দ্য ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদন
শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশিরা যুক্তরাজ্যে
শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালি শিক্ষার্থী ভর্তির হার ৫ থেকে বেড়ে ১৬ শতাংশ
৫৫ শতাংশ বাংলাদেশির বাস লণ্ডনে। অর্থনৈতিক কেন্দ্রের আশপাশে থাকার সুবিধা মিলছে
পত্রিকা ডেস্ক
লণ্ডন, ০৫ ডিসেম্বর: যুক্তরাজ্যের স্কুলগুলোতে গত দুই দশক ধরে ‘জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেণ্ডারি এডুকেশন (জিসিএসই)’ পরীক্ষায় শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের চেয়েও অনেক বেশি ভালো ফলাফল করেছে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা। এ তথ্য জানানো হয়েছে ব্রিটিশ সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অর্জন যে হরে বেড়েছে, অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর এতটা উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশীরা এখন উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান এবং ভালো চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করছে।
২০০৯-১০ সালে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিলো মাত্র ৫ শতাংশ। এখন সেই হার বেড়ে হয়েছে ১৬ শতাংশ। এর বিপরীতে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের মধ্যে এই হার ছিল মাত্র ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ শতাংশ। জনসংখ্যা অনুপাতে অগ্রগতির তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা শেতাঙ্গ শিক্ষার্থীদের ছড়িয়ে গেছে।
দ্য ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৫ সালে পূর্ব লণ্ডনের বাংলাদেশিদের সম্পর্কে দুটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল-একটি একাডেমিক জার্নালে, অন্যটি শিক্ষা প্রতিবেদনে। দুটি প্রতিবেদনেই হতাশাজনক ফলাফল আসে। শিক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি শিশুরা স্কুলে ‘খুবই বাজে ফল’ করছে। অন্য প্রতিবেদনে লণ্ডনের শিল্পায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশিদের আরও খারাপের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। তবে খুশির বিষয় হলো, ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলসের জনসংখ্যার এক শতাংশ বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণীটি উ?ো ঘটেছে। দুই দশক আগেও শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের তুলনায় বাংলাদেশিরা দেশটির জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেণ্ডারি এডুকেশন (জিসিএসই) পরীক্ষায় খুবই পিছিয়ে ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সে অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ব্রিটেনের অন্য কোনো সম্প্রদায়ের এতটা উন্নতি হয়নি। নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিরা এখন শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরাদের অবস্থান এবং ভালো চাকরির প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকছে। ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের এই অভাবনীয় সাফল্য বেশ কিছু বিষয়ের ইঙ্গিত দেয়। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশিরা ব্রিটেনে পাড়ি জমাতে শুরু করে। তখন অধিকাংশ অভিবাসী পূর্ব লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তবে সেখানে কাউন্সিলের বৈষম্যমূলক আবাসন নীতি এবং বর্ণবাদী আচরণের মুখোমুখি হতে হয় বাংলাদেশিদের, ফলে তারা বাধ্য হয়ে আরও পূর্বদিকে সরে যায়। সেখানে বেশিরভাগ বাংলাদেশি তখন রেস্টুরেন্ট এবং কাপড়ের ব্যবসা শুরু করে। তখন শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ কম ছিল। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে।
পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের মালব্যারি স্কুল ফর গার্লস-এর প্রধান শিক্ষক ভ্যানেসা ওগডেন দ্য ইকোনোস্টকে বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য আগ্রহী ছিল না। অধিকাংশেরেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো, তারপর ঘরে বসে জীবন কাটাতো। তবে একটা সময় অনেকে এর প্রতিবাদ শুরু করে।’ তিনি বলেন, ২০০৪ সালে এক স্কুল ইন্সপেক্টরকে এক বাংলাদেশি ছাত্রী বলেছিল, যখন আমরা বিয়ে করবো এবং আমাদের মেয়ে হবে, আমরা তাদের সাথে ভিন্নভাবে আচরণ করবো। এরপর থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ নাটকীয়ভাবে উন্নতি ঘটতে থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশিদের এই সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারণ হতে পারে নীতি নির্ধারণ এবং ধৈর্য। ১৯৯৭ সালে লেবার সরকার একটি এডুকেশন টাস্ক ফোর্স গঠন করে। তারই একজন সদস্য হেইডি মির্জা জানান, দরিদ্র ইনার-সিটি স্কুলগুলোর জন্য অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ এবং সঠিক তদারকির ফলাফল অবশেষে দেখা যাচ্ছে। তবে কনজার্ভেটিভ সরকারের আমলে এই মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া হয়। ৫৫টি শিক্ষা বিনিয়োগ এলাকার কোনোটিই লন্ডনের মধ্যে নয়। এগুলো পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশিদের জন্য খারাপ সংবাদ হলেও এখনই এর প্রভাব পড়বে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডনে থাকাটাও বাংলাদেশিদের এই সাফল্যের পেছনে একটি বড় কারণ। আশির দশকের মধ্যভাগ থেকেই বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি শিথিল করায় লন্ডনের অর্থনীতিতে পুনর্জাগরণ হয়। ব্রিটেনে থাকা অন্য জাতি হিসাব করলে বাংলাদেশিরাই সবচেয়ে বেশি রাজধানীকেন্দ্রিক। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের ৫৫ শতাংশ বাংলাদেশিই লন্ডনে থাকে, যা আর কোন জাতির মধ্যে দেখা যায় না। ফলে অর্থনৈতিক কেন্দ্রের আশেপাশে থাকায় বাংলাদেশিরা এর সুবিধা পেয়েছে। অভিবাসীদের এই সাফলের পেছনে মূলত অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা অঞ্চলের একটি সংযোগ রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, তবে সত্যিকারের সাফল্যের পথ অনেক দীর্ঘ। ব্রিটেনে এখনও ২৪ শতাংশ বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের ভাতা পেয়ে থাকে, যেখানে অন্যান্য সম্প্রদায়ের গড় ১৬ শতাংশ। অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্রিটিশদের তুলনায় বাংলাদেশিদের গড় সম্পদ মাত্র এক-পঞ্চমাংশ।
অন্যদিকে, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ এবং ভারতীয় নারীদের তুলনায় বাংলাদেশি নারীরা বেশ পিছিয়ে রয়েছে, অর্ধেকেরও কম বাংলাদেশি নারী অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় নয়। ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের একটি সংগঠন বাংলাদেশি উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের সৈয়দা খাতুন বলেন, ‘প্রথম দিকের অভিবাসীরা কখনোই বাড়ির বাইরে কাজ করত না। এখন মায়েরাও বাইরে কাজ করে। আপনি একজন ব্যক্তির আয়ের উপর নির্ভর করে কখনোই উন্নতি করতে পারবেন না।’