সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা আদালতে খারিজ
চার বছরে সংগঠনের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ২ কোটি টাকা
অনতিবিলম্বে ট্রাস্টের বিজিএম ঘোষণার আহবান
পত্রিকা প্রতিবেদন:
লণ্ডন, ২৫ সেপ্টেম্বর: বিশ্বনাথ প্রবাসী এডুকেশন ট্রাস্টের সাবেক কমিটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বর্তমান কমিটির দায়ের করা মামলা খারিজ করে দিয়েছে বাংলাদেশের আদালত। বাংলাদেশে সংগঠনটির নিবন্ধন বেআইনী দাবী করে বর্তমান কমিটির চেয়ারপার্সন মতছির খান হাইকোর্টে তা বাতিলের জন্য দলিল সম্পাদনকারীদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে রিট দাখিল করেছিলেন। পাশাপাশি সেক্রেটারী মিছবা উদ্দিন নিবন্ধন বাতিলের আর্জি জানিয়ে কাছাকাছি সময়ে সাবেক চেয়ারপার্সন মির্জা আসহাব বেগ ও সাবেক সেক্রেটারি নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সিলেট জজকোর্টেও আরেকটি মামলা দায়ের করেন।
দীর্ঘ চার বছর পর গত বছরের ০৪ ফেব্রুয়ারী ঢাকা হাইকোর্ট বাংলাদেশে সংগঠনটির নিবন্ধন আইনসম্মত বলে সাবেক কমিটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের পক্ষে রায় দেয় এবং সে সময়ে মামলার শুনানি থেকে বাদী মতছির খান তার মামলা প্রত্যাহার করেন।
সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট জজকোর্টে দায়ের করা মামলাও খারিজ করে দিয়েছেন বিচারক। রায়ে ট্রাস্টের রেজিষ্ট্রেশন আইনসম্মত হিসেবে উল্লেখ করে এই রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ট্রাস্ট বাংলাদেশে বৈধভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে বলে বিচারক পর্যবেক্ষণ দেন। গত ২২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার পূর্ব লণ্ডনের গ্রেটারেক্স স্ট্রিটের মাইক্রো বিজনেস সেন্টার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে সংগঠনের ২০১৪-১৬ সালের মেয়াদে নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ বলেছেন, অতীতের তিক্ততা ভুলে একমত হয়ে একযোগে আমাদের প্রাণের এই সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। এখন যথাশীঘ্র বোর্ডের পদত্যাগকারী চারজন সদস্যকে ডেকে নিয়ে ১৭ সদস্য একত্রিত হয়ে অনতিবিলম্বে ট্রাস্টের বিজিএমের তারিখ ঘোষণার আহবান জানান নেতৃবৃন্দ। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল মজিদ, প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মোঃ রইছ আলী, সাবেক সহ-সভাপতি মনির উদ্দিন বশির, আবুল কালাম আজাদ, বর্তমান কমিটির সহ কোষাধ্যক্ষ আব্দুল ওদুদ সাহেল, সদস্য মোঃ ফারুক মিয়া, মনির আহমদ, মোঃ গুলজার খান, মোহাম্মদ সুফান আলী বারি, সাবেক প্রেস সেক্রেটারি মোহাম্মদ ওয়াহিদ আলী, ট্রাস্টি আব্দুস সোবহান এবং আব্দুর রহিম রঞ্জু প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলন লিখিত বক্তব্য?পাঠ করেন ২০১৪-১৬ মেয়াদের নির্বাচিত চেয়ারপার্সন মির্জা আসহাব বেগ। উপস্থিত সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা আসহাব বেগ জানান, এই মামলা লড়তে গিয়ে?তাদের ব্যক্তিগত প্রায় ১০ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তিন দশক আগে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্বনাথ প্রবাসী এডুকেশন ট্রাস্টের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিগত চার বছর ধরে সংগঠনের ট্রাস্টি সংগ্রহ করা হয়নি। অথচ এই চার বছরে প্রতি বছর কম করে হলেও ৫০ জন ট্রাস্টি নিলে সংগঠনে আরো অন্তত দুই কোটি টাকা আসতো। সেই হিসেবে এতদিনে সংগঠনের প্রায়?২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর এজন্য তারা দায়ী করেছেন নেতৃত্বের দ্বন্দ্বকে।
