নজরুল ইসলাম বাসন ♦
২০২৩ সালে ৯ই জুন ঢাকায় সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে পূর্ব লণ্ডনে জননেতা সিরাজুল আলম খান স্মরণে দুটি স্মৃতি সভায় উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। পূর্ব লণ্ডনের কমার্শিয়েল রোডে ২২ শে জুন ২০২৩ ও ১০ই জুলাই ২০২৩ সালে পূর্ব লণ্ডনের ফিল্ড গেইট স্ট্রীটে পৃথক পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত দুটি স্মৃতি সভাই তাঁর স্বজন ও শুভাকাংখী, রাজনৈতিক অনুসারি ও সমর্থকরা আয়োজন করেছিলেন। এই স্মৃতি সভাগুলোতে বক্তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে এই লণ্ডনেও সিরাজুল আলম খানের সাথে তাঁর আত্ময় ও পরিবারের লোকজন ছাড়াও আরো একটি ঘনিষ্ঠ বলয়ের সাথে তার আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সিরাজুল আলম খানকে যারা রহস্য পুরুষ, কাপালিক- এসব অভিধায় অভিষিক্ত করেন তারা যে কতটা ভুল করেন, স্মরণসভার বক্তাদের বক্তব্য থেকে এই সত্যটিই ফুটে উঠেছে। বরং বক্তারা তার মিশুক মন, মধুর ব্যবহার ও আচরণে আন্তরিকতার কথাই তুলে ধরেছেন। আমি শুরুতেই বলেছি, দুটি সভাই আয়োজন করেছিলেন তার স্বজন ও তাঁর শুভাকাঙক্ষীরা। তাই দুটি স্মরণ সভাতেই বড় কোন সেলিব্রিটি নেতাকে সভাপতি বা প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি বা প্রধান বক্তা হিসেবে রাখা হয়নি।
স্মরণসভায় যারা বক্তব্য রেখেছিলেন তারা সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বেশী বলেছেন। তাদের বক্তব্যেই ফুটে উঠেছে একজন সাধারণ ব্যক্তি সিরাজুল আলম খানের কথা। একজন মানুষ সিরাজুল আলম খানের কথা। রাষ্ট্র নিয়ে চিন্তিত একজন সিরাজুল আলম খানের কথা, সমাজ বদল নিয়ে তার চিন্তা ভাবনার কথা। বক্তাদের কেউ কেউ ছিলেন তার বর্ধিত পরিবারের সদস্য, কেউ কেউ এক সময়ের তার গুণগ্রাহী, রাজনীতির সমর্থক ও অনুসারি, কেউ কেউ শুভাকাংখী। সবার বক্তব্যর মূল সুর ছিল সিরাজুল আলম খান খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তার চিন্তা ভাবনা ছিল উচুমানের ও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি নিয়ে। তিনি এক সময় জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি দলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। সিরাজুল আলম খান যাদের সাথে বসবাস করতেন, চলাফেরা করতেন তাদের সাথে তিনি যে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন, তাঁর আলোচনার বিষয় ছিল বাঙালির প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জাগরণের কথা। আগামীর বাংলাদেশের জন্য তিনি তাঁর ১৪ দফা নিয়ে আলোচনা করতেন। সিরাজুল আলম খান প্রণীত এই ১৪ দফা সংক্ষিপ্তভাবে এখানে আলোচনা করার সুযোগ নেই। তবে এই ১৪ দফায় রয়েছে আগামীর বাংলাদেশ কি হওয়া উচিৎ তার একটি রূপরেখা।
পূর্ব লণ্ডনের একজন লেখক ও সাংবাদিক জনাব গিয়াস উদ্দিন আহমদের সুযোগ হয়েছিল সিরাজুল আলম খানের সান্নিধ্যে যাওয়ার। তিনি সিরাজুল আলম খানের কাছে থেকে যে কথাবার্তা শুনেছেন তা থেকেই পুরো একটি বই সংকলন করেছেন। বইয়ের নামকরণ করেছেন, ‘একুশ শতকের মহাজাগরণ সিরাজুল আলম খান দর্শন ও চিন্তাধারা’। লাল মলাটে সিরাজুল আলম খানের ছবি দিয়ে এই বইয়ের প্রচ্ছদ করা হয়েছে। বইটি হাতে নিলে মনে হয়, ৭০-এর দশকে বামপন্থীরা যে লাল বই পড়তেন সেসব বইয়ের আদল বইটির প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
