লণ্ডন, ১৩ ডিসেম্বর: চীনের উইঘুর মুসলমানদের গণহত্যার প্রতিবাদ এবং ন্যায়বিচারের জন্য আইনি প্রক্রিয়াকে সহায়তার লক্ষ্যে ৬ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় লণ্ডন মুসলিম সেন্টারে এক বিশেষ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
প্রায় আড়াইশ মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সমাবেশে উইঘুর সম্প্রদায়ের ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। করডোবা ফাউণ্ডেশনের সিইও ড. আনাস আল তিকরিতির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন লণ্ডনের টেম্পল গার্ডেন চেম্বারের আইনজীবী ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে উইঘুর মুসলিমদের প্রতিনিধি রডনি ডিক্সন কেসি, উইঘুর মুসলিম লীডার কবি ও একাডেমিক আজিজ ইসা এলকুন, যুক্তরাজ্যে চায়না বিষয়ক আন্ত-সংসদীয় জোটের কো-চেয়ার ব্যারোনেস হেলেনা ক্যানেডি কেসি, আমেরিকার বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার শায়খ ড. ইয়াসির ক্বাদী ও চায়নার উইঘুর মুসলিমদের বন্দিশিবির থেকে বেঁচে আসা নারি সায়রাগুল সয়ুতবি। শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করেন ইমাম জায়ের, যিনি পূর্ব তুর্কিস্তানের শায়ারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে তার শহর ছেড়ে চলে যান এবং নিপীড়নের ভয়ে আর ফিরে আসেননি। কুরআন তেলাওয়াতের পর অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ইস্ট লণ্ডন মস্ক এবং লণ্ডন মুসলিম সেন্টারের ফাইন্যান্স এণ্ড এনগেজমেন্ট ডিরেক্টর দেলওয়ার খান। সমাবেশে ফাণ্ডরেইজিং পর্ব পরিচালনা করেন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক ইমাম আজমল মাসরুর। এতে ৫৪ হাজার পাউণ্ড সংগৃহিত হয়।
উল্লেখ্য, উইঘুররা একটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী যারা প্রথমদিকে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাস করে। শুধু ইসলাম ধর্ম চর্চার কারণে চীন সরকার তাদের টার্গেট করেছে, যা চীনে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃত নয়। চীন সরকার হাজার হাজার উইঘুর মুসলিমকে বন্দিশিবিরে আটক রেখেছে। উইঘুর নারীরা জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ এবং ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। পূর্ব তুর্কিস্তানের বাসিন্দা কবি ও শিক্ষাবিদ আজিজ ইসা এলকুন ভিডিও লিংকে প্রদত্ত বক্তব্যে বলেন, “চীনের লকডাউন নীতির কারণে সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডে ৪৪ জন উইঘুর মারা গেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও শিশু ছিলো। উইঘুরদেরকে একটি ভবনে আটকে রাখা হয়েছিল এবং সেখান থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। তাদেরকে পুড়িয়ে মারা হয়।”
ব্যারোনেস হেলেনা কেনেডি কেসি ভিডিও বার্তায় বলেন, উইঘুর জনগণের বিরুদ্ধে যা সংঘটিত হচ্ছে তা ‘গণহত্যা’। হাউজ অর্ব লর্ডসের সদস্য হিসেবে তাঁর কাজ হচ্ছে চীনের এই অপরাধ উন্মোচন করা। তিনি উইঘুরদের প্রতি এই নৃশংস আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, “নারীদেরকে জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ, নিজেদের বাড়িতে এবং পুলিশি হেফাজতে ধর্ষণ চলছে। পরিবার থেকে শিশুদের তুলে নিয়ে এমন স্কুলে পড়ানো হচ্ছে যেখানে ইসলাম ধর্ম শেখার কোনো সুযোগ নেই। ব্যারোনেস কেনেডি আরও বলেন, উইঘুরদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে চীন তাকে ‘নিষেধাজ্ঞা’ দিয়েছে। তিনি চীনে গেলে গ্রেপ্তার তো হবেনই, উপরন্ত যেসব দেশের সাথে চিনের শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে সেসব দেশে গেলেও গ্রেপ্তার হতে পারেন। টেম্পল গার্ডেন চেম্বার্সের আন্তর্জাতিক আইনজীবী রডনি ডিক্সন কেসি, যিনি বর্তমানে চায়না থেকে নির্বাসিত উইঘুরদের পক্ষে কাজ করছেন। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উইঘুরদের গণহত্যার হোতাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য লড়ছেন। ডিক্সনের লিগেল টিম তাজিকিস্তান, কিরগিস্তান এবং উজবেকিস্তান ঘুরে এসব দেশে নির্বাসিত উইঘুর গণহত্যার সাক্ষী এবং ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করছে। ডিক্সন বলেন, “আমরা এখানে এমন একটি ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা তুলে ধরছি, আমরা একদিকে এখানে কথা বলছি, অন্যদিকে গণহত্যা চলছে। এই গণহত্যা ধাপে ধাপে অত্যন্ত পরিশীলিতভাবে চালানো হচ্ছে। ডিক্সন আরো বলেন, “আমরা দেখেছি কিভাবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সংবাদ মিডিয়ায় শিরোনাম হয়। কিন্তু চিনে উইঘুর গণহত্যার ঘটনা মিডিয়ায় শিরোনাম হয় না। আমাদেরকে এটি সংবাদের শিরোনামে নিয়ে যেতে হবে। যদিও এটিকে সেই স্তরে পৌঁছানো কঠিন হবে। তবে আমাদের এটিকে যতটা সম্ভব বিশ্ববাসীর নজরে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ভিডিও বার্তায় শায়খ ইয়াসির কাদি বলেন, “যদি আমরা উইঘুরদের সেই যন্ত্রণা অনুভব না করি, তাহলে কীভাবে আমরা নিজেদেরকে কিছু করতে অনুপ্রাণিত করব। যদি আমরা তাদের কষ্ট অনুভব করতে না পারি, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের ঈমান সুদৃঢ় নয়।”
ড. আনাস আল তিকরিতি বলেন, সকলের সহযোগিতায় আমরা আজ ৫৪ হাজার পাউণ্ড সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। এই অর্থে বিশিষ্ট আইনজীবী রডনি ডিক্সনের লিগেল টিম বিভিন্ন দেশ ঘুরে নির্বাসিত উইঘুরদের খুঁজে বের করে গণহত্যার সাক্ষ্য এবং তথ্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করবে। যাতে তিনি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে (আইসিসি) চলমান আইনী লড়াইয়ে চিনের বিরুদ্ধে জিততে পারেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি