নজরুল ইসলাম বাসন ♦
(৭২ থেকে ৮২ এই এক দশকে সিলেটের ছাত্র রাজনীতির মাঠকর্মী হিশেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নিতাম। কৌতুহলী একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে দেখাসাক্ষাতের সুযোগ নিতাম। সেই সময়কালে সিরাজুল আলম খানের নামই কেবল আমরা শুনেছি, তার সাথে দেখা হয়নি সিলেটে। তবে একবার ক্ষণিকের জন্যে ঢাকায় তার সাথে দেখা হয়েছিল। স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তাহলে বলতে চাই, ৮০-এর দশকে আমি ও লোকমান ভাই (লোকমান আহমদ বর্তমানে জাসদের সিলেট জেলা সভাপতি) ঢাকায় দৈনিক গণকণ্ঠ অফিসে গিয়েছিলাম। সেদিনই প্রথম সিরাজুল আলম খানকে দেখি। এর বহু বছর পর পূর্ব লণ্ডনের স্টেপনি গ্রীনে বনফুল নামে একটি রেস্টুরেন্টে সিরাজুল আলম খানের সাথে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে।
সেসময় তার সাথে বেশ কিছু সময় কাটাবার সুযোগও হয়েছিল। নব্বই দশকে পূর্ব লণ্ডনে দেশ বিকাশ নামে একটি সংগঠন ডেভেন্যান্ট সেন্টারে মাসব্যাপি বাংলাদেশ মেলার আয়োজন করতো। সিরাজুল আলম সেই মেলায় কয়েকবার এসেছিলেন। ঐ সময় তিনি মেলার আয়োজক তরুণদের সাথে আগ্রহ নিয়ে কথাবার্তা বলতেন বলে সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী আমাকে জানালেন। সিরাজুল আলম খানই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পর্দার আড়ালে থেকেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমান ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত।
স্টেপনি গ্রীনে অবস্থিত যে রেস্টুরেন্টে মাঝে মাঝে সিরাজুল আলম খান আসতেন সেটির মালিক ছিলেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী কাজী নাজিম উদ্দিন। তিনি ছিলেন গাফফার ভাইয়ের ভক্ত। প্রয়াত আব্দুল গাফফার চৌধুরী ও প্রয়াত আমিনুল হক বাদশা ছিলেন আড্ডাপ্রিয় মানুষ। তারা নিয়মিত বনফুলে যেতেন, সেখানে তাদেরকে ঘিরে আড্ডা জমতো। ছড়াকার দিলু নাসের, ড: নুরুন নবী, কমিউনিটি নেতা রাজন উদ্দিন জালাল, শিল্পী হিমাংশু গোস্বামী ছাড়াও আরো অনেকে বনফুল রেস্টুরেন্টে যেতেন। উদ্দেশ্য একটাই গাফফার ভাইয়ের সান্নিধ্যে যাওয়া। ঢাকা থেকে অনেক রাজনৈতিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী লণ্ডনে এলে তারাও বনফুল রেস্টুরেন্টে গিয়ে গাফফার ভাইয়ের সাথে দেখা করতেন। মাঝে মাঝে সিরাজুল আলম খানও আসতেন। বাদশা ভাই ও গাফফার ভাইয়ের সুবাদে সিরাজুল আলম খানের সাথে সেখানে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। তখন আমি লণ্ডনের সাপ্তাহিক সুরমায় কাজ করতাম। খুব আগ্রহ নিয়ে চেষ্টা করেছিলাম তার মুখ থেকে না জানা কিছু কথা শোনার।
কিন্তু তিনি শক্তভাবে রাজনীতির প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন বার বার। শুধু আমি নই অন্যান্য সাংবাদিকদেরও তিনি এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে। সিরাজুল আলম খানের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে যা জানা যায়, ১৯৬১ সালে তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক হন পরে দুই টার্মে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সালে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বলা হয়, ৬ দফার আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের মাঝেই সিরাজুল আলম খান তার রাজনীতি খুঁজে পেয়েছিলেন। মধ্য ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি সেই রাজনীতিতেই শেখ মুজিবের ছায়াতলে ছিলেন। মধ্য ১৯৭২ সালেই সিরাজুল আলম খানের সমর্থক ছাত্রলীগের রব সিরাজ গ্রুপ আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে এরাই গঠন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল জাসদ বা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। স্বাধীনতার পূর্বে পিকিংপন্থী ও রুশপন্থী বলে পরিচিত যে দুটি সমাজতান্ত্রিক বলয় ছিল তারা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে কমিউনিস্ট বা সোশ্যালিস্টদের দল হিসাবে কখনো বিবেচনায় আনেননি।