‘একুশ শতকের মহাজাগরণ: সিরাজুল আলম খান দর্শন ও চিন্তাধারা’ বইটিতে গিয়াস উদ্দিন আহমদ শুধু সিরাজুল আলম খানের বিষয়ই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি সংক্ষিপ্তভাবে বাঙালির জাগরণের ইতিহাস ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রকাশিত সমসাময়িক গ্রন্থ থেকে নেয়া তথ্যও বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। আমি এই প্রতিবেদনে শুধুমাত্র সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে ‘একুশ শতকের মহাজাগরণ সিরাজুল আলম খান দর্শন ও চিন্তাধারা’ বিষয়ে আলোকপাত করব।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না সিরাজুল আলম খান গতানুগতিক রাজনৈতিক নেতা বা সংগঠক ছিলেন না। তিনি সমাজতান্ত্রিক দর্শনে বিশ্বাস করতেন। ১৯৬২ সালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস গঠন করার পেছনে তার সেই বিশ্বাস কাজ করেছিল। তাঁর সাথে ছিলেন ছাত্রলীগের সংগঠক আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ। ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন তাকে আওয়ামী লীগ ও দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের খুব কাছাকাছি নিয়ে যায়। এ নিয়ে অনেক কথা ও রুপকথা আছে। তবে বাস্তব সত্য হল-বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম বিজয় হল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামি লীগের একক বিজয়। লারকানার নবাব ভুট্টোর কূটচালে মদ্যপ জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার জেনারেলরা নিরস্ত্র বাঙালির উপর ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ গণহত্যা শুরু করে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ- স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস এটাই চেয়েছিল যার অন্যতম রূপকার ছিলেন সিরাজুল আলম খান। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা মুজিববাহিনী গঠন ছিল সিরাজুল আলম খানের আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়া। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় আসার পর সিরাজুল আলম খানের মোহ ভঙ্গ ঘটে, কারন পাকিস্তান আমলের সরকার কাঠামো নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ চলতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশে দ্রুত রাজনৈতিক পালাবদল ঘটতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর পরই ৭ই নভেম্বরের সিপাই বিদ্রোহ, জেনারেল খালেদ মোশাররফ তার সাথীদের নিয়ে নিহত হলেন। পরে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হল। আরো পরে প্রেসিডেন্ট জিয়াকেও হত্যা করা হল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ক্যু ও পাল্টা ক্যু তে শুধু মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরাই প্রাণ হারিয়েছেন।
১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ এই ৪ বছর জেলে থাকার সময়ই সম্ভবত সিরাজুল আলম খান বুঝতে পারেন বিপ্লব হাত ছাড়া হয়ে গেছে। এত হত্যা, এত মৃত্যুকে প্রচলিত রাজনীতি রক্ষা করতে পারছেনা। তখন আওয়ামী লীগ ভেঙে অনেক দল হয়ে গেছে তার নিজের জাসদ ভেঙে বাসদ হয়েছে। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর জাসদ আরো কয়েক দফা ভাঙনের সম্মুখীন হয়। জাসদ, বাসদ এখন আর দল নয় গ্রুপ হিসাবে রাজনীতির ময়দানে নিভু নিভু মোমবাতির মত জ্বলছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সিরাজুল আলম খান দলীয় রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। বেশীরভাগ সময় তিনি লণ্ডন ও আমেরিকায় সময় কাটাতেন। দেশে থাকলে সন্ধ্যায় ফাইভ স্টার হোটেল শেরাটনের লবিতে সময় কাটাতেন। এই ছিল তার জীবন। জানা গেছে অংক শাস্ত্রে স্নাতক সিরাজুল আলম খান ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের কিছুদিন পাঠদানও করেছিলেন। যদিও দলীয় রাজনীতিতে তিনি জড়িত ছিলেন না। দলীয় রাজনীতিতে না থাকলেও সিরাজুল আলম খান যে তার চিন্তা ভাবনা থেকে সরে এসেছিলেন তা কিন্তু নয়। তিনি প্রেসিডেন্ট এরশাদের উপজেলা পদ্ধতির সমর্থক ছিলেন, ড: ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংক, স্যার ফজলে হাসান আবেদের ব্রাক ও ডা: জাফরুল্লার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। ‘একুশ শতকের মহাজাগরণ: সিরাজুল আলম খান দর্শন ও চিন্তাধারা’ এই বইয়ে এসব কথা লেখা হয়েছে।
