।। পত্রিকা প্রতিবেদন।।
লণ্ডন, ০৬ জুন: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবিক গুণসম্পন্ন একজন অসাম্প্রদায়িক মহান কবি ছিলেন। তিনি বাঙালির আলোকবর্তিকা হিসাবে আজীবন সৃষ্টি করে গেছেন বহুমাত্রিক ও অসাধারণ সাহিত্য। ছিলেন বাঙালির জাগরণ ও প্রগতির দূত। কবিকণ্ঠ আয়োজিত লেখক আলমগীর শাহরিয়ারের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থ নিয়ে আলোচনায় সুধীজন এসব মন্তব্য করেন।
গত ৩১ মে বিকালে কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব হাবিব রহমানের সভাপতিত্বে ও কবি হামিদ মোহাম্মদের সঞ্চালনায় সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটেনের কবি, লেখক এবং কমিউনিটির গুণীজন। অনুষ্ঠানের শুরুতে পরিচয় পর্বের লেখক আলমগীর শাহরিয়ারের লিখিত পরিচিতি পাঠ করে শোনান সংস্কৃতিকর্মী এম এস নওয়াজ। ‘রবীন্দ্রনাথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থ নিয়ে লিখিত আলোচনা উপস্থাপন করেন কবি হামিদ মোহাম্মদ। নিবন্ধের বিশদ আলোচনায় উঠে আসে কবি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নানা তথ্য। যারা বই পাঠ করেননি, তাদের জন্য ছিল এ নিবন্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
হামিদ মোহাম্মদের নিবন্ধ পাঠের পর আলমগীর শাহরিয়ার গ্রন্থটি লেখার পটভূমিসহ তার গবেষণালদ্ধ তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে প্রাঞ্জল বক্তব্য রাখেন। এরপর আলোচনায় অংশ নেন কমিউনিটি একটিভিস্ট আয়ূব করম আলী।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে তিনি বিরোধিতা করেননি এটা সত্য, কি আমাদের জানামতে- যারা বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, তাদের বারণ করেনি বা তিনি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে কোনো লেখালেখি করেননি এবং কোনো বিবৃতি প্রদান করেননি। তিনি জানতে চান, আলমগীর শাহরিয়ার তাঁর অনুসন্ধানে এর উত্তর খুঁজে পেয়েছেন কিনা।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ এনামুল ইসলাম তার আলোচনায় বলেন, আমি বইটি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবি রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেননি, এ বিষয়ে আমার পরিষ্কার ধারণা রয়েছে। তিনি যে একজন অসাম্প্রদায়িক মহান কবি এ বিষয়ে আমার কোনো দ্ব›দ্ব নেই। তবে আলমগীর শাহরিয়ারের বই পড়ে আমার উপলব্ধি হচ্ছে- আমাদের সমাজের মানুষ অনেক সময় অপপ্রচারকে বিশ্বাস করে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েন। তাদের জন্য এই গ্রন্থ খুবই উপকারি।
তিনি আরো বলেন, আমার ভালো লেগেছে যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ১৬ বছর পর আলমগীর শাহরিয়ারের জন্ম। তাঁর এই গ্রন্থ পড়ে মনে হয়েছে, অনেক পরিপক্কতা রয়েছে তার মনন ও চিন্তারক্ষেত্রে। বয়সে তরুণ হলেও তার ইতিহাস অনুসন্ধান চমৎকার ও গভীর। বইয়ের ভাষাও অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী।
বিবিসির প্রথিতযশা সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁর বক্তব্যে জানতে চান- ‘আলমগীর শাহরিয়ার কেন মনে করলেন এমন একটি গ্রন্থ লেখা জরুরি।’ তিনি প্রশ্নোত্তর পর্বে বইটি লেখার পটভূমি জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন প্রতিষ্ঠিত অনেক সত্যকেও আমরা আজকাল প্রশ্নবিদ্ধ করছি।
সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন বলেন, বইটি পড়িনি তবে পড়ার আগ্রহ রয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথকে যারা খণ্ডিত করতে নিরন্তর কাজ করছেন, তাদেরকে আমরা চিনি। রবীন্দ্রনাথকে মুছে ফেলা যাবে না।
গবেষক ফারুক আহমদ বলেন, যে যা-ই মনে করুক, রবীন্দ্রনাথ হিন্দুধর্মীয় পরিচয় বহন না-করলেও তিনি যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতেন, তাকেই মানুষ সাম্প্রদায়িক লেবেল দিতে চেষ্টা করেছে।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন শিক্ষাবিদ মুহম্মদ আবদুর রাকীব, সঙ্গীতশিল্পী রীপা রাকীব, মানবাধিকার নেতা আনসার আহমদউল্লাহ, সত্যব্রত দাশ স্বপন, কবি ময়নূর রহমান বাবুল, দর্পণ সম্পাদক রহমত আলী, কবি আসমা মতিন ও কবি ফয়জুর রহমান ফয়েজ। উপস্থিত ছিলেন কবি এ কে এম আবদুল্লাহ, কবি মো. মোশাইদ খান, সুশান্দ দাস প্রশান্ত জাহাঙ্গীর আলম, এম এস নাওয়াজ, এরশাদ আহমদ, কবি আবদুল কাইয়ূম ও তৌহিদ রাহী প্রমুখ।
বইয়ের লেখক আলমগীর শাহরিয়ার তাঁর বক্তব্যে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন, অতীতে কেউ রবীন্দ্রনাথকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাবিরোধী বলেননি, ১৯৭৬ সালে একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী প্রথমে জাতীয় সঙ্গীতের বিরোধিতা করে। এরপর একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এম এ মতিন যিনি তত্ত্বা বধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাবিরোধী ছিলেন। মূলত তাদের উদ্দেশ্য হলো রবীন্দ্রনাথকে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাবিরোধী বানিয়ে ফেলা যায়, তাহলে রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জন করার মিশন সফল হয়। রবীন্দ্রনাথকে খণ্ডিত করার এই অপচেষ্টার জবাব দেয়ার আগ্রহই আমাকে এ বইটি লেখা ও গবেষণায় অনুপ্রাণিত করেছে।