প্রদীপ কুমার দত্ত ♦
অতুলপ্রসাদের সমাধিফলকে আগে উৎকীর্ণ ছিল তাঁর সেই বিখ্যাত গান: মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা। প্রতিস্থাপিত হয়েছে কবির অন্য একটি ভাববাদী গানের চরণ দিয়ে- শেষে ফিরব যখন সন্ধ্যা বেলা সাঙ্গ করি ভবের খেলা….।
পঞ্চকবির অন্যতম শ্রী অতুল প্রসাদ সেন। গিয়েছিলাম জামালপুর জেলা সদর থেকে ১৬/১৭ কিলোমিটার দূরে মেলান্দহ উপজেলার কাপাসহাটিয়া। উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম যাদুঘর প্রাঙ্গণে আয়োজিত তিনদিনব্যাপী লোক সংস্কৃতি উৎসব ও লোকজ মেলায় অংশ নেয়া। সেই অনুষ্ঠান সম্পর্কে ইতোমধ্যে কিছু ছবি ও পরিচিতি শেয়ার করেছি। পাঠকদের উৎসাহ থাকলে ভবিষ্যতে আবারও করা যাবে। আজ অন্য প্রসঙ্গ। রথ দেখার সাথে সাথে দু’একটা কলা বেচার বদঅভ্যাস আমার অনেকদিনের। এটা নিয়ে আমার সফরসঙ্গীদের (যে বা যারা সেই যাত্রায় থাকেন) অভিযোগের অন্ত নেই। তবে কয়লা ধুলেও ময়লা যাবে কোথায়? তাই মোগলের সাথে পড়ে তাঁদের খানা খেতেই হয়। এবারই বা ব্যতিক্রম হবে কোন দুঃখে?
অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো একটু কাওরাইদে ঢুঁ মারার।কারন দুটো। প্রথমটি একটি পবিত্র দায়িত্ব। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, স্বাধীনতাপূর্ব দেশের অন্যতম প্রধান দাবাড়ু মুফতি কাসেদ কাওরাইদের কোনো জায়গায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুুখসমরে শহীদ হন। সেই জায়গাটি খুঁজে বের করে সেখানে একবার শ্রদ্ধা জানিয়ে আসার ইচ্ছা পোষণ করি। সঠিক জায়গাটি সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত করে জানতে পারিনি। কাসেদ ভাইকে নিয়ে আমি এবং অঞ্জনা পত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে লিখেছি। তাঁর অন্য শুভানুধ্যায়ীরাও লিখেছেন। আমার অনুসন্ধান জারি থাকবে। পাঠকরা কেউ তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারলে কৃতজ্ঞ থাকব। এবার আসি দ্বিতীয় কারণে। অনেক আগে কোথাও পড়েছিলাম বাংলা পঞ্চকবির অন্যতম শ্রী অতুল প্রসাদ সেন এর স্মৃতিবিজড়িত জায়গা কাওরাইদ। এখানে তাঁর সমাধি রয়েছে। পরবর্তীকালে জানার ভাণ্ডারে আরও তথ্য যোগ হয়। অতি সম্প্রতি আমার বন্ধু সমাজকর্মী শ্রী তাপস হোড় এবং অনুজপ্রতীম গবেষক ও সংগঠক জনাব আশরাফুল ইসলামের সহযোগিতার কারণে সেই স্থানে যাওয়া ও দেখা জলবত তরলং হয়ে যায়।
তাঁরা দুজন বাংলাদেশ -ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। কয়েকদিন আগে তাঁরা ঐতিহাসিক সেই জায়গা ঘুরে এসেছেন ও শিগগিরই সেখানে একটি অতুল মেলা আয়োজন করতে যাচ্ছেন। আশরাফ ভাইয়ের বাড়িও ঐ এলাকায়। আমার জামালপুর থেকে ঢাকা ফেরার পথে ময়মনসিংহ -ঢাকা হাইওয়ে থেকে ১৬/১৭ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকলেই অকুস্থলে পৌঁছানো যাবে। আশরাফভাই হাইওয়ের নির্দিষ্ট স্থানে তাঁর ভাই শাকিলকে পথপ্রদর্শক হিসাবে মোতায়েন রাখলেন। ছেলেটি অতি অমায়িক। আমাদের গাড়ি খানিক বেগড়বাই করছিল। শাকিল তাদের আরেক কাজিন রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ী আশরাফুল আলমকে আমাদের গাড়ি মেরামতের জন্য ওয়ার্কশপে পাঠানোর বন্দোবস্ত করতে অনুরোধ জানাল। তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে রাজী হলেন। আমরা বিকল্প গাড়ীতে হাইওয়ে ছেড়ে গ্রামীণ পীচঢালা পথে রওনা দিলাম। এই এলাকাটি অতুলপ্রসাদ সেনের মাতুল বংশের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন চলছিল বাংলা রেনেসাঁর যুগ। সেই সময়ের শিক্ষিত প্রাগ্রসর শ্রেণির অনেকেই ব্রাহ্ম মতাবলম্বী ছিলেন। অতুলপ্রসাদের পরিবার এবং মাতুলালয়ও তাই। কাওরাইদ ঢাকা (বর্তমানের গাজীপুর) জেলার শেষপ্রান্ত।
একটি ছোট নদীর (সূতি) ওপারেই ময়মনসিংহ জেলা। এই নদী তীরবর্তী এলাকায় মনোরম পরিবেশে ছিল জমিদারদের কাচারি। এখানে শৈশবে অতুলপ্রসাদ তাঁর মাতামহের সাথে বহু সময় শিক্ষা ও সঙ্গীতসাধনায় কাটিয়েছেন। এটি এখন সরকারি ভূমি অফিস। তার লাগোয়া চমৎকার একটি ব্রাহ্ম মন্দির। শতবছর পেরিয়ে গেলেও এখনও মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছে। প্রাঙ্গণে সারি সারি সমাধি। সেগুলোও চলনসই অবস্থার। প্রতিটিতে সমাধি ফলক লাগানো। সেখানে আরও রয়েছে স্যার কে জি গুপ্তের (অতুলপ্রসাদের মামা আবার শ্বশুর মশাই) সমাধি। তিনি সপ্তম ভারতীয় আই সি এস অফিসার ও প্রথম কে সি এস আই (নাইট কমাণ্ডার অব দি স্টার অফ ইণ্ডিয়া) ছিলেন। অন্য সমাধিগুলোর মধ্যে আছে অতুলপ্রসাদ এর মাতামহ জমিদার, সুগায়ক, ভাবসঙ্গীত রচয়িতা ও লেখক শ্রী কালী নারায়ন গুপ্তের সমাধি। এই এলাকায় তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই আমলে। সেটি এখনও শিক্ষার আলো বিতরণ করে চলেছে। তবে সেই কালী নারায়ণ স্কুলটি একসময় তার নামটি হারিয়ে ফেলেছিল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখতে পাই এক শ্রেণির লোকের পুরনো এই নামগুলো গাত্রদাহ। তাই ব্রজমোহন কলেজ হয়ে যায় বি এম কলেজ, মুরারীচাঁদ কলেজ হয় এম সি কলেজ। তেমনি এই স্কুল ও হয়েছিল কে এন স্কুল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী সৌভাগ্যক্রমে ও কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের প্রচেষ্টায় স্কুলটি পুরনো নাম ফেরৎ পেয়েছে।
শ্রী অতুল প্রসাদ সেন তাঁর কর্মস্থল লখনউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। চিতাভস্মের কিয়দংশ এখানে সমাহিত করা হয়েছে। অন্য সমাধিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো একই পদ্ধতির। কয়েকটি শেষকৃত্য এখানেও হয়েছে। অতুলপ্রসাদের সমাধিফলকে আগে উৎকীর্ণ ছিল তাঁর সেই বিখ্যাত গান: মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাভাষা আন্দোলনে পরাজিত পাকিস্তানিরা তাদের ১৯৫২ র পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সেই সমাধিফলকটি গুঁড়ো করে ফেলে। পরে সেটি পুনর্নির্মাণ করার সময় কেন জানিনা সেই মহান গানের চরণ দুটি বাদ পড়ে যায়। এতদিনেও তা কেউ ঠিক করে উঠতে পারলো না কেন তা ভেবে অবাক হই। সেই গানটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে কবির অন্য একটি ভাববাদী গানের চরণ দিয়ে- শেষে ফিরব যখন সন্ধ্যা বেলা সাঙ্গ করি ভবের খেলা….।
