৎকার থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা জানা যায় গৃহহীন বা হোমলেস স্কোয়াটার বা ফ্লাট দখলকারীদের সংখ্যা যখন বাড়তে থাকলো তখন তাদের একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল এই সংগঠনটির নাম ছিল বেঙ্গলি হাউজিং এ্যাকশন গ্রæপ। ফ্লাট দখলকারীদের যখন কাউন্সিল উচ্ছেদ নোটিশ দিতো তখন পুলিশী পদক্ষেপ ও নেয়া হতো, মামলা কোর্ট পর্যন্ত গড়াতো। হোমলেস বা গৃহহীনদের তখন আইনি সহায়তা দেয়ার জন্যে বেঙ্গলি হাউজিং এ্যাকশন গ্রæপের স্টাফরা হোমলেসদের পাশে দাঁড়াতেন।
টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিল ফ্লাট দখল বা স্কোয়াটার মুভমেন্ট বামপন্থীদের নজরে আসে তারা রেইস টুডে নামে একটি ক্ষুদ্র সংগঠনের মাধ্যমে গৃহহীনদের সংগ্রামের পাশে এসে দাড়ায়। বিখ্যাত লেখক ফারুক ধুন্ধী ও তার প্রয়াত স্ত্রী মালা সেন, টিভি প্রেজেন্টার ডারকাস হাও-এর মত বিখ্যাত ব্যাক্তিরা এই আন্দোলনে বাঙালী শ্রমজীবী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন একটিভিস্ট হিসাবে। স্থানীয় বাসিন্দা টেরি ফিটজপ্যাট্রিক, মি: খসরু, মি: আব্দুল কাদির ও তার স্ত্রী সুফিয়া স্কোয়াটিং বা ফ্লাট দখলে অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছিলেন। পরে অন্যান্য বাঙালীরা এই ধারা অনুসরণ করেন। এই ধারায় যারা অংশ নেন সেসব গৃহহীন বা হোমলেসদের নাম কাউন্সিলের হাউজিং এর ওয়েটিং লিস্টে থাকলেও ফ্লাট পাওয়ার কোন সম্ভাবনা তাদের ছিল না। কাউন্সিলের বিদ্বেষষমূলক উদাসীনতা ও বর্ণবাদি আচরণ এর জন্যে দায়ী ছিল বলে দাবী করা হয়েছে।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কিছু সাহসী মানুষ কাউন্সিল ফ্লাট দখল না করলে তাঁরা বাসস্থান পেতেন না বলে দখলকারীর দাবী। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, ১৯৮৬ সালে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় আসার পর হাউজিং নীতি আরো কঠোর করে, হোমলেসদের হোটেলে রাখা হয়। বাঙালীরা যেসব ফ্লাটে বসবাস করতেন সে সব ফ্লাটে ওভারক্রাউডিং ছিল । ১৯৮৬ সালে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির ফোকাস টিম ছিল কাউন্সিলের ক্ষমতায়। এই গ্রুপের নেতা সাবেক কাউন্সিল লীডার জেরেমি শো-এর আমলে বাঙালী হোমলেসদের টেমস নদীতে জাহাজে রাখারও পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরে বাঙালীদের আন্দোলনের মুখে তা বাতিল করতে হয়েছিল। এই লেখক (নজরুল ইসলাম বাসন) তখন সাপ্তাহিক সুরমায় কাজ করতেন তার চোখে দেখা এসব ঘটনা।
১৯৭০ সালের দিকে শুরু হওয়া কাউন্সিল ফ্লাট দখল বা স্কোয়াটার মুভমেন্টের ফলে পূর্ব লণ্ডনে শ্রমজীবী বাঙালিদের বসবাসের জন্যে একটি বসতি স্থাপন সম্ভবপর হয়েছিল। একই সময়ে সিমস্ট্রেস বা মহিলা দর্জিদের উপার্জনের ফলে এই এলাকার শ্রমজীবী সিলেটী বাঙালীরা কিছুটা অর্থনৈতিক মুক্তির আলো ও দেখতে পেয়েছিলেন। বাসস্থান এবং কর্মসংস্থানের ফলে বাঙালীরা তাদের সন্তান সন্ততিদের লেখাপড়ার দিকে ও নজর দিয়েছিলেন। বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের জন্যে শ্রমজীবী বাঙালীদের সংগ্রামের এই সময়কালে ১৯৭৮ সালের ৪ঠা মে বর্ণবাদীদের বর্বরোচিত হামলায় ছুরিকাঘাতে নিহত হন গার্মেন্টস শ্রমিক আলতাব আলী।