অতি সম্প্রতিকালে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চ, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কিশোর আন্দোলন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বিরোধী আন্দোলন দেশের মানুষের দৃষ্টি কেড়েছিল। এই অদলীয় আন্দোলনগুলো সিরাজুল আলম খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে গিয়ে বিচ্ছিন্ন আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া এই দুটি আন্দোলন ইতিহাসে থেকে গেছে। কোন এক সময় এ নিয়ে কথা হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মিয়ানমার থেকে আসা উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ছোট বড় দল নিশ্চুপ, বাংলাদেশ ছোট দেশ তাদের বেশিদিন রোহিঙ্গাদের স্থান দেয়া উচিৎ হবে না, ঢাকায় মীরপুর ও মোহাম্মদপুরে আটকে পড়া পাকিস্তানি বিহারী বস্তি নিয়ে যে সমস্যার উদ্রেক হয়েছে রোহিঙ্গা নিয়ে একই রকম সমস্যা হবে। বিহারীদের মত রোহিঙ্গারাও এক সময় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিরাট একটি সমস্যা ঘনিয়ে আসছে এই সমস্যা রাষ্ট্র কীভাবে সমাধান করবে?
সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন আহমদের ‘একুশ শতকের মহাজাগরণ: সিরাজুল আলম খান দর্শন ও চিন্তাধারা’ বইটিতে অনেক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। সব অধ্যায় নিয়ে এই ছোট্ট পরিসরে আলোচনা করার অবকাশ নেই। তবে এই প্রতিবেদন শেষ করার আগে মো: সাখাওয়াত হোসেন সম্পাদিত- সিরাজুল আলম খান: স্বাধীনতা সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ: বই থেকে নেয়া কিছু লাইন নীচে তুলে ধরছি তাহলো- বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও ভারতের ১০টি রাজ্য বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা,অরুণাচল, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম, মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চল ও চীনের কুনমিং প্রদেশ নিয়ে একটি পূর্বাঞ্চলীয় অর্থনৈতিক জোট গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়াও এই বইয়ে পার্লামেন্ট ও শাসনব্যাবস্থার সংস্কারের ব্যাপারে বেশ কিছু প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের রাস্ট্র ব্যাবস্থা পরিবর্তনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান রাষ্ট্রবিজ্ঞানি জিল্লুর রহমান খানের সাথে যৌথভাবে সিরাজুল আলম খান তাদের প্রস্তাবের কথা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে যারা আছেন তাদের জন্যে এসব প্রস্তাব চিন্তাভাবনার খোরাক হতে পারে। লণ্ডনের লেখক সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন আহমদের ‘একুশ শতকের মহাজাগরণ সিরাজুল আলম খান দর্শন ও চিন্তাধারা’ বইটি আমাজনে অর্ডার দেয়া যাবে।
তথ্যসূত্র: মো: সাখাওয়াত হোসেন সম্পাদিত ‘সিরাজুল আলম খান: স্বাধীনতা সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ’: http://serajulalamkhanpolitics.com/wp-content/uploads/2019/04/Bangladesh_SAK.pdf
লণ্ডন, ১৫ই জুলাই ২০২৩
লেখক: সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী