মঙ্গলবার ১৩ই এপ্রিল জানাজা ইস্ট লণ্ডন মসজিদে
সারওয়ার-ই আলম ♦
লণ্ডন, ১২ এপ্রিল: বিশিষ্ট সাংবাদিক ও শিক্ষক, বাংলাদেশী-ব্রিটিশ কমিউনিটির প্রিয়মুখ সৈয়দ আফসার উদ্দিন এমবিই ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। দীর্ঘ নয় বছর বোন ম্যারো ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে গত ১২ই এপ্রিল শুক্রবার রাত আড়াইটার দিকে লণ্ডনের গাই’জ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর। তিনি বেশ কয়েক বছর থেকে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলেন। তবে সম্প্রতি তার শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটে।
আগামী ১৩ই এপ্রিল শনিবার দুপুর দেড়টায় জোহরের নামাজের পর ইস্ট লণ্ডন মসজিদে তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে এবং একইদিনে বেলা সোয়া তিনটায় চিগওয়েলস্থ গার্ডেনস অব পিস কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হবে।
নামাজে জানাজার আগে সকাল ১১টা থেকে বেলা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত তাঁর মরদেহ ব্রিকলেন মসজিদে বন্ধু-স্বজন ও সর্বসাধারণের শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য রাখা হবে বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে সৈয়দ আফসার উদ্দিন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিওর বাংলা বিভাগে এবং ভয়েস অব আমেরিকা রেডিওর লণ্ডন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ব্রিটেনের প্রথম বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল- বাংলা টিভিতে সংবাদ পাঠক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় সংবাদ পাঠে তাঁর স্বকীয়তা সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে তিনি চ্যানেল এসে সংবাদ পাঠক হিসেবে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পর্যন্ত চ্যানেলটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিজ পেশার প্রতি এতটা নিষ্ঠাবান ছিলেন যে ক্যান্সারের চিকিৎসা নেওয়া অবস্থায়ও তিনি টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ অব্যাহত রেখেছিলেন। সংবাদ পাঠে তাঁর উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি ও উপস্থাপনা সুধী মহলের ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে।
প্রবাসে, বিশেষ করে বাংলা গণমাধ্যমে বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা ও বিকাশে সৈয়দ আফসার উদ্দিন সক্রিয় ছিলেন। বাংলা ভাষা ও বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নিয়ে সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কলামসমূহ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। এছাড়া তিনি বিলেতের অন্যান্য বাংলা সংবাদপত্র এবং ৫২বাংলা অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি করতেন। ব্রিটেনের মূলধারার স্কুল ও কলেজের কারিক্যুলামে বাংলা ভাষা শিক্ষা বহাল রাখার জন্যে ১৯৯৩ সাল থেকে বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন।
দীর্ঘ সাতাশ বছর সৈয়দ আফসার উদ্দিন লণ্ডনের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষা শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। কমিউনিটিতে তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ সালে তিনি ব্রিটিশ রাণী কর্তৃক প্রদত্ত মেম্বার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এমপায়ার- এমবিই উপাধি লাভ করেন। এছাড়া কমিউনিটিতে বাংলা ভাষা শিক্ষা এবং ব্রিটেনের বাংলা গণমাধ্যমে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২২ সালে তিনি ‘ফ্রীম্যান অব দ্য সিটি অব লণ্ডন’ সম্মাননা, একই বছর বাংলাদেশী-ব্রিটিশ হুজ হু পদক এবং ২০২৪ সালে লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের দেয়া আজীবন সম্মাননা পদক লাভ করেন।
দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের শিক্ষকতা জীবনে তিনি বাংলাসহ পাঁচটি বিষয়ে ইয়ার সেভেন থেকে এ লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন হেড অব ইয়ার এবং ডাইরেক্টর অফ স্কুল হিসেবে কাজ করেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বছর তিনেক আগে বাধ্য হয়ে তাঁকে অবসরে যেতে হয়। তিনি একিউএ এক্সাম বোর্ডের জিসিএসই বাংলার পরীক্ষক ছিলেন ১৯৯৬ সাল থেকে। সন্ধ্যাকালীন চাকুরী হিসেবে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সৈয়দ আফসার উদ্দিন ESOL লেকচারার হিসেবে টাওয়ার হ্যামলেটস্ কলেজে কাজ করেন।
তিনি ২০১৭ সালে সেরা পুরুষ সংবাদ উপস্থাপক হিশেবে “ইস্টউড” পুরস্কার পান। ২০১৯ সালে ব্রিটেনের অনলাইন সংবাদ পোর্টাল ৫২ বাংলা টিভি সৈয়দ আফসারকে ব্রিটেনে শিক্ষা, সাংবাদিকতা, ও কমিউনিটি সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য “৫২ বাংলা টিভি বিশেষ সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড ২০১৯” প্রদান করে। একই বছর সানরাইজ টুডে অনলাইন টিভি সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য তাকে বিশেষ সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে।
সৈয়দ আফসার উদ্দীনের জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকায়। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের পর সৈয়দ আফসার উদ্দিন দৈনিক ইত্তেফাকে ক্রীড়া সাংবাদিক হিশেবে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেন।
সদালাপী, বন্ধুবৎসল ও স্নিগ্ধ রুচির অধিকারী, কমিউনিটির প্রিয়মুখ সৈয়দ আফসার উদ্দিনের মৃত্যুতে বাংলাদেশী-ব্রিটিশ কমিউনিটিতে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও বন্ধুরা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের মাধ্যমে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছেন।
লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সদস্য সৈয়দ আফসার উদ্দিন এমবিই’র মৃত্যুতে ক্লাব নেতৃবৃন্দ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোকর্বাতায় ক্লাব সভাপতি মোহাম্মদ জুবায়ের, সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ ও কোষাধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনার পাশাপাশি তাঁর স্বজনদের ধৈর্য্য ধারণের শক্তি দানের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন। নেতৃবৃন্দ মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন ।
এছাড়া সৈয়দ আফসার উদ্দিনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন ইউকে-বাংলা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি আনসার আহমেদ উল্লাহ্, সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের আহমদ ও কোষাধ্যক্ষ কে এস এম আশরাফুল হুদা। এক শোকবার্তায় রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতৃবৃন্দ মরহুমের রূহের শান্তি কামনা করে তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
সৈয়দ আফসার উদ্দিনের বাংলাদেশে পৈতৃক নিবাস ছিলো চট্টগ্রামের মিরশ্বরাই উপজেলার চিনকি আস্তানা “তাকিয়া বাড়ি” (সৈয়দ বাড়ি)। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। সৈয়দ আফসার উদ্দিন স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে লণ্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন।