মামলা নিতে চায়নি পুলিশ
পত্রিকা রিপোর্ট:
লন্ডন, ১৯ সেপ্টেম্বর: মৃত মায়ের ওসিয়ত পালন করতে গিয়ে জীবননাশের হুমকির মুখে রয়েছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বড়লেখার ফয়জুর রহমান। মায়ের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সমাজকর্ম তথা মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা পরিচালনাসহ বিভিন্ন চ্যারিটি কাজে নিজের জীবন সপে দিলেও কতিপয় আত্মীয়–স্বজনের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না তিনি।
গত আগস্টে তাকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যার অপচেষ্টা পর কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন ব্রিটেনে। মাদ্রাসা পরিচালনার স্বার্থে বিভিন্ন সময় তাকে বাংলাদেশে যেতে হয়। কিন্তু এবারে তাঁর ওপর হামলার ঘটনার পর তাঁর পরিবার ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছেন। ছেলেরা বলছে, তারা কোনোদিন বাংলাদেশে যাবে না। তাকেও আর বাংলাদেশে যেতে বারণ করেছে। আগস্ট মাসের গোড়ার দিকে তাঁর ওপর সংঘটিত হত্যা চেষ্টার মামলাটি মামলা নিতে চায়নি পুলিশ। পরে আদালতের আদেশে মামলা নিলেও আসামী গ্রেফতারের ব্যাপারে কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। এদিকে, মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশ বুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতো বড় ঘটনার পর এখনো কোনো গ্রেফতার নেই। তাই তিনি মনে করছেন, বাংলাদেশে তাঁর জীবন ঝুঁকির মুখে। গত শুক্রবার লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে আমি এবার কোনোভাবে বেঁচে এসেছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গেলে হয়তো ফিরেই আসতে পারবো না।
তিনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে নিজের জনমালের নিরাপত্তা দাবী করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে ফয়জুর রহমান লিখিত বক্তব্যে বলেন, আমি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা এফআর মহিউসসুন্নাহ একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ট্রাস্টি, বড়লেখা সুড়িকান্দি দারুল উলুম কাওমী মাদ্রাসা ইউকে চ্যারিটির ট্রাস্টি ও চেয়ারম্যান, বড়লেখা হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রাঃ) ও নেকরুজা খাতুন ইসলামিক প্রাইমারি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বড়লেখা সরকারি কলেজের দাতা সদস্য, দাসের বাজার কলেজের দাতা সদস্য, ঈদগাহ বাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভূমি দাতা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। বাংলাদেশে আমার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার দাসেরবাজার ইউনিয়নের সুড়িকান্দি রসগ্রাম গ্রামে। তবে বড়লেখা পৌরসভার হাটবন্দ এলাকায় প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের ৩ তলা বিশিষ্ট একটি বাসা রয়েছে। বাসার পাশে আমার নিজস্ব জায়গায় নির্মিত ৫তলা বিশিষ্ট মহিউসুন্নাহ একাডেমি রয়েছে। মাদ্রাসাটির নিচতলায় মসজিদ এবং উপরের ৪ তলায় মাদ্রাসা। উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে পরিবারের সাথে এদেশে পাড়ি জমান ফয়জুর রহমান। তিনি বর্তমানে টাওয়ার হ্যামলেটসের মাইল এন্ড এলাকায় সপরিবারে বসবাস করেন। ১৯৭৫ সালে টাওয়ার হ্যামলেটস ইয়ুথ মুভমেন্ট অর্গানাইজেশনের সাথে সম্পৃক্ত হন। শুরুতে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পরবর্তীতে এই সংগঠনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে বড়লেখা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ইউকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বড়লেখা ফাউÐেশন ইউকের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ও স্থানীয় মাজাহিরুল উলুম মসজিদ এÐ মাদ্রাসার ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সংবাদ সম্মেলনে পঠিত লিখিত বক্তব্যে তিনি ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে?