সারওয়ার-ই আলম
দেশে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলো গত চুয়ান্ন বছরে মতে ও পথে যখন বহুভাবে বিভক্ত হয়েছে, তখন মৌলবাদী শক্তি নিজেকে কতটা শক্তিশালী করেছে— সদ্য অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন তারই প্রমাণ বহন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বিরাট অংশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করা মানেই হলো গত কয়েক দশকে তারা সাংগঠনিকভাবে ব্যাপকভাবে সুসংগঠিত করেছে নিজেদেরকে। বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে ফলাফল যে মোটামুটি একই রকম দাঁড়াবে এটা এখন অনেকটা স্পষ্ট।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- যে দলটি গত কয়েক দশকে প্রকাশ্যে রাজনীতি-ই করার সুযোগ পায়নি তারা কীভাবে এতটা শক্তিশালী হলো? স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার পরও কীভাবে তারা দেশের সচেতন ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তাদের অনুগত করল? আর ছাত্র-ছাত্রীরাই বা কেন তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করল ? — এখন সময় এসেছে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিশদ ভাবার এবং এ অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করার। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি— বিশেষ করে রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। তা না হলে সেদিন মনে হয় বেশি দূরে নয় যেদিন ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রকৃতঅর্থেই হুমকির সম্মুখিন হবে। এবং বহুধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এ রাষ্ট্রটি পরিণত হবে আফগানিস্তানের মতো একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ‘হিজাব হিজাব’ স্লোগান সেই অশনিসংকেতই দেয় আমাদেরকে।
২৪-এর গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় দেড় দশক রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। তাদের শাসনামলে পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে প্রায় সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বাস্তবায়ন করা হয় কোটি কোটি ব্যয়ে শত শত প্রকল্প। পত্রিকান্তরে জানা যায় শুধু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ই ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন প্রকল্প’ নাম দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করেছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্য একটাই প্রজন্মের অন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গেঁথে দেওয়া এবং বঙ্গবন্ধুকে গেঁথে দেওয়া। আওয়ামী শাসনামলে সারাদেশে ৮০৮টি প্রতিষ্ঠানের নাম শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে করা হয়েছে। সেখানেও নিশ্চয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এ জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ পরিবারের অবদানের বিষয়টি। ডাকসু নির্বাচনে যেসব ছাত্র-ছাত্রী স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছে, বয়স হিসেব করলে দেখা যাবে তারা অধিকাংশই আঠারো থেকে একুশ বছরের তরুণ-তরুণী। অর্থাৎ তাদের মনন গঠিত হয়েছে ওই সময়টাতে যখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল এবং যে সময়টাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় দেশব্যাপী সবচেয়ে বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব তরুণ-তরুণী বড় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে, এ লড়াকু জাতির আন্দোলন সংগ্রামের কাহিনী পড়ে। তাদের মনোজগত গঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়ে। তাহলে যে প্রশ্নটি এখানে সবচেয়ে বেশি প্রনিধানযোগ্য তাহলো— মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ুয়া প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা কেন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে তাদের ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য বেছে নিল? তবে কি এ জাতির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস তাদেরকে একটুও স্পর্শ করেনি? না কি যে প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তৈরি করে তাদের কাছে উপস্থাপন করেছে— তারা তা পরীক্ষা পাশের জন্য পড়েছে সত্য কিন্তু অন্তরে সেটিকে ধারণ করেনি? অথবা এও কি হতে পারে যে তাদের কাছে মনে হয়েছে আওয়ামী লীগ আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন নয়, কার্যত মুক্তিযুদ্ধের নামে রাষ্ট্রের হাজারো কোটি টাকা খরচ করে এ জাতির অন্তরে চির প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে শুধুমাত্র শেখ পরিবারকে— যার ফলশ্রুতিতে প্রজন্ম সুযোগ পেয়ে সে প্রয়াসকে একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে? — আজ এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা খুবই জরুরি।
লণ্ডন, ১১সেপ্টেম্বর ২০২৫
লেখক: কবি ও সাংবাদিক