শহীদ আলতাব আলী: শ্রমজীবী বাঙালীদের রাজনীতির প্রেরণা
১৯৭৮ সালে (বর্তমান আলতাব আলী পার্ক) ৪ঠা মে সেন্টমেরিজ পার্কে গার্মেন্টস শ্রমিক আলতাব আলী বর্ণবাদী গুণ্ডাদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এই ঘটনা বাংলাদেশী কমিউনিটিকে আলোড়িত করেছিল। বিশেষ করে তরুণরা যারা স্কুলে বর্ণবাদীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছিল এবং যারা রাস্তাঘাটে হরহামেশা বর্ণবাদী ন্যাশনেল ফ্রন্টের ন্যাড়া মাথা গুণ্ডাদের হাতে নির্যাতিত হতেন তারা প্রতিবাদমুখর হলেন। আলতাব আলীর কফিন নিয়ে টেন ডাউনিং স্ট্রীটে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে স্মারকলিপি দিয়ে আসা হল। ব্রিটেনের বর্ণবাদী বিরোধী সংগঠনগুলোর নজর এই আন্দোলনের দিকে পড়ে। তারাও এসে শ্রমজীবী বাঙালীদের পাশে এসে দাঁড়ায়।
বর্ণবাদ বিরোধী সংগঠন ও ব্যক্তিরা যখন বাংলাদেশী যুবকদের পাশে এসে দাঁড়ালেন তখন এই এলাকার যুবকরা সংগঠিত হতে থাকলেন। বো ও বেথনালগ্রীন এলাকার এমপি ছিলেন প্রয়াত পিটার শোর, আর পপলারের এমপি ছিলেন মিলড্রেড গর্ডন। কাউন্সিল ছিল লেবার গ্রুপের নেতৃত্বে। ১৯৮২ সালে লেবার পার্টি থেকে নমিনেশন চেয়ে কমিউনিটি শিক্ষক নুরুল হক মনোনয়ন পাননি। পরে তিনি স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে পাশ করেন। ১৯৮৬ সালে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও লেবার পার্টি বেশ কিছু বাঙালিকে নমিনেশন দেয়। বেশ কিছু বাঙালি কাউন্সিলার তখন নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ সালে ৮ বছর ক্ষমতায় থেকে লিবডেম ফোকাস টিম ক্ষমতা হারায়। ১৯৯৪ সালে লেবার গ্রæপ ক্ষমতায় আসে, ২০১০ সাল পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় ছিলেন।
২০১০ সালে প্রথম এক্সিকিউটিভ মেয়র পদ্ধতি চালু হয়। কাউন্সিল লীডার লুতফুর রহমান লেবার পার্টির প্রার্থী মনোনীত হলেও তাকে অন্যায্যভাবে বাদ দিয়ে নির্বাচনের মাত্র একমাস আগে সাবেক কাউন্সিল লীডার হেলাল আব্বাসকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
কাউন্সিল লীডার লুতফুর টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট দলের ব্যানারে প্রথম নির্বাহী মেয়র হিসাবে বিপুল ভোটে বেশ কজন কাউন্সিলারসহ বিজয়ী হন।
লেবার পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাখাত লুতফুর রহমান ২০১৪ সালে সাবেক কাউন্সিল লীডার জন বিগসকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে কাউন্সিলারসহ প্রথম নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হবার পর লুতফুর কাউন্সিল পরিচালনার নিরংকুশ ক্ষমতা অর্জন করেন। তার এই বিজয়ের পর পরই মুলস্রোতের কিছু প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী এরিক পিকল, মেয়র লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ আনতে থাকে। মন্ত্রী এরিক পিকল একধাপ এগিয়ে কাউন্সিলের প্রশাসন তদারকির জন্যে তিনজন প্রশাসক নিয়োগ করেন। বিবিসির জন ওয়্যার নির্মাণ করেন প্যানোরমা। এতে অভিযোগ আনা হয়, মেয়র লুতফুর ২ মিলিয়ন পাউণ্ড বাঙালি ও সোমালি কমিউনিটির জন্যে ব্যয় করেছেন তাঁর নিজের স্বার্থে। এই অভিযোগকে প্রাধান্য দেন সেক্রেটারি অফ স্টেইট এরিক পিকল তার