।। হামিদ মোহাম্মদ ।।
ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল সময়ের দাবী। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ নতুন প্রদেশ প্রতিষ্ঠা ছিল বঞ্চিত পূর্ববঙ্গবাসীর জন্য আশা জাগানিয়া। ঢাকা পূর্ববঙ্গের রাজধানীর মর্যাদালাভ এবং এ অঞ্চলের নয়া উন্নয়ন পদক্ষেপ এর অর্ন্তনিহিত কর্মপ্রয়াস পূর্ববঙ্গবাসীকে উদ্দীপ্ত করে। তবে ঐক্যবদ্ধ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী বিভক্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। এর পেছনেও কারণ ছিল অনেক। এতে খণ্ডিত বঙ্গে মাড়োয়ারী ও দক্ষিণভারতীয় বেনিয়া সম্প্রদায়ের পুষ্টিসাধন স্বভাবতই ইংরেজ উপনিবেশের ছায়াতলে লালিত ও বর্ধিত হয়ে আসা আরো শক্তিশালী হওয়ার দ্বার বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ তৈরী হয়। বঙ্গভঙ্গে পূর্ববঙ্গের অগ্রগতির পথ রচিত হলেও পুঁজির বিকাশে দুই বঙ্গই কর্তিত দেহ নিয়ে হামাগুড়ি দেওয়ার পর্যায়ে পতিত হয়। যদিও এর আগে ১৮৭৪ সালে পূর্ববঙ্গের সিলেট অঞ্চল আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে বাংলাকে পঙ্গু করা হয়েছিল। ১৯০৫ সালে বাংলাকে দুই ভাগ করে উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে একে নিশ্চিত করার মাড়োয়ারী দাবার গুটির খেলা চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু এ খেলায় পূর্ববঙ্গবাসীর জন্য ছিল নতুন বার্তা। স্বভাবতই পূর্ববঙ্গ ছিল বঞ্চিত, সে বঞ্চিতরাই এতে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাওয়া ও শিক্ষাদীক্ষাসহ অর্থনৈতিক সুবিধাভোগের সুর্যোদয় হয়।
১৮৭২ সালে বাংলায় প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলার পূর্বাঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা ৫০ শতাংশ উঠে আসে। এরআগে এ বিষয়টিকে খুব একটা আমল দেয়া হতো না, মনে করা হতো বাংলা পুরোটাই হিন্দু অধ্যুষিত। এদিকে, উপনিবেশী ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা, সে সুবাদে ঢাকা-্ ি কলকাতা বা বাংলার পশ্চিমাঞ্চল পুষ্টিলাভ করে। পূর্বাঞ্চল অবহেলায় পড়া একধরণের স্বতসিদ্ধ ছিল। কেউই পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতোই না। এমনকি এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন যে প্রয়োজন তাও ভাবনার বাইরেই ছিল। এই অবস্থায় বঙ্গভঙ্গ ছিল পূর্ববঙ্গের অবহেলিত মানুষের জন্য আর্শিবাদ। যদিও বাংলার রাজধানী ঢাকা- হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু চতুর ব্রিটিশরাজ বাণিজ্য,সম্পদ পাচার এবং আত্মরক্ষার জন্য সমুদ্রসংলগ্ন এলাকায় নতুন নগর পত্তন করাসহ পরবর্তীতে উপমহাদেশীয় রাজধানীর গোড়াপত্তন করে নতুন গড়ে ওঠা কলকাতায়।
তবে কেন বঙ্গভঙ্গ রদ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল পশ্চিম বঙ্গের মানুষ এবং খোদ কবি রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলেন। সেই সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ও।
পূর্বেই ইঙ্গিত দিয়েছি, দক্ষিণভারতীয় মাড়োয়ারী বেনিয়া আধিপত্য বৃদ্ধি ছিল খণ্ডিত বাংলায় সহজ। এছাড়া উপনিবেশিক শাসনের রাজধানী কলকাতার রাজধানির মর্যাদা হারানোর আশংকা তৈরী হয়েছিল। এক ভাষাভাষী ও এক জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা একটা জাতিকে বিলুপ্ত করার রাজনৈতিক চালও মনে করা হয়েছিল।
তাই, ঐক্যবদ্ধ বাংলাকে রক্ষা করা ছিল তখনকার সময়ের চিন্তকদের সুদুরপ্রসারী অভিপ্রায়। আমরা এও জানি, সিলেটজেলা প্রায় ৭৩ বছর আসামের অর্ন্তভুক্ত থাকায় সিলেট অঞ্চলের মানুষকে আসামী বলা হয়। এবং সিলেটের মানুষ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষকে ‘বেঙ্গলী’ বলে উল্লেখ করে থাকেন। দীর্ঘদিনে সিলেট অঞ্চলের মানুষের ভাষায় আসামী ভাষার প্রভাবও পড়েছে। হয়তো আরো দীর্ঘকাল অতিবাহিত হলে সিলেট অঞ্চলের ভাষা আসামী হয়ে যেতো। আমরা এও জানি, আসামে বাঙালিরা বাংলাভাষাকে রক্ষার জন্য লড়াই করে আসছে, শিলচরে ১১ জন বাঙালি বাংলা ভাষা রক্ষায় পুলিশের গুলিতে ১৯৬১ সালে শহীদ হন। সিলেট অঞ্চল আসামের অন্তর্ভূক্ত থেকে গেলে সিলেটের মানুষের কী দশা হতো, তা কল্পনাতীত। সুতরাং কোনো জাতি, কোনো অঞ্চলকে খণ্ডিত করার উদ্দেশ্য কারোর জন্য ভালো হলেও, বড় অর্থে ক্ষতিই বলতে হবে। যার প্রমাণ, ১৯৪৭ সালে বাংলা দুই ভাগ হয়ে একটি পূর্ববঙ্গ এবং অন্যটি পশ্চিমবঙ্গ হওয়ার ইতিহাস। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়ে শোষণের জালে আবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর পশ্চিমবঙ্গ বিশাল ভারতের পেটে পড়ে ধুকছে। একই রকম পাঞ্জাবের ভাগ্যে ঘটেছে, পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাব দুই দেশের ভেতর খণ্ডিত হয়ে হা-হুতাশ করছে।
