লণ্ডন,০৯ অক্টোবর: যুক্তরাজ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শিক্ষাবিদ নিখিলেশ চক্রবর্তী ৮৩তম জন্মদিনে সম্প্রতি বন্ধু-স্বজনদের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন। নিখিলেশ চক্রবর্তী ব্রিটিশ মূলধারার প্রাথমিক স্কুলের প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে লণ্ডনের একটি বৃদ্ধাশ্রমে জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করছেন।
একাত্তরে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে বিশ্বজনমত সংগ্রহে বিরামহীন সংগ্রামরত এই মানুষটি এখন নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন। গত বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে এগারটায় নিখিলেশ চক্রবর্তীর বন্ধুরা একে একে জড়ো হন তাঁর আবাসস্থল পূর্ব লণ্ডনের স্টেপনী গ্রীনের ঐ বৃদ্ধাশ্রমে। মুক্তবুদ্ধি চর্চা ভিত্তিক সংগঠন প্রগতি মঞ্চের পরিকল্পনায় আয়োজিত এই অনানুষ্ঠানিক জন্মবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে শুধু তাঁর আন্দোলন সহযোদ্ধা ও অনুসারীরাই নন, জড়ো হয়েছিলেন তাঁর ব্রিটিশ মূলধারার কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীরাও। লণ্ডনের বিভিন্ন স্কুলে কর্মরত এক সময়ের তাঁর শিক্ষক সহকর্মীসহ পরিবার সদস্যরাও ছিলেন এই উদযাপন অনুষ্ঠানে। স্মৃতিভ্রংশে (ডিমেনশিয়া) আক্রান্ত নিখিলেশ চক্রবর্তী এসময় অনেককেই চিনতে না পারলেও পুরো সময়জুড়ে তিনি ছিলেন বেশ উৎফুল্ল। নিখিলেশ চক্রবর্তীর এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সৈয়দ রকিব আহমদেও কন্যা ডা: আনিকা রকিবের হাতে বানানো একটি জন্মদিন কেইক তাঁর সামনে হাজির করা হয়। স্ত্রী ও বৃদ্ধাশ্রম কর্মীদের সহযোগিতায় কেইকটি কাটার মুহূর্তটি বেশ উপভোগ করেন নিখিলেশ চক্রবর্তী। এসময় বৃদ্ধাশ্রম কর্মীরা আশ্রমের বাসিন্দা বিভিন্ন বর্ণেও বেশ কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিকেও এই উদযাপন অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন। এসময় তাদের সবার কাছে নিক নামে পরিচিত নিখিলেশ চক্রবর্তীকে পরিয়ে দেয়া হয়‘ কিং ফর এ ডে‘ নামক একটি ব্যাজ।
জন্মদিনের কেইক কাটার পর সৈয়দ রকিব আহমদের পরিচালনায় বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হাবিব রহমান ও মাহমুদ এ রউফ, টাওয়ার হ্যামেটস কাউন্সিলের সাবেক লীডার রাজন উদ্দিন জালাল, সত্যবাণী সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা, যুক্তরাজ্য উদীচী সভাপতি হারুনুর রশীদসহ চক্রবর্তীর কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীরা একে একে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ৬২ ছাত্র আন্দোলনের এ কর্মী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রনেতাকে শুভেচ্ছা জানান। এসময় উদীচীর একজন শিল্পী নিখিলেশ চক্রবর্তীর প্রিয় দুটো রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শোনান তাঁকে।
উল্লেখ্য, ৬২’র ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা নিখিলেশ চক্রবর্তী ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ষাটের দশকের মধ্যভাগে বিলেতে চলে আসেন। এসময় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ঢেউ এসে বিলেত স্পর্শ করলে এই আন্দোলনে শরীক হয়ে পড়েন তিনি। ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের সমর্থনে বিলেতে জনমত সংগ্রহের অগ্রভাগে থাকার কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার নিখিলেশ চক্রবর্তীর পাসপোর্ট বাতিল করলে তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাপিয়ে পড়েন এই আন্দোলনে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত সংগ্রহের লক্ষ্যে ব্রিটিশ রাজনীতিক ও জনগণের কাছে ঐসময় সহকর্মীদের নিয়ে তিনি বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানী শাষকদের বৈষম্যের কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ক্রয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহে রাখেন বিরাট ভূমিকা। দেশ স্বাধীন হলে তিনি ফিরে পান তাঁর পাসপোর্ট, দেশে গিয়ে গায়ে মাখেন জন্মভূমির মাটি।
এখানেই শেষ নয় নিখিলেশ চক্রবর্তীর সংগ্রামের উপাখ্যান। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর এর প্রতিবাদে আবারও লণ্ডনের রাজপথে নামেন নিখিলেশ চক্রবর্তী। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ঐসময় তিনি শারিরীকভাবেও নির্যাতনের শিকার হন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সমর্থকদের হাতে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা যখন লণ্ডনে এসে আশ্রয়হীনভাবে অসহায় জীবন যাপন করছিলেন, তখন যে কজন মানুষ ছিলেন তাঁর ভরসার জায়গা, তাদের একজন ছিলেন নিখিলেশ চক্রবর্তী। শেখ রেহানা পরবর্তীতে এক সাক্ষাতকারে এ বিষয়ে নিখিলেশ চক্রবর্তীর নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণও করেছেন। ১৯৩৯ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া নিখিলেশ চক্রবর্তী ব্যক্তিগত জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জনক। ছেলে আমেরিকায় ও মেয়ে লণ্ডনে বসবাস করেন। জন্মদিনে বন্ধু-স্বজনদের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সংগঠক নিখিলেশ চক্রবর্তী।