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের আগে জাসদের রাজনীতিকে কম্যুনিস্টরা বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন। মুজিব পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বাম রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। বাম দলগুলোর বড় বড় নেতারা বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগে আশ্রয় নিতে থাকেন। তারা এসব বড় বড় দলের এমপি ও মন্ত্রী হন। এই ধারায় এখন বাংলাদেশে বাম রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। আগেই বলেছি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক বলয়ের পিকিং ও রুশপন্থী উভয় ব্লকই সিরাজুল আলম খানকে ও তার দল জাসদকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারী বলে কখনোই স্বীকার করতে রাজী ছিলেন না। তারপরেও সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপরের রাজনীতির প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে থাকা এক আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেই গণ্য হবেন। ৬০ এর দশকে যখন জাতীয়তাবাদি আন্দোলন শক্তিশালি আকার ধারন করছে তখন সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স নামে একটি সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার বলয় গড়ে তোলেন।
সিরাজুল আলম খানের এই বলয়, শেখ মনির সমাজতান্ত্রিক বিরোধী বলয়ের প্রতিদ্ব›দ্বী বলয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এই দুই বলয়ের সদস্যদের নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে বিএলএফ বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স নামে একটি এলিট বাহিনী গঠিত হয়, দেরাদুন ও হাফলং এই এলিট বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং দেয়া হয়। ভারতীয় জেনারেল সুজন সিং উবান এই বাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন। বিএলএফের ৪টি সেক্টরের ৪ জন আঞ্চলিক প্রধান ছিলেন। এরা হলেন- মরহুম শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ ও সিরাজুল আলম খান। এই এলিট বাহিনীর ২৫ হাজার ট্রেনিংপ্রাপ্ত যোদ্ধা ছিল বলে জানা যায়। দেশ স্বাধীন হবার বিএলএফ মুজিববাহিনী নামে এরা সমধিক পরিচিতি লাভ করে। মুজিব বাহিনীর চার নেতা ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন। ঐ সভায় সিরাজুল আলম খান মুজিববাদের নামে প্রকাশ্যে প্রথম শ্লোগান দেন যা এখন ইউটিউবে দেখা যায়।
অকৃতদার সিরাজুল আলম খান ঢাকার কলাবাগানে ভাইয়ের বাসায় থাকতেন, এক সময় সন্ধ্যায় তাকে ঢাকার শেরাটন হোটেলের লবিতে তাকে দেখা যেত, গল্পগুজব করতে। এক সময় তিনি লণ্ডন-আমেরিকায়ও যাওয়া আসা করতেন। সিরাজুল আলম খান ওয়ান ইলেভেনের সেনা সমর্থিত সরকার, জেনারেল এরশাদের উপজেলা পদ্ধতি, ড: ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণের সমর্থক ছিলেন বলে জানা যায়। সিরাজুল আলম খানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে ড: জিল্লুর রহমান খানের সম্পর্ক করিয়ে দেন ইত্তেফাকের আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সেই সুবাদে সিরাজুল আলম খান ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিনে ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন কিছু দিন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতেন বলে জানা যায়। সিরাজুল আলম খান ও তার রাজনীতি নিয়ে তিনি নিজেও লিখেছেন তার বইগুলোর নাম ‘বাঙালীর তৃতীয় জাগরণ’ ও ‘স্বাধীনতা সশস্ত্র সংগ্রাম ও আগামীর বাংলাদেশ’। গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের ‘জাসদের উত্থান পতন’ ও ‘অস্থির সময়ের রাজনীতি’ এবং জনাব খানের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ শামসুদ্দিন পেয়ারার ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ নামে দুটি পৃথক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে ও তার দল জাসদকে ঘিরে যেসব প্রশ্ন উঠেছে যেমন তিনি কেন জাসদ গঠন করেছিলেন? জাসদ একটি গণসংগঠন হলেও জাসদ কেন সশস্ত্র গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করেছিল।
১৯৭৫ সালের ২৬ শে নভেম্বর জাসদের নামে কেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে হাইজ্যাক করে জিম্মি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল? কর্নেল তাহের যে জাসদের নেতা ছিলেন এটা কেন গোপন রাখা হয়েছিল। এসব প্রশ্নের উত্তর এই দুটি গ্রন্থে আরো বিশদভাবে উঠে আসলে রাজনৈতিক অনুসন্ধানী পাঠকদের কৌতুহল অনেকটা নিবৃত্ত হত। সিরাজুল আলম খানের উপস্থিতিতে জাসদ ভেঙে বাসদ হলো, তারপর জাসদ ভেঙে আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে এক অংশ, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ হল। কয়েক দফা বাসদ ভেঙে মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে ক্ষুদ্র একটি গ্রুপে নাগরিক ঐক্য এখন রাজনীতিতে সক্রিয়, এই ধারার রাজনীতিতে ঢাকায় জোনায়েদ সাকীও সক্রিয়। (তথ্যসূত্র: ইন্টারনেটে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে)
লণ্ডন, ০৪ জুন ২০২৩ লেখক: সাংবাদিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নকর্মী