বিশ্বে এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন জার্মান, কোরিয়া। জার্মান ভাগ হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে। আর ১৯৬৫ সালের কোরিয়া দুই পরাশক্তির কূটচাল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে এখন দুইভাগে বিভক্ত বিভেদমান দুইটি রাষ্ট্র। তবে জার্মান বর্তমানে একত্রিত হয়ে নিজস্বতা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটকে উন্মোচিত করে রবীন্দ্রনাথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও উমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থ রচিত। তরুণ লেখক আলমগীর শাহরিয়ার নানা তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখাতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ কতটুকু সাম্প্রদায়িক ছিলেন বা ছিলেন না, তা।
আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের পরিবারের জমিদারীর বিশাল অঞ্চল ছিল পূর্ববঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশে শাজাদপুর, শিয়ালদহ ও পতিসরে। তাঁর জমিদারীর অর্ন্তভুক্ত জনগণ ছিলেন সর্বাধিক সংখ্যক মুসলমান। তিনি এ অঞ্চলের দরিদ্র মুসলমান কৃষকশ্রেণীর জীবনমান উন্নয়নে কৃষির আধুনিকায়ন, কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠাসহ সমবায় পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন, এটা কল্পনা নয়, বাস্তব ইতিহাস। তিনি মুসলমান বিদ্বেষী হলে কী করে মুসলমানদের ভাগ্যোন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেন, সেটা রবীন্দ্র বিরোধীরা তো বলেন না।
ঐক্যবদ্ধ বাংলার জন্য বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতাকে পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতার অংশ বলে চালিয়ে দেওয়ার হীনমন্যতাকেই আলমগীর শাহরিয়ার খণ্ডন করেছেন তার লেখায়।
তিনি তথ্য সংগ্রহ করে লিখেছেন, বরং পূর্ববঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছেন। কিছু হিন্দু গোষ্ঠীর সাথে তারা ছিলেন সোচ্চার, মিটিংকরা ও বিবৃতি প্রদান এবং সরকারের উচ্চমহলের সাথে প্রতিবাদী লেখালেখিও করেছেন এরা। তাদের নাম ইতিহাসের প্রয়োজনে উল্লেখ থাকা জরুরি। বিরোধিতাকারীরা হলেন ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মওলানা আকরম খা, মৌলবী আবুল কাসেম, মৌলবী লিয়াকত হোসেন প্রমুখ। তাদের যুক্তি ও আশংকা ছিল ঢাকায় বিশ্ববদ্যিালয় প্রতিষ্ঠিত হলে উত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাবে। কত অপরিণামদর্র্শী বালকসূলভ চিন্তা এটি, মনে করলেই হাসি পায়। নিজের পায়ে কুড়াল মারার সামিল।
এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর ১৯২৬ সালে আমন্ত্রিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, পরিবারের অনেক সদস্য সাথী হন তার। সংবর্ধিত হন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হিন্দু মুসলিম পরিচয়ে নয়, বিশ্বকবি পরিচয়ে। সংবর্ধনা দেন সব সম্প্রদায়ের উদ্যোগে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্যরা প্রথম কাতারে। রবীন্দ্রনাথ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করে থাকেন, তাহলে মুসলমানরা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন কিভাবে? অন্তত সামান্য প্রতিবাদটুকুও কেউ করেনি কেন সেদিন? এছাড়া রবীন্দ্রনাথের হিন্দু পরিচয়ও ছিল না, তিনি এবং তাঁর পরিবার ব্রম্মধর্মী একেশ্বরবাদী ছিলেন, হিন্দুধর্মের বহুপৌত্তলিকতা বিরোধী একজন সোচ্চার দার্শনিক