।। সাগর রহমান।।
বছর ঘুরে আবার সেপ্টেম্বর। বছর ঘুরে আবার আমাদের এখানে বইমেলা। আগামী দশ ও এগারো তারিখ (রবি ও সোমবার) লণ্ডনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্যের আয়োজনে বাংলাদেশ বইমেলা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব। সেই দুই হাজার নয়ে যার শুরু বাংলা একাডেমির বইমেলা, সাংস্কৃতিক উৎসব নামে, অনেকগুলো বছর পেরিয়ে সেই ধারাবাহিকতাটি নাম পেয়েছে বাংলাদেশ বইমেলা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব। মাঝখানে দুই/তিনটি বছর নানা কারণে বাদ পড়লেও মোটামুটি ধারাবাহিকভাবেই এই মেলাটির সফল আয়োজন করার জন্য সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ আমাদের সবার কাছে সাধুবাদ পাবেন। ঝক্কি তো কম নয়! বাংলা ভাষার ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ প্রবচনটির একটি সার্থক উদাহরণ হতে পারে লণ্ডনে বসে বাংলা বইয়ের বইমেলা করার উদ্যোগটির।
কোনো এক সময় নাকি এই বইমেলার জন্য মোটামুটি অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যেতো। বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সাহায্য করতেন, সাহায্য পাওয়া যেতো লণ্ডনের কাউন্সিল থেকেও। আমার জন্য এর সবই অবশ্য শোনা কথা, কারণ যতটুক জানি, সেসব এখন সোনালি অতীতের ‘স্মৃতি’। একটা সময় মেলার দিন ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে আমার উপস্থিত থাকা হতো না। গত তিনটি মেলায় নানান ভাবে এর কর্মকাণ্ডের সংগে খানিকটা জড়িয়ে যাওয়াতে খুব কাছ থেকে দেখেছি কী ভীষণ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে এমন একটা মেলার আয়োজন করতে হয়, বিশেষত লণ্ডনের ইংরেজি মাটিতে। একেকটি মেলার জন্য যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়, তার প্রায় পুরোটাই আসে সংগঠনের সদস্যদের অনুদান থেকে। পাই পাই করে (পড়ুন ‘পেন্স পেন্স’ করে) জমা করা হয় বাজেট। নিজেদের ভীষণ ব্যস্ততার ভেতর থেকে নিবেদিতপ্রাণ গুটিকয় কর্মী আক্ষরিক অর্থেই রাত-দিন খেটে আয়োজনটি দাঁড় করান। নিঃস্বার্থ পরিশ্রমের একটি যোগ্য উদাহরণ হতে পারে এই বইমেলা আয়োজনটির।
উপরের প্যারায় ব্যবহার করা ‘ইংরেজি মাটি’তে বাংলা বইমেলা করার কথাটি একটু বিস্তারিত করা যাক। বইমেলার আয়োজন শুরু হতে না হতেই মূলত চিন্তা শুরু হয় অর্থ সংগ্রহের। সৌভাগ্যবশতঃ যুক্তরাজ্যে অনেকজন বাঙালি সন্তান আছেন যারা নিজেদের অপরিমেয় যোগ্যতায় বাণিজ্যের লক্ষীকে মুঠোবন্দী করেছেন। ফলে শুরুতে আয়োজকরা অর্থের সংকট কাটিয়ে তুলতে এই ধনীদের কাছে ধর্না দিতে শুরু করেন। আশা অনুদান হিসেবে কিংবা বইমেলা উপলক্ষে ছাপানো পত্রিকা বা স্মরণিকায় এদের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিজ্ঞাপন বাবদ হিসেবেও যদি কিছু অর্থ সংগ্রহ হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রায় সবসময়ই এধরনের আশা স্রেফ দুরাশায় পরিণত হয়েছে। কোনো এক বিচিত্র কারণে এই ধনী বঙ্গসন্তানেরা বাংলা বইমেলা আয়োজনটিকে খুব সযতেœ এড়িয়ে আসছেন। অথচ এরা যে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করেন না, তাতো নয়। প্রায়ই নানান জায়গায়, উপলক্ষে, পত্র-পত্রিকায় এদের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। এ কথাটি তো সত্যি আমাদের ধনী ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ে মূল ভোক্তা আমরা বাঙালি জনগোষ্ঠীই, আর বাংলা বইমেলার মতো আয়োজনে বাঙালিরাই তো যান। তাহলে সমস্যাটি কোথায়? অনুদান তো দূরের কথা, অনেকক্ষেত্রে দুর্ব্যবহার পাওয়ার নজীরও আছে ফি বছর। এমনও ঘটেছে যে অনুদান চাইতে গেছেন বুঝতে পেরে বসতে বলার মতো ভদ্রতাটুকু দেখাতে ভুলে গেছেন কোনো কোনো ভদ্রলোক। অথচ প্রচলিত ধারণাটি হচ্ছে, এই মা?ি-মিলিওনিয়ার বাঙালি ব্যবসায়ীদের যে কেউই অতি সহজেই এমন একটি মহৎ উদ্যোগের অর্থ সমস্যাটির সমাধান করতে পারেন।
সমস্যাটি বোধহয় মেলাটি ‘বই’য়ের হওয়ায়। শত হলেও এ কথাটিতো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, ফলমেলা, পিঠামেলা, পোশাকমেলা, হিন্দি গানে মুখরিত বৈশাখী মেলায় যে লোকে লোকারণ্য অবস্থাটি হয়, তার সিকিভাগ ভীড়ও হয় না এখানকার বইয়ের মেলায়। এছাড়াও আর কেউ না জানুক, ব্যবসায়ীরা খুব ভালো করে জানেন, বইপড়া লোক খুব একটা ‘সুবিধা’র হয় না, এদের পণ্য কেনার ক্ষমতা কম থাকে!