বলেন, মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য আমি সময় সময় বাংলাদেশে যাই।এরই ধারাবাহিকতায় গত ৭ জুন আমি বাংলাদেশ যাই। ৫ আগস্ট ভোর পৌনে ৫টার দিকে ফজরের নামাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হই। মসজিদের কাছাকাছি পৌছামাত্র এক অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী আমাকে লক্ষ্য করে আমার মাথায় ধারালো দা দিয়ে কোপ মারে। দা’র কোপটি ভাগ্যক্রমে মাথায় না লেগে আমার বাম কাঁধে বিদ্ধ হয়। দ্বিতীয় কোপটি আমার বাম হাতের বাহুতে বিদ্ধ হলে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম হই। এসময় বুকের বাম পাশেও মারাত্মক জখম হয়। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চিৎকার করে তাকে ধরার চেষ্টা করি। তখন সে ‘আর এক পা এগুলে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলার’ হুমকী দিয়ে পালিয়ে যায়। তখন আমার চিৎকার শুনে মুসল্লি ও পথচারিরা দৌডয় এগিয়ে এসে মারাত্মক জখম অবস্থায় আমাকে বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেন। আমার কাঁধে ৫টি সেলাই ও বাম হাতের বাহুতে ১০টি সেলাই লাগে। আমি ৫ ও ৬ আগস্ট দুইদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। অবশ্য ৫ আগস্ট সকালে হাসপাতালে চিকিৎসার পর শারিরীক অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে ৯৯৯ নাম্বারে কল করি। কল করার ১৫ মিনিটের মধ্যে পুলিশ হাসপাতালে পৌঁছে এবং আমার কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ শুনে।
কিন্তু হামলার ঘটনায় মামলা নেয়নি। কোনো সহযোগিতাও করেনি। ফয়জুর রহমান বলেন, ৬ই আগস্ট বিকেলের দিকে হাসপাতাল থেকে আমাকে ডিসচার্জ করা হয়। শারিরীকভাবে দুর্বল থাকায় আমি পরদিন থানায় যেতে পরিনি। ৮ আগস্ট বড়লেখা থানায় যাই এবং ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ইয়ারদৌস হাসানের সাথে কথা বলে মামলা দায়ের করার চেষ্টা করি। কিন্তু থানা পুলিশ আমার মামলা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে। এরপর ১৪ আগস্ট আমি বড়লেখা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজেস্ট্রেট আদালতে আমাকে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় মামলা করি। (মামলা নাম্বার সিআর ৩৩৯/২০২৩)। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে থানায় পাঠালে বড়লেখা থানা মামলা এফআইর করে আরো একটি মামলা রুজ করে । (মামলা নং জিআর ১২৩/২০২৩)। এই মামলার প্রধান আসামী বড়লেখা সুড়িকান্দি রসগ্রামের হবিব আলীর ছেলে খয়রুল ইসলাম (৩০), দ্বিতীয় ও তৃতীয় আসামী যথাক্রমে একই গ্রামের আমার মরহুম বড় ভাই শফিকুর রহমানের স্ত্রী শফি আক্তার খানম ও তাঁর ছেলে নাদের আহমদ। প্রধান আসামী খায়রুল ইসলাম হচ্ছেন শফি আক্তার খানম ও তার ছেলে নাদের আহমদের রসগ্রামের বাড়ির পাহারাদার। মূলত নাদের আহমদ ও তার মা আমার তিন তলা বাসা ও মাদ্রাসা ভবন দখলের উদ্দেশ্যে আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন এবং প্রধান আসামী খায়রুল ইসলামকে আমাকে হত্যার জন্য ভাড়া করেন বলে আমি মামলায় উল্লেখ করি। কারণ এই নাদের আহমদ আমার বাসা ও মাদ্রাসা দখলের চেষ্টায় বিভিন্ন সময় আমাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকি দিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময় তার হুমকির ঘটনায় আমি তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করি। তিনি বলেন, নাদের আহমদ ও তার মা–সহ পরিবারের সকলে মিলে পারিবারিক বাটোয়ারাভিত্তিক প্রাপ্ত দত্তরমহল মৌজায় আমার ভাগের ১৫ শতক জায়গা অবৈধভাবে বিক্রি করে টাকা আত্মসাত করে।
