লণ্ডন, ২৩ অক্টোবর: গভীর শ্রদ্ধা, ফুলেল ভালোবাসা ও কর্মজীবনের তথ্যচিত্র প্রদর্শন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে হবিগঞ্জ জেলার ১৮ জন অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষককে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করা হয়েছে টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশন সম্মাননা-২০২৩। এরমধ্যে ৫ জনকে দেওয়া হয় টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশন সম্মাননা-২০২৩। বাকী ১৩ জন আদর্শ শিক্ষককে দেয়া হয়েছে টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশন বিশেষ সম্মাননা-২০২৩। সম্মাননাপ্রাপ্ত ১৮ শিক্ষক ও তাঁদের পরিবারের হাতে বায়োগ্রাফি তুলে দেওয়া হয়। এছাড়া সম্মাননাপ্রাপ্ত প্রত্যেক শিক্ষককে আর্থিক উপহার দেওয়া হয়েছে।
গত ১৭ অক্টোবর, মঙ্গলবার হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মিলনায়তনে এই জমকালো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো: আবু জাহির। বিশেষ অতিথি ছিলেন হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আতাউর রহমান সেলিম, হবিগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো: রুহুল্লাহ, টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশনের বাংলাদেশ সমন্বয়ক, সিলেট বিভাগ বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. কবির খান। প্রধান অতিথি অ্যাডভোকেট মো: আবু জাহির এমপি বলেছেন- স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষকদেরকে স্মার্ট হতে হবে। স্মার্ট শিক্ষকদের মাধ্যমে আমাদের আগামী প্রজন্ম ছাত্র-ছাত্রীদেরকে স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত কারিকুলাম পরিবর্তন করেছে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে বসে শিখবে, লেখাপড়া করবে এবং আয় করবে। স্কুল থেকেই তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে।
তিনি বলেন, হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক টি আলী স্যার ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। তাঁর প্রতি সম্মান জানাতে সরকার হবিগঞ্জ পৌরসভার মাধ্যমে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশের সড়কটি- ‘টি আলী স্যার সড়ক’ নামে নামকরণ করেছে। এমপি আবু জাহির বলেন, অসহায়, আর্থিক সঙ্কটে থাকা শিক্ষকদের বাছাই করে তাদেরকে সম্মানিত করছে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারিটি সংস্থা ‘টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশন’। প্রবাসে থেকে দেশের শিক্ষকদের জন্য এমন কাজ অত্যন্ত গৌরবের। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবদ্দশায় সহযোগিতা ও তাদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হলে শিক্ষকরা এই পেশায় আসতে অনুপ্রাণিত হবেন। বিশেষ অতিথিবৃন্দ তাদের বক্তব্যে বলেন, টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশন শুধু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বন্ধনকে অটুট রাখতে কাজ করছে না। এটির মাধ্যমে সমাজে শিক্ষকদের সম্মানের চর্চার নানা দিক তুলে ধরে অসংখ্য শিক্ষার্থীদের আলোর পথে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্মান এবং তাদের পাশে থাকার প্রত্যয়ে কাজ করা সংগঠনটির ভূয়সী প্রশংসা করে বিশেষ অতিথিবৃন্দ বলেন, এধরণের উদ্যোগ সমাজে যতবেশী চর্চা হবে সমাজ ততো আলোকিত হবে। টি আলী স্যারের ছাত্র, হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার সম্পাদক হারুনুর রশিদ চৌধুরীর পরিচালনায় অনুষ্ঠান সভাপতিত্ব করেন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ আলফাজ উদ্দিন। ফাউণ্ডেশনের বাংলাদেশ সমন্বয়ক সিলেট বিভাগ বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. কবির খান ফাউণ্ডেশন গঠনের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলেন, ফাউণ্ডেশনের অন্যতম কাজ হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের শারিরীক সুস্থতার খোঁজখবর, সহযোগিতা এবং সামাজিকভাবে তাদেরকে সৃজনশীল সময় দেয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। যাতে করে আমৃত্যু শিক্ষকরা সম্মানের সাথে জীবনযাপন করতে পারেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল, হবিগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আউয়াল তালুকদার, সাবেক পৌর কমিশনার আব্দুল মোতালিব মমরাজ। টি আলী স্যারের স্মৃতিচারণ করে তাঁরা বলেন, সমাজকে আলোকিত করতে একজন গুণী শিক্ষকের বিকল্প নেই। তজম্মুল আলী স্যার ছিলেন এমনই একজন মানুষ গড়ার আদর্শ কারিগর। গুণী এই শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরে আমরা গর্বিত। সংবর্ধিত শিক্ষকবৃন্দকে অভ্যর্থনা জানান, হবিগঞ্জ হাই স্কুল এণ্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক শিউলী রানী দাশ ও সিনিয়র শিক্ষক তাহমিনা বেগম। অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের বর্ণাঢ্য জীবনের তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এই সময় অনেক শিক্ষক তাদের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি, নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে। অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষকদের পাশে থাকা স্বজনরাও আবেগআপ্লুত হয়ে গর্ববোধ প্রকাশ করেন। পরে সম্মাননাপ্রাপ্ত ১৮ শিক্ষক ও তাদের পরিবারের হাতে জীবনী তুলে দেওয়া হয়।