অবশ্য এই গানটিও সমাধিফলকের উপযুক্ত বটে। যদিও অনেকেই কবির জীবন সম্পর্কে বহুলভাবে অবগত তবুও এই সুযোগে যাঁরা জানার সুযোগ করে উঠতে পারেন নি তাঁদের জন্য একটু তথ্য বিতরণ করার সুযোগ ’গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ হিসাবে নিয়ে নেই। অতুলপ্রসাদের পৈত্রিক বাড়ি তৎকালীন বিক্রমপুর পরগণার পদ্মার দক্ষিণাংশে। বর্তমানে সেই এলাকা শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মগরা। তিনি অতি অল্পবয়েসে পিতৃহীন হন। তাঁর জন্ম তৎকালীন সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী মাতুলালয়ে ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে। শৈশবে পিতৃহীন হওয়ায় এবং মাতা পুনরায় দারপরিগ্রহ করায় তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে মাতুলালয়ে। মাতুল পরিবার অতি প্রভাবশালী, উচ্চশিক্ষিত, ধনবান, রুচিশীল ও সংস্কৃতিবান ছিলেন। তাঁরা ঢাকা জেলার (বর্তমান নরসিংদী) পাঁচদোনার ভাটপাড়ায় শানশওকতে থাকতেন। তাঁদের জমিদারি ছিল কাওরাইদ অঞ্চলে।
অতুলপ্রসাদ তাঁর মাতামহ তৎকালীন পরিবারপ্রধান ও জমিদার কালী নারায়ন গুপ্তর তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করতে থাকেন। কালী নারায়ন অত্যাচারী জমিদার চরিত্রের ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি ছিলেন লেখক এবং ভাবকথা ও ভাবসঙ্গিত রচয়িতা কবি। ছিলেন সুগায়ক। তাঁর কাছেই অতুল গানের ভূবনে প্রবেশের চাবিকাঠি পান। কালী নারায়ন ঢাকা ব্রাহ্ম সমাজের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং ব্রাহ্মমত প্রচারেও ভূমিকা পালন করেন। তিনিই নিজের কাচারি এলাকায় কাওরাইদ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করে উপাসনার জন্য মন্দির তৈরি করে দেন, যেটি আমরা চাক্ষুষ করার সুযোগ পেলাম। কালী নারায়ণের সুযোগ্যপুত্র স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্তের (কে জি গুপ্ত) কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এছাড়াও এই পরিবার তৎকালীন বহু উল্লেখযোগ্য পরিবারের সাথে আত্মীয়তা বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। পবিত্র কুরআন শরীফের প্রথম সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদক হিসাবে অতি পরিচিত ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন, সত্যজিত রায়ের মাতা ও স্ত্রী উভয়েই এবং অতিপরিচিত অনেকেই এই গুপ্ত পরিবারের নিকট বা দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন।
