পত্রিকা ডেস্ক
লণ্ডন, ১২ জুন: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বাংলাদেশ সময় ৯ জুন শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ সূত্র জানায়, অসুস্থ সিরাজুল আলম খানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করার পর তাঁকে ১ জুন আইসিইউতে রাখা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার রাতে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়।
সিরাজুল আলম খানের জন্ম নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে, ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি। তাঁর বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী সিরাজুল আলম খান ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয় তাঁর উদ্যোগেই। সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে ছুটে যান জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান (মান্না), জনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক (নুর)।
সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমদের বই ‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’ প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘ষাটের দশকে সিরাজুল আলম খানের উত্থান ছাত্রনেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত ধরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াতলে। এ সময় আরও কয়েকজন ছাত্রনেতা মাঠ কাঁপিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের ফারাক এক জায়গায়-তিনি ধারাবাহিকভাবে লেগে ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, শেখ মুজিবের ছয় দফা তাঁর বুকের মধ্যে আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। উনসত্তরে মুজিব যখন জেল থেকে ছাড়া পান, দেখলেন তাঁর জন্য জমি তৈরি হয়ে আছে, যার ওপর ভরসা করে বীজ বোনা যায়। জমি তৈরির এই কাজটি করেছেন সিরাজুল আলম খান। শেখ মুজিবকে নেতা মেনেই তিনি এটা করেছেন।’ সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সিরাজুল আলম খান ষাটের দশকের সফল সংগঠক ছিলেন। তিনি আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ক্ষমতার সঙ্গে শামিল হননি। ক্ষমতায় থাকলে তাঁর বিত্তবৈভব হতে পারত। তিনি তা করেননি। তরুণদের সংগঠিত করেছিলেন।’
‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’ বইটিতেই সিরাজুল আলম খান তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা বলেছিলেন। সেটি হলো, ‘আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।’ সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এক শোকবার্তায় মির্জাফখরুল বলেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনালগ্নের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে আমরা শোকাভিভূত। তিনি আমাদের সত্ত্বার মাঝে অমর হয়ে থাকবেন।’ মায়ের কবরেই শেষ শয্যা সিরাজুল আলম খানকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে মায়ের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে। ১০ জুন শনিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আলীপুর গ্রামের সাহেব বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের কবরে তাঁকে দাফন করা হয়। এর আগে বেগমগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে সিরাজুল আলম খানের তৃতীয় ও শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মায়ের শাড়িতে মুড়িয়ে তাঁকে দাফন করা হয়।
জানাজার আগে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিরাজুল আলম খানকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করেন বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইয়াসির আরাফাত। শুক্রবার সিরাজুল আলম খানের মরদেহ হাসপাতাল থেকে মোহাম্মদপুরের আল-মারকাজুলে নিয়ে?যাওয়ার পর সেখানে গোসল শেষে রাতে শমরিতা হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। পরদিন শনিবার সকালে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে জানাজা শেষে নোয়াখালীতে নিয়ে যাওয়া হয়।