সম্মাননাপ্রাপ্ত শিক্ষকরা হলেন- হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় মো. আব্দুর রহমান, মো. জবেদ আলী, শায়েচ্চাগঞ্জ উপজেলায় মো. আব্দুল খালেক, মহেশ্বর দাস, বানিয়াচং উপজেলায় রামেন্দ্র সুন্দর ভট্টাচার্য্য, মো. আমীর হোসেন মাস্টার, মাধবপুর উপজেলায় আব্দুন নূর, মো. সিরাজুল ইসলাম, নবীগঞ্জ উপজেলায় নিজামুল ইসলাম, মৌলভী মো. মহিউদ্দিন, চুনারুঘাট উপজেলায় রইছ উল্লাহ, মো. আব্দুল মতিন, বাহুবল উপজেলায় মো. আরজু মিয়া, উজ্জ্বল কুমার ভট্টাচার্য্য, লাখাই উপজেলায় সালাহ উদ্দিন আহমেদ ভূঞা, মো. আছগর আলী, আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় আবু সালেহ শাহ, মো. আবুল খায়ের পাটোওয়ারী।
উল্লেখ্য, তজম্মুল আলী ছিলেন আমৃত্যু নিবেদিন মানুষ গড়ার একজন কারিগর। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে পরম শ্রদ্ধাভরে সম্বোধন করতেন ‘টি আলী স্যার’ বলে। টি আলী স্যার সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার বৃহত্তর জলঢুপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩১ বছর হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। একই স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি হোস্টেল সুপারের গুরুদায়িত্বও পালন করেন ২৮ বৎসর। ২০১৯ সালে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান এই শিক্ষকের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাজ্যভিত্তিক চ্যারিটি সংস্থা টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশন। মূলত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্মাননা ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষকদের সহযোগিতার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ফাউণ্ডেশনটি। আদর্শবান শিক্ষক, আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা শিক্ষকদের সন্ধান অথবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক যাদের খোঁজ-খবর অনেকে রাখেন না তাদেরকে খোঁজে কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে।
প্রসঙ্গত টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশন ২০২০ সালে সিলেট বিভাগে আদর্শ শিক্ষকদের নিয়ে কাজ শুরু করে। ফাউণ্ডেশনটি আদর্শ শিক্ষকদের সম্মাননা পদকে মনোনয়নে একটি বোর্ড গঠন করে। এই মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান হলেন- টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশনের বাংলাদেশ সমন্বয়ক, সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সিলেট বিভাগ বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি কবির খান। হবিগঞ্জ জেলার দায়িত্বে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ আলফাজ উদ্দিন হবিগঞ্জ জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়ন জরিপ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মনোনয়ন বোর্ড হবিগঞ্জ জেলার ৯ উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশন সম্মাননা পদক ২০২৩ সালের জন্য ১৮ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নামের তালিকা প্রকাশ করে। এছাড়া তাদের জীবন বৃত্তান্ত সংগ্রহের পর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বর্ণাঢ্য জীবনী প্রকাশ করে। মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রত্যেকের ফ্রেমবন্দি জীবনী মঙ্গলবার তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। যুক্তরাজ্য থেকে পরিচালিত ফাউণ্ডেশনটি সিলেট বিভাগে ২০২২ সালে টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশন সম্মাননা পদক প্রদান করেছে। এবং ধারাবাহিকভাবে মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলায় গুণী শিক্ষকদের জীবিত অবস্থায় সম্মাননা প্রদানের জন্য কাজ করছে।
হবিগঞ্জ জেলার ১৮ জন অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষক সম্মাননা অনুষ্ঠানটি সফলভাবে সম্পন্ন করায় ফাউণ্ডেশনের সভাপতি ফয়ছল আহমদ রুহেল এবং সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম অভি ফাউণ্ডেশনের বাংলাদেশ টিম এবং হবিগঞ্জের অনুষ্ঠান পরিচালনায় সাথে সম্পৃক্ত সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় টি আলী স্যার ফাউণ্ডেশন সম্মাননা ২০২৩ অনুষ্ঠানটি সফল হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি