মোস্তফা কামাল মিলন, লণ্ডন, ১৪ নভেম্বর
গত পয়লা নভেম্বর ছিলো জাতীয় অধ্যাপক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের প্রায়াণ দিবস। এ উপলক্ষে এদিন ব্রিটিশ বাংলাদেশী টিচার্স এসোসিয়েশন জুমের মাধ্যমে একটি স্মরণসভার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন এসোসিয়েশনের সভাপতি আবু হোসেন এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল বাসিত চৌধুরী। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ প্রথমত: ও প্রধানত: ছিলেন একজন শিক্ষক। একাধারে তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি, গবেষক, রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন চৌকস লেখক, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক ও সমাজ সেবক। তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করতে এই জুম সভায় টিচার্স এসোসিয়েশনের সদস্য ছাড়াও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোচনায় বাংলাদেশ থেকে যুক্ত হয়েছিলেন তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান লেখক ও সাংবাদিক আবু সাঈদ জুবেরি, সিলেটের মদনমোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ লেখক ও গবেষক ডক্টর আবুল ফতেহ্ ফাত্তাহ, আবুজর গিফারী কলেজের অধ্যক্ষ শিরিন আক্তার বানু ও সাবেক অধ্যাপক তৃপ্তি রাণী বড়ুয়া আর প্রভাষক রোখসানা আক্তার বানু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও জাতিসংঘের হিউম্যান ডেভেলাপমেন্ট রিপোর্ট অফিস ও পভার্টি ডিভিশনের সাবেক ডাইরেক্টর ড. সেলিম জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আলামনাই ইন দ্যা ইউকের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গৌস সুলতান ও একই সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহম্মদ আব্দুর রাকীব, গ্রেটার সিলেট ডেভেলাপনমেন্ট কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আতাউর রহমান, লণ্ডনের রেডব্রীজ বারার কাউন্সিলার সাঈদা চৌধুরী, মুফতি সৈয়দ মাহমুদ আলী, কমিউনিটি নেতা মির্জা আসাব বেগ, অধ্যাপক আহাসান উল্লাহ্, ইবনেসিন খালিদুন বিন্ আজাদ এবং রেহান বেগম যুক্তরাজ্য থেকে যুক্ত হয়েছিলেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন। দেওয়ান আজরফের পৌত্রী টিচার্স এসোসিয়েশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক কানিজ ফাতেমা তাঁর পিতামহের জীবনাদর্শ, তাঁর সার্থক কর্মময় জীবন ও নানা ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যকে উপস্থাপন করেছেন এবং দাদার সঙ্গে তার মধুর স্মৃতি রোমন্থন এবং তা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করেছেন। প্রয়াত আজরফ ঢাকা নগরীতে অবস্থিত বিখ্যাত বিদ্যাপীট আবুজর গিফারী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৭ সালে শুরু থেকেই ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি যেটির অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনে সরাসরি সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন এবং কারাবরণও করেছিলেন, যদিও তিনি সুনামগঞ্জ কলেজে তাঁর শিক্ষকতার (অধ্যক্ষ) চাকরী ফিরে পেয়েছিলেন। আলোচনাকারীগনের সবাই তাঁর জীবনাদর্শ, দর্শন, মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মত মানসিকতা, শক্তি, ক্ষমতা, মেধা, ঐকান্তিকতা ও একাগ্রতা এবং সমাজে শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়া, জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ করা, কুসংস্কারকে দূরীভূত করা, জাতি ও ধর্মের নামে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও বিভেদকে তিরোহিত করার ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা-চেতনা, নিরলস প্রয়াস, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও প্রণিধানযোগ্য অবদানের কথা সশ্রদ্ধচিত্তে উল্লেখ করেছেন। সার্বজনীনতা, সাম্য, প্রগতি ও একতায় বিশ্বাসী একজন মহান বাঙালীকে নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করার অপপ্রয়াসের বিষয়টিও তাঁর পুত্র আবু সাঈদ জাবেরী ও তাঁরই শিষ্য আবুজর গিফারী কলেজের শিক্ষক তৃপ্তি রাণী বড়ুয়া এবং অন্যান্যরা আলোচনায় গুরুত্বের সাথে তুলে এনেছেন। তাঁর ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সহকর্মী তৃপ্তি রাণী বড়ুয়ার ভাষায় ও বহুগুণে গুনান্বিত এই মহৎ ব্যক্তির, বহুভিন্নতা নির্বিশেষে মানুষকে কাছে টেনে নিয়ে স্বীয় আলোয় আবেশিত ও সিক্ত করেছেন, দিয়েছেন বৈষম্যহীনতা ও ত্যাগের মহিমার তৃপ্তি ও আনন্দের দীক্ষা। দেওয়ান আজরফ যৌবনের প্রারম্ভ থেকেই আঞ্চলিক ও জাতীয়ভিক্তিক বিভিন্নধরণের সামাজিক ও পেশামূলক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা এবং সেসবের অগ্রযাত্রায় ওতোপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সৃজনশীলতা এবং শিক্ষা-সাহিত্য ক্ষেত্রে ও প্রগতিশীল সমাজ গঠনে অসাধারণ অবদানের জন্য দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে ১৯৯৩ সালে জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দুটি রাষ্ট্রীয় পদক যথাক্রমে স্বাধীনতা ও একুশে পদক পেয়েছিলেন। এছাড়াও, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন পুরস্কার ও শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংস্পর্শে এসেছিলেন ও সাহচর্য পেয়েছিলেন এবং পোপ জন পলের আমন্ত্রণে ইতালীর রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্মীয় সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। সংগঠনের হয়ে আলোচনায় অংশ নেন সংগঠনের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামাল মিলন, বর্তমান সহ-সভাপতি মুজিবুল হক মনি, ইসি সদস্য: শফি আহমদ, সাবিতা সামসাদ, হাসনা রহমান, শাহীন খান, রুকসানা গনি, সিনিয়র সদস্য: রেহানা খানম রহমান ও অ্যাডভোকেট শাহ্ ফারুক আহমেদ, সদস্য: সাজেদা আহমেদ, মিসবাহ্ আহমেদ ও ফারজানা আহমেদ এবং রেবা বেগম। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে দেশের অন্যতম সমাজ গড়ার এই কারিগর প্রয়াত দেওয়ান আজরফের জন্য প্রার্থনা করা হয়। দোয়া পরিচালনা করেন টিচার্স এসোসিয়েশনের সদস্য মৌলানা শেখ আহমেদ হাসান। পরিশেষে সভাপতির পক্ষে কোষাধক্ষ মিজবাহ্ কামাল এ আয়োজনে অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহান, কানিজ ফাতেমা ও সিরাজুল বাসিত চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এবং স্মরণ সভায় সরাসরি যুক্ত সবাইকে, বিশেষ করে এত রাত জেগে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানেন।