বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার
সারওয়ার-ই আলম ♦
লণ্ডন, ১৬ অক্টোবর: একবার রোপণ করেই বছরজুড়ে ধানের পাঁচটি ফসল উৎপাদনের উপায় উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ডক্টর আবেদ চৌধুরী। তিনি তাঁর এ আবিষ্কারের নাম দিয়েছেন ‘পঞ্চব্রীহি’।
তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে প্রথম ফসল কেটে তোলার পর ধানগাছের গোড়ার অংশ আবার গজাবে এবং নির্দিষ্ট সময় পর দ্বিতীয় ফসল ধরবে। এভাবে বোরো, আউশ ও আমন- এই তিন মৌসুমেই মোট পাঁচ বার ধান উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এটি হবে জলবায়ুবান্ধব।
গত ১২ই অক্টোবর বৃহস্পতিবার লণ্ডন-বাংলা প্রেস ক্লাব আয়োজিত ‘খাদ্য নিরাপত্তা এবং মানবস্বাস্থ্য’ শীর্ষক এক বিশেষ বক্তৃতা অনুষ্ঠানে এই আবিষ্কারের কথা জানান তিনি।
ফি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত, বন্যাপ্রবণ ও খরাপীড়িত দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংকট দূরীকরণে নিঃসন্দেহে এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার।
ডক্টর আবেদ চৌধুরীর ভাষায়, ‘এ নতুন ধান চাষ পদ্ধতি যদি সারাদেশের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরের জন্য গোটা জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব’।
এই বিশেষ বক্তৃতা অনুষ্ঠানে ডক্টর চৌধুরী জানান, বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজারের কানিহাটি গ্রামের কৃষকদেরকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে কোনোরকম কৃত্রিম রাসায়নিক ছাড়াই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে বহু জাতের ধানের মিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি এমন একটি ধান আবিষ্কার করেছেন, যা চাষের জন্য নতুন করে পাঁচ বার ধান গাছ রোপণ করতে হবে না। এতে কৃষকের সময় যেমন বাঁচবে, তেমনি সাশ্রয় হবে অর্থও। একইসঙ্গে একই জমিতে একই গাছে পাঁচবার ধান উৎপাদনের ফলে দূর হবে দেশের খাদ্য সংকট।
পূর্ব লণ্ডনের লণ্ডন এন্টারপ্রাইজ একাডেমি মিলনায়তনে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ডক্টর আবেদ চৌধুরী তাঁর এ আবিষ্কারের কাহিনী উপস্থাপনের পর গভীর মনযোগের সঙ্গে এ নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্ন শোনেন এবং প্রতিটি প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর দেন।
তাঁর এ নতুন ধান উৎপাদন পদ্ধতি বাণিজ্যিক উপায়ে ব্যবহার করা হবে, নাকি সাধারণের মাঝে বিনামূল্যে ছড়িয়ে দেওয়া হবে- এ প্রশ্নের উত্তরে ডক্টর চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা শেষে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আমার এ আবিষ্কারকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করব না। আমি এটিকে সহজলভ্য করে দেব আমার দেশের দরিদ্র কৃষকদের জন্য’।
ডক্টর চৌধুরী আরও বলেন, ‘আমার এ আবিষ্কারের গবেষণাগার হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত মৌলভীবাজারের কানিহাটি গ্রাম, যে গ্রামে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেখানে আমার গবেষণা এবং সকল পরীক্ষা-নীরিক্ষার সহযোগী ছিলেন সেসব স্বল্পশিক্ষিত কিংবা স্বশিক্ষিত কৃষক যাদের গায়ে লেগে থাকে বাংলার জল-কাদার গন্ধ। তারা দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় দিনরাত আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের বুকে মিশে আছে ধর্ম ও বিজ্ঞান। এসব স্বল্পশিক্ষিত, সরলপ্রাণ, দেশপ্রেমিক কৃষককে সঙ্গে নিয়ে আমি বিশ্বকে উপহার দিতে চাই উৎপাদনের শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞান। আমি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আমার আবিষ্কারকে ব্যবহার করতে চাইনা। আমি চাই আমার এ আবিষ্কার দেশের মানুষের জীবনমান বদলে দিক। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক আমার মাতৃভূমির মানুষের জন্য।’
উল্লেখ্য ‘পঞ্চব্রীহি’ চাষের মাধ্যমে একটি ধান গাছ থেকে বছরজুড়ে বোরো মৌসুমে একটি এবং আমন ও আউশ মৌসুমে দুটি করে মোট পাঁচটি ফলন পাওয়া সম্ভব।
প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজি’র প্রফেসর হিউ ডিকিনসন, অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক স্বাস্থ্য প্রযুক্তি বিষয়ক বাণিজ্যিক সংস্থা জেনোফ্যাক্স-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জনাব জাহাঙ্গীর আলম। শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্যে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান ক্লাবের সভাপতি জনাব মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী।
প্রফেসর হিউ ডিকসন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘ত্রিশ বছর পর পূর্ব লণ্ডনে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এখানকার জনজীবনে বাঙালি কমিউনিটির অবদান ও ইতিবাচক প্রভাব দেখে আমি খুব অভিভূত, আমি অভিভূত এখানকার পরিবর্তন দেখে’। তিনি ডক্টর আবেদ চৌধুরীর আবিষ্কারের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
উল্লেখ্য, প্রফেসর হিউ ডিকিনসন সত্তরের দশকে ছাত্রাবস্থায় বাঙালিদের ‘ব্যাটল অব ব্রিকলেন’ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
জেনোফ্যাক্সের সিইও জাহাঙ্গীর আলম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল টেকনোলজি (এআই) ব্যবহার করে মানুষের ‘জেনেটিক ড্যাটা’ সংগ্রহ করে এর বিশদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জেনোফ্যাক্স কীভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে- সাংবাদিকদের কাছে তা তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য, এর আগে ডক্টর আবেদ চৌধুরী, প্রফেসর হিউ ডিকিনসন ও জনাব জাহাঙ্গীর আলম লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের কার্যালয় পরিদর্শন করেন। ডক্টর আবেদ চৌধুরী গত ১০ অক্টোবর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজে ‘ইসলাম এণ্ড সায়েন্স- এ পার্সপেক্টিভ ফ্রম রুরাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক বক্তৃতা করেন। মূলত এই বক্তৃতার জন্যই আমন্ত্রিত হয়ে তিনি এবার লণ্ডন আসেন।