কবি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রথম দাবী উত্থাপন করেন ১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘মোহমেডান এডুকেশন কনফারেন্স’-এ ২৭-২৯ ডিসেম্বর সংগঠনের অনারারী জয়েন্ট সেক্রেটারি ব্যারিস্টার আফতাব আহমদ খা। এর ৬ বছর পর ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আসে সরকারের তরফ থেকে। ঘোষণার ১২ বছর পর ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইনসভায় ‘দি ঢাকা ইউনির্ভাসিটি এ্যাক্ট ১৯২০’ পাস হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন লর্ড হার্ডিজ। প্রথম উপাচার্য ছিলেন পিজে হার্টগ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ের উপচার্য স্যার আশুতোষ চট্টোপাধ্যায় বিরোধিতা করেছিলেন এই বলে, যে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর মত শিক্ষক নেই, শিক্ষক নিতে হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সুতরাং ক্ষতি হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ যুক্তি ফেলে দেয়ার নয়, এজন কি বিশ্ববিদ্যালয় হবে না? তার এ যুক্তি ধোপে টেকেনি।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে লর্ড হার্ডিজের যুক্তি ছিল, পূর্ববঙ্গের যে ক্ষতি হয়েছে, তা এই পশ্চদাপদ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তা পুষিয়ে নেয়া। পূর্বাঞ্চলের মানুষ উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে- এই ছিল তার ও পূর্ববঙ্গের মানুষের উদ্দেশ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর নবজাগরণ ঘটেছিল, তারই প্রমাণ। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় ও তা থেকে যে উচ্চশিক্ষিত এবং মননশীল, সচেতন ও স্বাধীন চিন্তকের একটি সম্প্রদায় তৈরী হয়, তারাই একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালিন উপাচার্য পিজে হার্টগ ঢাকা বলদা গার্ডেনে এক সংবর্ধনা সভায় বলেন, ‘এটি কোনও মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, এটি কোনও হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, …এটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সেই চেতনায় এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে, বিশেষ করে যতক্ষণ আমি এর সঙ্গে আছি।’ অতএব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি অসাম্প্রদায়িক বিশ্ববিদ্যালয়। আলমগীর শাহরিয়ারের আলোচনায় দেখা গেছে, ১৯৬১ সালে পাকিস্তানে যারা রবীন্দ্র বিরোধিতা করেছিলেন, তারা তাদের উত্তরসূরী। কারা তখন রবীন্দ্রবিরোধিতা করেছিলেন তা ইতিহাসের অংশ এখন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে এই মর্মে যে, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত বেতার ও টেলিভিশনে বাজানো যাবে না, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, তাঁর লেখা সাহিত্য পাকিস্তানের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী।
এ ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠেন। কিন্তু ৪০ জন বাঙালি লেখক, কবি, শিক্ষাবিদ, পাকিস্তানের এ ঘোষণায় সংহতি প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথের গান ও সাহিত্য মুসলমান ঐতিহ্যের পরিপন্থী বলে রবীন্দ্র বিরোধিতা করে বিবৃতি ও সভা সমাবেশ করেন। এরা হলেন, মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খা, মজিবুর রহমান খা, মোহাম্মদ মোদাব্বের, কবি আহসান হাবিব, কবি ফররুখ আহমদ, ড. কাজী দীন মোহাম্মদ, ড. হাসান জামান, ড. গোলাম সাকলায়েন, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, কবি বেনজির আহমদ, কবি খান মঈনউদ্দিন, অধ্যক্ষ শেখ শরফুদ্দিন, আ কা ম আদমউদ্দিন, কবি তালিম হোসেন, শাহেদ আলী, আ ন ম বজলুর রশীদ, মাহফুজুল্লাহ, সানাউল্লা নূরী, কবি আবদুস সাত্তার, শিল্প কাজী আবুল কাসেম, মুফাখখারুল ইসলাম, শামসুল হক, ওসমান গনি, মফিজ উদ্দিন আহমদ, আনিসুল হক চৌধুরী, মোস্তাফা কামাল, অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান, জহরুল হক, ফারুক মাহমুদ, মোহাম্মদ নাসির আলী, একে এম নূরুল ইসলাম, কবি জাহানারা আরজু, বেগম হোসনে আরা, বেগম মাফরুহা চৌধুরী, কাজী আবদুল অদুদ, আখতার-উল আলম।