ক্ষমতাবলে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে তিনজন কমিশনার নিয়োগ দেন। মূলস্রোতের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া কাউন্সিলের উপর লাগাতার নিউজ করতে থাকে, এর অব্যবহিত পর পরই তিনজন লোক মেয়র লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। নির্বাচনী মামলার ট্রাইবুনালের বিচারক রিচার্ড মাওরি তাঁর রায়ে মেয়র লুতফুর রহমানকে মেয়য় পদ থেকে অপসারিত করে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য?তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না মর্মে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন।
নিষিদ্ধ লুতফুর রহমান ছাড়া ২০১৫ সালে জন বিগস মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হন, লুতফুরবিহীন ২০১৮ সালের কাউন্সিল নির্বাচনে তিনি পুন:নির্বাচিত হন। দুইবারই তাঁর বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন সাবেক কাউন্সিলার রাবিনা খান। তখন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ক্ষমতার করিডোরে নিষিদ্ধ ছিলেন লুতফুর রহমান।
২০২২ সালের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল নির্বাচনে নিষিদ্ধ রাজনীতিবিদ লুতফুর রহমান সংখ্যাগরিস্ট কাউন্সিলারসহ আবার সগৌরবে পুন:নির্বাচিত হলেন। ব্রিটেনের রাজনীতির সাহিত্যে তাঁর এই ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন সংযোজিত হয়ে গেল।
টাওয়ার হ্যামলেটসে সিমস্ট্রেস ও স্কোয়ার্টিং আন্দোলন দুই এমপি ও নিষিদ্ধ লুতফুরের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন
টাওয়ার হ্যামলেটসের শ্রমজীবী বাঙালিদের অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণে নারী দর্জিরা বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন, প্রায় একই সময়ে কাউন্সিল ফ্লাট দখল করে বসবাস করার উদ্যোগ নেয়ায় সিলেট থেকে আসা বাংলাদেশীদের পূর্ব লণ্ডনে একটি শক্তিশালি কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। এই একক কমিউনিটির শক্তিশালি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে টাওয়ার হ্যামলেটসে দুজন বাঙালি রুশনারা আলি ও আপসানা বেগম এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন লুতফুর রহমান।
লণ্ডন সিটি বিশ্বের একটি মিটিং পয়েন্ট আর এই মিটিং পয়েন্টের অর্থনৈতিক রাজধানি ক্যানারি ওয়ার্ফ ও লিভারপুল স্ট্রীটের ব্যাংক অফ ইংল্যাণ্ডের পাশে অবস্থিত টাওয়ার হ্যামলেটসের এমপি ও মেয়র বাঙালি। বাংলাদেশ থেকে আসা সিলেটী সংখ্যালঘু গৃহহীন বাঙালী শ্রমজীবী মানুষের উত্থান বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে।
(পাদটীকা: লণ্ডন থেকে পোষাক শিল্প তুরস্ক, ভারত, বাংলাদেশে আউটসোর্সিং হয়ে যাওয়ার ফলে বাঙালি নারী ও পুরুষ গার্মেন্টস কর্মীরা ব্যাপক হারে বেকার হয়ে পড়েন। সামান্য সংখ্যক পুরুষ মিনিক্যাব, রেস্টুরেন্ট ও গ্রোসারী শপে কাজ ধরলেও নারী দর্জিদের জন্যে কোন কাজের ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার থেকে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।)
লণ্ডন, ২৬শে মে ২০২৩
লেখক: সাবেক মিডিয়া এণ্ড পাবলিক রিলেশন্স অফিসার, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল, লণ্ডন