এ ঘটনায় ৫ জানুয়ারি ২০২৩ আমি তাদের বিরুদ্ধে বড়লেখা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজেস্ট্রেট আদালতে মামলা করি। (মামলা নং সিআর ৫/২০২৩) ৩ আগস্ট ২০২২ তারিখে নাদের আহমদ তার সহযোগীদের নিয়ে স্থানীয় গোয়ালটাাবাজারে আমার অর্থায়নে নির্মাণাধীন আয়শা সিদ্দিকা (রাঃ) এণ্ড নেকরুজা খাতুন মহিলা মাদ্রাসার অনেকগুলো পিলার ভেঙ্গে ফেলে। ওই ঘটনায় নাদের আহমদসহ ৯ জনকে আসামী করে ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে মামলা করি। (মামলা নং সিআর ২৬/২০২৩) এছাড়া রসগ্রাম মৌজায় আমার মালিকানাধীন ৭ শতক জায়গা অবৈধভাবে বিক্রি করে টাকা আত্মসাত করার ঘটনায় ৩০ জুলাই ২০২৩ তারিখে নাদের আহমদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা করি। (মামলা নং সিআর ৩৩৪/২০২৩) প্রধান আসামী হামলাকারী খয়রুল ইসলামকে আমি চিনি। যেহেতু সে নাদের আহমদের গ্রামের বাড়িতে পাহারাদার হিসেবে চাকরি করে এবং আমার বাড়িও একই গ্রামে তাই যখন বাংলাদেশে যাই তার সাথে কথাবার্তা হয়। হামলার সময় আমি তার কণ্ঠস্বর শনাক্ত করে সক্ষম হই। এখন তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলেই আমাকে হত্যার পরিকল্পাকারিদের নাম বেরিয়ে আসবে। সংবাদ সম্মেলনে পঠিত লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, আমি একজন সহজ–সরল মানুষ। স্ত্রী–সন্তান নিয়ে আমি এদেশে শান্তিতে বাস করছি। আমার মা নেকরুজা খাতুন মৃত্যুর সময় আমাকে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে ওসিয়ত করেছিলেন। তার ওসিয়ত পালন করতে গিয়ে ২০০৪ সালে মায়ের মৃত্যুর পর থেকে বাকি জীবন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও চ্যারিটি কাজে উৎসর্গ করে দিই।
যুক্তরাজ্যে বসবাস করলেও আমার মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে। মাদ্রাসা পরিচালনার স্বার্থে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে গিয়ে থাকি। কিন্তু এই হামলার ঘটনার পর আমার পরিবার ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছেন। আমার ছেলে সন্তানরা তো কোনোদিনও বাংলাদেশে যাবেনা, আমাকেও না যেতে বারণ করেছে। আমিও মনে করি, আমার জীবন ঝুঁকিপুর্ণ। আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে আমি কোনোভাবে বেঁচে এসেছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গেলে হয়তো ফিরেই আসতে পারবো না। বর্তমানে হত্যা চেষ্টা মামলাটি মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশ বুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসামী গ্রেফতারের ব্যাপারে কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। সংবাদ সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে দাবী জানিয়ে তিনি বলেন, অবিলম্বে প্রধান আসামীকে গ্রেফতার করে রিমাণ্ডে নিয়ে হত্যার পরিকল্পনাকারিদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। ফয়জুর রহমান তাঁর ওপর হামলার বিবরণ জনসমক্ষে তুলে ধরে ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে মিডিয়া তাঁর পাশে দাঁড়াবে বলে আশা প্রকাশ করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন তাঁর ছেলে সিদ্দিক মোহাম্মদ রহমান এবং মাইল এন্ড ওয়ার্ডের কাউন্সিলের কাউন্সিলার রাইহান মোঃ চৌধুরী ও ফখরুল ইসলাম।