তবে আশা এবং স্বস্তির কথাটি হচ্ছে, এত অবহেলা এবং বৈরিতার পরও এর সংগে সংশ্লিষ্ট সদস্য এবং কর্মীদের উৎসাহে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাঁদাগুলো এক সংগে জড়ো করে প্রতিবছরই বিপুল উদ্দীপনায় ঝাঁপিয়ে পড়েন আরো একটি বইমেলা আয়োজনের। এই বইমেলায় বাঙালিদের সমাগম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে এই কলামে আগেও লিখেছিলাম বলে সে বিষয়টি আজকে আর অবতারণা করছি না। তবে এটুকু বলতেই হবে, এত বছর পেরিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্যের আয়োজিত এই মেলাটি এখনো রয়ে গেছে যারা লেখালেখির বা সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে সরাসরি জড়িত, তাদের মেলায়। এর বাইরে যে বিপুল বাঙালির বাস লণ্ডন কিংবা যুক্তরাজ্যে, তাদেরকে সম্পৃক্ত করার মতো কিছু না কিছু ঘাটতি কোথাও রয়েই যাচ্ছে। এত কষ্ট করে, নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে এত ঝক্কির একটা ব্যাপার যখন প্রতিবছর আয়োজন হচ্ছেই, আয়োজকরা আগামী দিনগুলোতে এই বিষয়টিতে আরেকটু মনোযোগী হবেন Ð এটা আশা করাই যেতে পারে। অবশ্য এ কথাগুলো পড়ে বাংলাদেশ থেকে আগত প্রকাশকরা চিন্তা পড়তে পারেন। তবে গত মেলাতে অংশগ্রহণ করা প্রকাশক বন্ধুদের অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু জানি, যত কমই হোক না কেন, এদের কেউই সে অর্থে ‘লস’ গুনেননি।
লণ্ডনে আয়োজিত বইমেলা নিয়ে বাঙালি লেখক কবিদের যে পরিমাণ উৎসাহ এবং উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়, তা অতুলনীয়। উৎসাহের মাত্রা বোঝানোর জন্য শুধু যদি এই তথ্যটি পরিবেশন করি যে শুধুমাত্র এ বছরের লণ্ডন বইমেলাকে কেন্দ্র করে এই সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে অন্তত একুশটি নতুন বই! একুশটি! তথ্যটি খুব সম্ভবত রেকর্ড হওয়ার যোগ্য, কেননা, বাংলাদেশের বাইরে বিশে¡র আরো যেসব দেশে এমন আয়োজন হয়, সেসব জায়গায় এত সংখ্যক বই প্রকাশ হওয়ার কথা অন্তত আমার জানা নেই! ব্যাপারটা শুধু এ বছর নয়, ফি বছরই এখানকার কবি-সাহিত্যিকরা এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে অনেক নতুন বই প্রকাশ করেন।
গত কয়েক বছর আগেও লণ্ডনের অনুষ্ঠিত হওয়া এই বইমেলাটির সাথে বাংলা একাডেমি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রসহ প্রভৃতি ইন্সটিউশনের বেশ সম্পৃক্ততা দেখা যেতো। দেখতে পাচ্ছি দৃশমান অবস্থাটা বেশ খানিকটা পা?েছে। এবারে অবশ্য অর্থ সাহায্যের কথা হচ্ছে না, হচ্ছে ‘মানসিক সাহায্যের’ কথাও। দুই হাজার ষোলো সালের আগে এই বইমেলাটির নামই ছিল ‘বাংলা একাডেমি বইমেলা’ যা বর্হিবিশে¡ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চাকে ছড়িয়ে দেবার প্রত্যয় নিয়ে নাম পা?ে হয়ে যায় ‘বাংলাদেশ বইমেলা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব’। নামটি এখনো তাই আছে, কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রত্যয়টির কি কোথাও কোনো ঘাটতি পড়েছে! না মেনে উপায় নেই যে, এর মাঝে বাংলাদেশে এবং যুক্তরাজ্যে যথাক্রমে পদ্মা-মেঘনার এবং টেমসের জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে, গড়ানোর কালে তার বেশ খানিকটা ঘোলাও হয়েছে। এবং শংকাটি হচ্ছে, বর্তমান অবস্থাটি চলমান থাকলে খুব নিকট ভবিষ্যতে এত সুন্দর আয়োজনটি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। আমার দৃঢ় বিশ¡াস বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং বাংলা একাডেমির এই আয়োজনটি নিয়ে আরেকটু মনোযোগ দিলে, তাদের নানাবিধ সহযোগিতার হাতটি বাড়িয়ে দিলে এত সুন্দর উদ্যোগটিকে এত কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হয় না। শত হলেও আয়োজনটি লণ্ডনে হচ্ছে বটে, তবে তার শেকড় এবং নানাবিধ পুষ্টি বাংলাদেশে।
লণ্ডন, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
লেখক: কথা সাহিত্যিক