এছাড়া সৈয়দ আলী আহসান, মুহম্মদ আকরম খা, কবি গোলাম মোস্তফা, কবি খান মঈনুদ্দিন, ফজলুল হক সেলবর্ষী, গোলাম আযম এ সময় আয়োজিত রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ উদযাপনকে পাকিস্তানের ঐক্য সংহতির পক্ষে হুমকি মনে করে বর্জন করলেন। তবে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রবিরোধিতার এতো ডামাঢোলের মাঝেও কেউ রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন, এমন বক্তব্য দেননি বা অভিযোগ তুলেননি।
এখন কারা এসব কথা বলছেন, তাদের একটু জেনে নিই। আলমগীর শাহরিয়ার নানা তথ্য সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে ৭ মার্চ জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে বর্জন করার দাবী উঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এক ইসলামী জলসায়। ১৯৭৮ সালে ইসলামী ঐক্যজোট থেকে নির্বাচিত এমপি মওলানা আবদুর রহিম জাতীয় সঙ্গীতের বিরোধিতা করেন। এ ধারা অব্যাহত থাকে এবং বিএনপির আমলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ, ড. হাসানুজ্জামান বিভিন্ন পর্যায়ে এই বিরোধিতা চালিয়ে যান। তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম ও মওলানা মান্নানের দৈনিক ইনকিলাব এর সমর্থনে বিভিন্ন রচনা প্রকাশ করে।
রবীন্দ্র বিরোধিতা চূড়ান্ত রূপ নেয় সংগ্রাম ও ইনকিলাবের ছায়াতলে। ২০০০ সালে একটি বই প্রকাশ করে আহমদ পাবলিশিং হাউস। বইটির নাম ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’। লেখক মেজর জেনারেল (অব) এম এ মতিন। (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।) তিনি লিখেন- ‘১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্ব্ েঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভায় আয়োজন করা হয়। এখানে বলা প্রয়োজন যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত ব্যক্তিত্বও সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।…’
একই রকম অভিযোগ দেখতে পাই বিতর্কিত পত্রিকা সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের ‘একশ বছরের রাজনীতি বইয়ে। তিনি লিখেন- ‘…ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেখানেও তিনি (রবীন্দ্রনাথ) হাজির, সভাপতিত্ব করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।
এসব অভিযোগের কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই মনগড়া তথ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার হীন উদ্দেশ্যে লিখিত এই লেখাসমূহ। আলমগীর শাহরিয়ার নানা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে এসব অপপ্রচার খণ্ডন করে লিখেছেন, ইতিহাসবিদ ও বরেণ্য গবেষকদের লেখা তার বইয়ের তথ্য ভাণ্ডারে সংযোজন করে। সত্য তথ্যটি হলো- ‘১৯১২ খ্রীস্টাব্দের ১৯ শে মার্চ ভোরে কলকাতা থেকে সিটি অব প্যারিস জাহাজে করে রবীন্দ্রনাথের ইংল্যান্ডে যাত্রার জন্য কেবিন ভাড়া করা হয়েছিল। তাঁর প্রয়োজনীয় মালপত্র জাহাজ ঊঠানো হয়েছিল।.. . কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় সফর বাতিল হয়। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থেও এ সময় কবির অসুস্থ হয়ে পড়ার বিশদ বিবরণ রয়েছে।’ সুস্থ হলে ২৪ মার্চ কবি শিলাইদহ চলে যান। ২৫ মার্চ কবি কাদম্বিনী ও ২৮ মার্চ জগদানন্দ রায়কে চিঠি লিখেন কবি। এগুলোর নথিপত্র সংরক্ষিত আছে। তাহলে কবি কিভাবে ২৮ মার্চের গড়ের মাঠের সভায় উপস্থিত থাকবেন? সুতরাং কথিত অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। কলকাতার গড়ের মাঠে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিরোধী সভায় রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেছেন বলে কথিত তথ্য সত্য নয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীদের মধ্যে অনেকেই কবির বন্ধু ছিলেন। বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই বিরোধীরা নানা গল্প বানিয়ে চালানোর চেষ্টা করে থাকেন বলে শাহরিয়ার তুলে ধরেছেন।