আমরা ফিরে আসি কবির কথায়। তিনি স্কুলের পড়াশোনা মামাবাড়ি থেকে শেষ করে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে যান। তারপর তাঁকে আইন শিক্ষার জন্য লণ্ডন পাঠানো হয়। মিডল টেম্পল থেকে তিনি ১৮৯৪ এ ব্যারিস্টার হন। ইউরোপে থাকাকালীন পশ্চিমা ক্লাসিকাল সঙ্গীত পছন্দ করে সেই ধারা আত্মস্থ করেন। দেশে ফিরে তিনি প্রথম বঙ্গদেশেই পেশায় থিতু হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কয়েক বছর রংপুর ও কলকাতায় কাটিয়ে তাঁর মন টিকলো না। পারিবারিক কিছু কারণও ছিল। তিনি ইতোমধ্যে তাঁর মামাতো বোন স্যার কে জি গুপ্তের কন্যা হেমকুসুমের সাথে মন দেয়া-নেয়ায় জড়িয়েছেন। এই সম্পর্কে পরিবার অসন্তুষ্ট ছিল এবং তৎকালীন আইনও এরূপ বিবাহের পক্ষে ছিল না। তিনি লখনউ গিয়ে পরবর্তীকালে আইন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ক্রমান্বয়ে তিনি বার এসোসিয়েশন ও বার কাউন্সিল উভয় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদ অলংকৃত করেছিলেন।
তিনি ১৯০০ সালে বিলেত যান এবং স্কটল্যাণ্ডের আইনে কোনও বাধা না থাকায় সেখানে হেমকুসুমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তঁদের দুই পুত্রসন্তানের জন্ম হয় সেখানেই। তিনি সেখানে আইনবিদ হিসাবে কিছু কাজও শুরু করেন। নবজাতক দুই পুত্রের একজনের অকালমৃত্যু, ইংল্যাণ্ডের আবহাওয়া পছন্দ না হওয়া ও আইনজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সময়সাপেক্ষ প্রতীয়মান হওয়া- এই সকল কারণে ১৯০২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং আমৃত্যু লখনউতে আইন ও সঙ্গীতচর্চা নিয়ে কাটান। লখনউ সঙ্গীত ও নৃত্যকলার জন্য প্রসিদ্ধ। তিনি প্রচুর সময় সঙ্গীত সাধনায় ব্যয় করতেন। সঙ্গীতের আসর বসাতেন লখনউতে তৎকালীন সকল বিশিষ্ট ওচ্চাদদের নিয়ে। রচনা করতেন গান, সুরারোপ করতেন তাতে। গাইতেনও নিজে। তাঁর গানসমূহের প্রধান উপজীব্য দেশপ্রেম, ভক্তি, প্রেম ও জীবনের দুঃখবেদনা। তিনি বাংলা গানে রাগপ্রধান ধারা চালুর অন্যতম সারথী। লখনউ থেকে সঙ্গীত চর্চা করায় তাঁর গানে ঠুমরীর প্রভাব প্রচুর। প্রথম বাংলা গজলও তিনিই প্রচলন করেন বলে জানা যায়। তাঁর লেখা ও সুরারোপিত মোট ২০৬টি গান তাঁর সম্পর্কের বোন সাহানা দেবী সংকলিত করে গেছেন। এই মহান বঙ্গ-সন্তানের জীবনাবসান হয় সুদূর লখনউতে ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট। তাঁর শেষকৃত্য সেখানেই সুসম্পন্ন হয়। চিতাভস্মের এক অংশ তাঁর প্রিয় বঙ্গদেশে মাতামহ প্রতিষ্ঠিত কাওরাইদ ব্রাহ্ম মন্দির প্রাঙ্গণে মাতামহ, মাতুল ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমাধির পাশেই সমাহিত করে সেখানে পূর্বে উল্লিখিত সমাধিফলক স্থাপন করা হয়। সেই সমাধির সামনে নিরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমরা ঢাকার দিকে রওনা দিলাম। পঞ্চকবির অন্যতম অতুলপ্রসাদের কয়েকটি কালজয়ী গানের প্রথম চরণ উল্লেখ করে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
বলো বলো বলো সবে মোদের গরব মোদের আশা কে আবার বাজায় বাঁশি নিঁদ নাহি আঁখিপাতে সবারে বাস রে ভালো। ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়।