পাচার করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ
বিতর্ক পত্রিকা ডেস্ক লণ্ডন, ১৩ জুন: ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পাচার করা অর্থ সামান্য কর দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছেন। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এমন সুযোগ দিয়ে সরকার দুর্নীতি ও অর্থ-পাচারকে আরও উতসাহিত করেছে। বাজেটে ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাত ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করে অর্থ দেশে ফিরিয়ে বৈধ করা যাবে। পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলার নিয়ে সংকটের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার নতুন অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, সেখানে ৭ শতাংশ কর দিয়েই এসব অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে অর্থমন্ত্রী যে আশায় দেশে প্রথমবারের মতো এ ধরনের সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, সেই আশা পূরণ হবে না বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁদের মতে, বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আসবে না। উ?ো এর মধ্য দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারকেই বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর একে ‘উদ্ভট নীতি’ আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটি উর্বর মস্তিষ্কের আবিষ্কার। কোনো টাকা আসবে না। এ ধরনের সুযোগ দেওয়া আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। দেশ থেকে টাকা পাচার করাকে প্রত্যক্ষভাবে বৈধ করা হলো।’ ‘আরেকটা উদ্ভট নীতি নেওয়া হলো। এটি উর্বর মস্তিষ্কের আবিষ্কার। কোনো টাকা আসবে না। এ ধরনের সুযোগ দেওয়া আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ।’ এটা কোন ধরনের নীতি- সেই প্রশ্ন ছুড়ে আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, কালোটাকা তো দেশের ভেতরে থাকে। কোন নির্বোধ দেশে টাকা বা সম্পদ ফিরিয়ে আনবেন? কারণ, তিনি অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেছেন। বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগকে বেআইনি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, ৭ শতাংশ কর পরিশোধের মাধ্যমে পাচার করা টাকা ফেরত আনার প্রস্তাব অনৈতিক ও বেআইনি। মুদ্রা পাচারকারী দেশদ্রোহীদের অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। অর্থমন্ত্রীকে এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। এ সুবিধা বেআইনি ও অনৈতিক বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। ফরাসউদ্দিন বলেন, প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিত্তবান, ব্যবসায়ী, মুনাফাভোগী ও অর্থ পাচারকারীদের স্বার্থ দেখা হয়েছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কিছু রাখা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, দেশের অর্থনীতিতে অভিবাসীদের অবদান বিবেচনায় তাঁদের প্রতি আরও সদয় হতে হবে। রেমিট্যান্সের ওপর আড়াই শতাংশ প্রণোদনার সুযোগে মানি লণ্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা উপকৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে নানা দেশে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হওয়ার খবর বিভিন্ন সময় এসেছে। গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচার নিয়ে প্রতিবেদনে বলেছে, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের মাধ্যমে মূল্য কমুবেশি দেখিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। জিআইএফ বলেছে, বাংলাদেশের অন্য দেশের যত আমদানি-রপ্তানি হয়, এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশে মূল্য ঘোষণায় গরমিল থাকে। কানাডায় ‘বেগমপাড়া’ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে। বিভিন্ন দেশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন অনেকেই। সিঙ্গাপুরে পাঁচ তারকা হোটেল, দুবাইয়ে আলিশান বাড়ি করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে নগদ অর্থও অনেকে রেখেছেন বলে বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে। সম্প্রতি আলোচিত পি কে হালদার ভারতে আটক হওয়ার পর এসব বিষয় আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। যে ঘোষণা এল বাজেটে বাজেট প্রস্তাবমতে, কেউ যদি বিদেশ থেকে অর্থ আনেন (মোটা দাগে পাচার করা অর্থ), তাহলে ৭ শতাংশ কর দিলেই হবে- এমন প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ বিদেশের ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ বা বিদেশে থাকা সম্পদ বিক্রি করে ওই অর্থ কর দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। এক বছরের জন্য এই বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কেউ এই সুযোগ নিলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তো কোনো প্রশ্ন করবে না; দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্য কোনো সংস্থাও প্রশ্ন করবে না। প্রস্তাব অনুযায়ী, বিদেশে অবস্থিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং বিদেশে অবস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে এর ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। ওই করদাতা বাংলাদেশে তাঁর আয়কর নথিতে ওই অর্থ ও সম্পদের ঘোষণা দেবেন। এ জন্য আয়কর অধ্যাদেশে ১৯-এফ নামে একটি ধারা সংযোজন করা হয়েছে। ১৯ ধারায় সাধারণত কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগামী ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছরের জন্য এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলেছে, করদাতারা এই সুযোগ নিয়ে বিদেশে থাকা অর্থ দেশে ফেরত আনলে তা রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হবে। পরবর্তীকালে এ ধরনের সম্পদ হতে কর আহরণ অব্যাহত থাকবে এবং রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাবে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘প্রস্তাবিত বিধান কার্যকর হলে অর্থনীতির মূল স্রোতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, রাজস্ব আহরণ বাড়বে; আর করদাতারাও বিদেশে অর্জিত অর্থ-সম্পদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শনের সুযোগ পেয়ে স্বস্তিবোধ করবেন।’ টাকা ও সম্পদ ফিরিয়ে আনা সহজ নয় বাংলাদেশে নিরাপদ মনে করেননি বলেই বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। তাঁরা স্বেচ্ছায় সেই অর্থ বা সম্পদ আনতে উৎসাহিত হবে না- এমনটাই বলছেন অর্থনীতিবিদেরা। বিদেশে যদি অবৈধভাবে ওই অর্থ বা সম্পদ থাকে, তাহলে ওই অর্থ বা সম্পদ আনতে গেলে ওই সব দেশের সরকারের আইনি বাধার মুখে পড়তে হবে। আবার বাংলাদেশের কর কর্মকর্তারা যদি পাচার করা অর্থ ও সম্পদের সন্ধান পান, সেই অর্থ ও সম্পদ ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘ আইনি জটিল প্রক্রিয়া আছে। এর আগে বিভিন্ন দেশ এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েও সফল হয়নি। সে ক্ষেত্রে যে দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, ওই দেশ থেকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ৪৫ হাজার নাগরিকের সুইস ব্যাংকে ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পায়। তখন সুইজারল্যাণ্ড সরকারকে ওই সব নাগরিকের অর্থ ফিরিয়ে দিতে বলে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সুইজারল্যাণ্ড উ?ো যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্রস্তাব দেয়, ওই টাকার ওপর আরোপিত কর আদায় করে দেবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র রাজি হয়নি। পরবর্তী সময়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় সুইজারল্যাণ্ড। ২০১৭ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও এ ধরনের সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু খুব বেশি সাড়া মেলেনি। বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনা প্রসঙ্গে অর্থ পাচার রোধে কাজ করা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সাবেক প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যিনি বিদেশে অর্থ নিয়ে গেছেন, তিনি স্বপ্রণোদিতভাবে চাইলে উন্নত দেশগুলো থেকে অর্থ ফেরত আনতে পারবেন। কারণ, ওই দেশগুলো থেকে টাকা পাঠাতে আইনি বাধা নেই। তবে ওই দেশগুলোতে অর্থের বৈধতা, অপরাধ ও কর ফাঁকির অভিযোগ থাকলে ফেরত আনা কঠিন।’