লিখিত বক্তব্যে মির্জা আসহাব বেগ বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশে ট্রাস্টের নিবন্ধনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছিলো। এরই অংশ হিসেবে ২০১৪-১৬ নির্বাচনের পর বাংলাদেশে ট্রাস্টের নিবন্ধনের বিষয়টি বোর্ডের প্রথম এজেণ্ডা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পরবর্তীতে আরো একাধিক বোর্ড মিটিংয়ে এনিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর বার্র্মিংহামে অনুষ্ঠিত এজিএম-এ উপস্থিত ট্রাস্টিদের মতামতের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ট্রাস্টের নিবন্ধনকে অনুমোদিত হয়। সে মোতাবেক আমরা (ট্রাস্টের চেয়ার এবং সেক্রেটারি) বাংলাদেশে গিয়ে আইনজীবির পরামর্শ অনুযায়ী ট্রাস্ট এ্যাক্টের আওতায় আমাদের সংগঠনের নিবন্ধন সম্পন্ন করি। ঐ সময়ে বাংলাদেশে অবস্থানকারী আরো পাঁচজন ট্রাস্টি রেজিস্ট্রেশন সম্পাদনকারী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন। নিবন্ধনের পর দেখা যায়?কিছু ট্রাস্টি রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্ট নন। তারা এটি বেআইনিভাবে করা হয়েছে বলে দাবী করেন এবং চেয়ারাপার্সন ও সেক্রেটারি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগঠনের দশ লাখ টাকা উত্তোলন করে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছি বলে অভিযোগ আনেন।
লিখিত বক্তব্যে মির্জা আসহাব বেগ এই দ্বন্দ্ব অবসানে একাধিক উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই বির্তক নিরসনকল্পে ৩ সদস্য বিশিষ্ট মেডিয়েশন কমিটি গঠন করা হয় এবং এর ধারাবাহিকতায় আমরা দুইটি বিশেষ সাধারণ সভা করি। এর মাঝে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট এসজিএম-এ বাংলাদেশ থেকে প্রদত্ত আইনী পরামর্শের ভিত্তিতে সমস্যার সাময়িক সুরাহা হয় এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনে সবার অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই মাঝে ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাস্টের বিজিএমে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে মতছির খান সভাপতি, মিছবাহ উদ্দিন সেক্রেটারি ও আজম খানকে ট্রেজারার করে ২০১৭-১৯ সালের জন্য বোর্ড অব কমিটি গঠন করা হয়। ঐ বিজিএমেও ট্রাস্টের নিবন্ধন নিয়ে অযথা প্রোপাগাণ্ডা চালানো হয়।
নির্বাচনের পরও আবার যথারীতি নিবন্ধনের বিষয়টি নিয়ে বোর্ড সদস্যরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে নতুন কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পর বিদায়ী বোর্ড কমিটির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রথমে যুক্তরাজ্যে সলিসিটর নোটিশ প্রদান করে। এই নিয়ে বোর্ডে তীব্র বাদানুবাদ পর সেক্রেটারি মিছবাহ উদ্দিনকে সাসপেণ্ড করা, নতুন সংবিধান অনুমোদনসহ সংবিধানের বিপরীতে কাজ করার চেষ্টা করা হয়। এসবে প্রেক্ষিতে চারজন বোর্ড মেম্বার ভাইস চেয়ার সাজ্জাদুর রহমান, সহকারী ট্রেজারার আবদুল ওদুদ সাহেল, বোর্ড অব মেম্বার মো. ফারুক মিয়া এবং মো. কবির মিয়া পদত্যাগ করেন। পরে ২০১৯ সালের অক্টোবরে একটি ট্রাস্টি সভার মাধ্যমে বর্তমান কার্যকরী কমিটিকে বিভিন্ন সংবিধানবিরোধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা এবং দ্রুত নির্বাচন সম্পন্নের অনুরোধ জানানো হয়। এতেও কোনো কাজ না হওয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে মিডিয়েশন কমিটির সর্বশেষ সভা ০৮/০৭/২০১৯ তারিখে ব্রিকলেন মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়।
এই সভায় দুই পক্ষের ট্রাস্টি ও সাবেক সংসদ সদস্য জনাব শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব মুহিবুর রহমান ও প্রধান মেডিয়েটর জনাব পংকি খান (মরহুম) উপস্থিত ছিলেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ আপোস এবং চারটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর কয়েক মাস পর হঠাৎ বর্তমান কমিটির চেয়ার জনাব মতছির খান সাবেক চেয়ার, সেক্রেটারিসহ দলিল সম্পাদনকারীদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে নিবন্ধনটিকে অবৈধ উল্লেখ করে তা বাতিলের জন্য রিট দাখিল করেন। (রিট নং ৯৬৯১/২০১৯)। এর মাসখানেক পর বর্তমান কমিটির সম্পাদক মিছবা উদ্দিন নিবন্ধন বাতিলের আর্জি জানিয়ে সিলেট জজকোর্টে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। (মামলা নং ৫১/২০)। এই মামলায় বাদি বিবাদিদের কাছ থেকে মামলার সমুদয় খরচ আদায়ের জন্যও আর্জিতে উল্লেখ করেন তিনি। এই দুই মামলার পাশাপাশি অবৈধভাবে ট্রাস্ট রেজিস্ট্রেশন ও দশ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে বিভিন্ন মিডিয়ায় আগের কমিটির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং একটি প্রেস কনফারেন্সও করেন।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, এ বিষয়টি আদালতে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে বর্তমান কমিটি কোনো ট্রাস্টি মিটিং করে তার অনুমোদন গ্রহণ করেননি। এছাড়া ইতোমধ্যেই (৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে) তাদের মেয়াদ দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও মামলার অজুহাত এবং এর পূর্বে কোভিডের অজুহাত দেখিয়ে তারা ৪ বছর পর্যন্ত নির্বাচন না দিয়ে বোর্ডের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আসহাব বেগ বলেন, আমাদের ওপর দুই দুইটি মামলা দায়ের করা সত্ত্বেও আমরা অনেক ধৈর্য্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। ট্রাস্টের ক্ষতি হতে পারে এই ভেবে কখনোই আমরা এ নিয়ে প্রচারণা করিনি। আমরা বিশ্বাস করি যে, ঐক্য এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থানই একটি সংগঠনকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছায়। সংগঠনে বিরোধ থাকতে পারে, মতের অমিল হতে পারে।
তবে আমরা মনে করি ট্রাস্টিদের সাধারণ সভার মাধ্যমে যেকোনো বিরোধ নিরসন সম্ভব হবে। আল্লাহর দরবারে হাজার শুকরিয়া, বিগত ০৪/০২/২০২২ তারিখে ঢাকা হাইকোর্টে মামলার রায় আমাদের পক্ষে আসে, ঐ সময়ে মামলার শুনানি থেকে বাদী মতছির খান তার মামলা প্রত্যাহার করেন। এদিকে ২৭/০৮/২৩ তারিখে সিলেট জজকোর্টের মামলার রায়ে বিচারক ট্রাস্টের রেজিষ্ট্রেশন আইনসম্মত হিসেবে উল্লেখ করে মামলাটি খারিজ করেন। উপরন্তু বিচারক মহোদয় এই রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ট্রাস্ট বাংলাদেশে বৈধভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে বলে আইনি অভিমত ব্যক্ত করেন। সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আসহাব বেগ বলেন, আমরা সংগঠনের ট্রাস্টি ও বিশ্বনাথবাসীকে বলতে চাই, বিগত চার/পাঁচ বছরে আমাদের প্রাণপ্রিয় সংগঠনের কর্মযাত্রা নানা কারণে বিঘ্নিত হয়েছে, আমাদের প্রাণপ্রিয় ট্রাস্টের বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
এই সময়ে যে সকল ট্রাস্টি ও বোর্ডের চারজন সম্মানিত সদস্যসহ শুভাকাঙক্ষী আমাদের সহযোগিতা করেছেন, সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমরা সংগঠনের স্বার্থকে সব সময় বড় করে দেখেছি। আমাদের আর পেছনের পথে হাঁটা কিংবা হিংসাত্মক কাজে ফিরে তাকাবার সুযোগ নেই। তাই বর্তমান কমিটির কাছে অনুরোধ করছি- আপনারা এখন যথাশীঘ্র বোর্ডের পদত্যাগকারী চার সদস্যকে ডেকে নিয়ে সবাই একত্রিত হয়ে দ্রুত ট্রাস্টের বিজিএমের তারিখ ঘোষণা করুন।