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এম এ রহিমের ‘দি হিস্টরি অব দি ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা’ সরদার ফজলুল করিমের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা’, ড. রঙ্গলাল সেনের ‘বাংলাদশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,’ রফিকুল ইসলামের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ কিংবা ‘আশি বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’, ড. আবদুল্লাহর নবাব সলিমউল্লাহর জীবন ও কর্ম’, সৈয়দ আবুল মকসুদের বইয়ের মধ্যে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা, স্যার ফিলিপ হার্টজ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য’, সলিম উল্লাহ মুসলিম হল, কিংবা পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ- কোনো গ্রন্থেই কোনো উল্লেখ নেই। সৈয়দ মুজতবা আলীর স্মৃতিকথায়ও এমন তথ্য নেই। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ গ্রন্থ ‘শতরূপা’ স্মারক সংকলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতার কোনো তথ্য নেই। এ বইয়ে শতাধিক লেখকের রচনা রয়েছে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার, অধ্যাপক আবুল ফজল ও কবি জসিম উদ্দিনের জীবনস্মৃতি সম্বলিত নানা গ্রন্থ রয়েছে, এদের কোনো বইয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন বলে কোনো তথ্য নেই। বরং কবি যে একজন অসাম্প্রদায়িক এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন এই ধরনের গুনগানই লিপিবদ্ধ রয়েছে।
অথচ, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সংকটকালে মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়ে বহু প্রশংসাসূচক ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টির তাগিদ দিয়ে লেখালেখি করেছেন। বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমাজ-মানস বির্নিমাণের। আলমগীর শাহরিয়ার উদাহরণ দিয়ে মুসলমান হিতৈষী রবীন্দ্রনাথকে উন্মোচিত করেছেন।
আলমগীর শাহরিয়ার আরো কিছু প্রচলিত ‘মিথ’কে খণ্ডন করেছেন উল্লেখিত বইয়ে। আমরা জানি, ঢাকার নবাব পরিবার ‘স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’ ভূমিদান ও নির্মাণ করেছেন। কিন্তু তা সত্য নয়। ব্রিটিশরাজ প্রথম থেকেই একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে যে পরিকল্পনা করে, তার একটি অংশ হিসাবে মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুসলমি হল’ নামে হলটি নির্মাণ করে। পরবর্তীতে স্যার সলিমুল্লাহর নাম যুক্ত করা হয়।
আরো মিথ রয়েছে, স্যার সলিমুল্লাহ পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমি দান করেছেন। এ তথ্যটিও অসত্য। মূলত, ১৯৩৬ সালে ২৫৭.৭০ একর ভূমি ব্রিটিশরাজ দলিল সম্পাদন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান করেছেন, নবাব পরিবার নয়। এসব তথ্য রবীন্দ্র ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানপন্থীদের অপপ্রচার। অযথা, নবাব পরিবারকে সুনাম বাড়ানোর নামে, খাটো করার নামান্তর এমন তথ্য সংযোজন করে মিথ তৈরী করে ফেলেছে এরা। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নবাব পরিবারের প্রধান উদ্যোগী ভূমিকা যে ছিল, তা অবিস্মরণীয়। এ সম্পর্কে আলমগীর শাহরিয়ারের অন্য একটি লেখা রয়েছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দি ডেইলি ক্যাম্পাস’ নামে একটি পত্রিকায় ৯ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত একটি রচনায় তিনি তার উল্লেখ করেছেন। অতএব, একটি মীমাংসিত বিষয় হলো- কবি রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাবিরোধী ছিলেন না, বরং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বার বার সংবর্ধিত, ডিলিট ডিগ্রিপ্রাপ্ত এবং নন্দিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁর প্রাণের সম্পর্ক ছিল নিরবধি।
হৃদয়ে স্থান ছিল এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং বাংলাদেশের মানুষের। সবশেষে বলতে চাই, এসম্পর্কে প্রমাণাদি ও বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তরুণ লেখক আলমগীর শাহরিয়ার আমাদের চোখ, মন খুলে দিয়েছেন, আমরা কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে।