সমস্যা সমাধান করেই নির্বাচনের প্রস্তাব পেট্রনদের
কোনো অনিয়ম নেই, নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হবে- চেয়ারপার্সন ব্যারিস্টার আতাউর রহমান
পত্রিকা প্রতিবেদন
লন্ডন, ০৯ জানুয়ারি: যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্যতম বৃহৎ সংগঠন গ্রেটার সিলেট কাউন্সিলের (জিএসসি) নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক চলছে। সংবিধান অনুযায়ী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটির মেয়াদ দুই বছর। কিন্তু ২০১৭ সালের শেষের দিকে ব্যারিস্টার আতাউর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত বর্তমান কমিটি এখনও দায়িত্ব পালন করছে। অভিযোগ উঠেছে, কোনো যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন ছাড়াই তাঁরা কমিটির মেয়াদ বৃদ্ধি করে আসছেন। শেষ পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেও সেই নির্বাচনকে ঘিরে উঠেছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। সংগঠনের নতুন সদস্য গ্রহণ, নবায়ন, ফি জমাদানে অস্পষ্টতা এবং রিজিওনাল কমিটি থেকে ডেলিগেট নির্বাচন নিয়ে অস্বচ্ছতা ও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আগামী ২৯ জানুয়ারি এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়িয়েছে অভিযোগকারীরা বলছেন, অভিযোগের সুরাহা না করে নির্বাচনে গেলে তারা আইনের আশ্রয় নেবেন। আর বর্তমান চেয়ারপার্সন ও একই পদে আবারো প্রার্থী হওয়া ব্যারিস্টার আতাউর রহমান বলছেন, কোনো অনিয়ম নেই। ২৯ জানুয়ারি নির্ধারিত দিনেই নির্বাচন হবে। এ অবস্থায় সংগঠনের দুই পেট্রন- ড. হাসনাত হোসাইন এমবিই এবং এ কে এম আবু তাহের চৌধুরীকে আর্বিটেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যালোচনা শেষে গত ৬ জানুয়ারি তারা জিএসসি নেতৃবন্দকে সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন।
নির্বাচনকে ঘিরে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে- সংগঠনের শীর্ষ তিন পদে যারা রয়েছেন তারা এবারও স্ব স্ব পদে প্রার্থী হয়েছেন। তারাই আবার নির্বাচন কমিশন গঠন থেকে শুরু করে নির্বাচন পরিচালনার সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রার্থীরা নিজেই নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করার এই ঘটনা নির্বাচনের নামে তামাশা বলে অভিহিত করেছেন অভিযোগকারীরা। নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগে ইতিমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ দুজন নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করতে অনড় বর্তমান চেয়ারপার্সন ব্যারিস্টার আতাউর রহমান। তিনি এবারও এই পদে প্রার্থী হয়েছেন।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে জিএসসি কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন ব্যারিস্টার আতাউর রহমান। সেক্রেটারি নির্বাচিত হন খসরু খান। সংবিধান অনুযায়ী কমিটির মেয়াদ দুই বছর। কিন্তু প্রায় ৫ বছর যাবত ওই কমিটিই দায়িত্ব পালন করে আসছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য জুড়ে জিএসসির ১২টি রিজিওনাল কমিটি ছিলো, এখন ১১টি। এসব রিজিওনাল কমিটির অধীনে আবার শাখা কমিটি রয়েছে। এক সময় এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ছিলো প্রায় ১৯ হাজার। তা থেকে কমে বর্তমানে রয়েছে প্রায় ৯ হাজার। রিজিওন থেকে নির্বাচিত ১০ শতাংশ ডেলিগেটের ভোটে নির্বাচিত হয় কেন্দ্রীয় কমিটি। জিএসসির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ও ট্রাস্টি মুজিবুর রহমান সাপ্তাহিক পত্রিকাকে বলেন, দুই বছর পর পর নির্বাচন হওয়ার কথা। এই হিসাবে ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর সংগঠনের সদস্য গ্রহণ ও নবায়ন শেষ হয়। এরপর থেকেই সদস্য গ্রহণ, ডেলিগেট নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপিত হয়। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনও হয়নি। সর্বশেষ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হবে বলে জানায় কমিটি। কিন্তু তা হয়নি। কয়েক দফা পিছিয়ে ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ চূড়ান্ত হয়। মুজিবুর রহমান আরো বলেন, কিন্তু বর্তমান কমিটির যারা নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করছেন তারাই আবার নির্বাচনে স্ব স্ব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারাই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা সবকিছু করছেন।
আসছে নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী মুজিবর রহমান বলেন, ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর মনোনয়ন জমাদানের তারিখ ঘোষণা করে কমিটি চারজন কমিশনার নিয়োগ দেয়। ১৮ ডিসেম্বর ছিলো মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। কিন্তু নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করেন। এরপর তা বাড়িয়ে আবার ২ জানুয়ারি করা হয়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তফসিল ঘোষণার পর সবকিছু নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে হওয়ার কথা। কিন্তু যারা কমিটিতে আছেন এবং পুনরায় প্রার্থী তারাই সবকিছু করছে মেজরিটির দোহাই দিয়ে। তারা নিজেরাই প্রার্থী আবার নিজেরাই নির্বাচন নিয়ন্ত্রক। তাদের পছন্দের প্রার্থীরা কেবল নির্বাচনের সিদ্ধান্তগুলো জানছে। অন্য প্রার্থীরা নয়। এটা নির্বাচনের কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নয়। যে কারণে তাদের নিয়োগ দেয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুর রকিব সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে অপারগতা জানিয়ে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করেছেন আরও এক নির্বাচন কমিশনার জাকির খান। তিনি বলেন, সদস্যপদ ও ডেলিগেট নিয়ে অনিয়মের অভিযোগগুলো বেশ পুরনো। কিন্তু তারা সেগুলোর কোনো সমাধান করেনি।
পদত্যাগ করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুর রকিম সাপ্তাহিক পত্রিকাকে বলেন, জিএসসি নিয়ে অনেক উচ্চমানের ধারণা ছিলো। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার পর দেখেছি সেখানে সবকিছু এলোমেলো। সংবিধানে ৩ জন কমিশনারের কথা বলা আছে। কিন্তু নিয়োগ দেয়া হয়েছে চারজন। অপর তিন কমিশনার লন্ডনের বাইরে থাকার কারণে দায়িত্ব পালনে তাদের কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। আবার প্রার্থীদের মনোয়নপত্রে নির্বাচন কর্মকতা হিসেবে যাদের নাম দেয়া আছে তারাও এই নির্বাচনে প্রার্থী। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সাথে সাথেই ভোটার তালিকা নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দেয়াটা স্বাভাবিক। তিনি জানান, তাঁকে কোনো চূড়ান্ত ভোটার তালিকা দেয়া হয়নি। এসব নিয়ে অভিযোগ উঠে – যা অত্যান্ত যৌক্তিক। মানুষের যে প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবে- সেটা এই সংগঠনের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন নির্বাহী কমিটির উপ-কমিটি হিসেবে কাজ করবে। ফলে যারা নির্বাহী কমিটিতে আছেন এবং আবারও প্রার্থী হয়েছেন তাদের উপেক্ষা করে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার সুযোগ নেই। যেহেতু সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব, তাই তিনি দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। এরপর কমিটি ব্যারিস্টার আবুল কালামকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়। ব্যারিস্টার আবুল কালামের প্রধান নির্বাচন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে ব্যারিস্টার আতাউর রহমানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে মোহাম্মদ আব্দুর রকিবের পদত্যাগের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, উনি জিএসসি সম্পর্কে কোনো কিছুই জানেন না। এটা কোনো একক ব্যক্তির সংগঠন নয়। ব্যারিস্টার আতাউর রহমান জোর দিয়ে বলেন, ২৯ জানুয়ারিতেই নির্বাচন হবে।ণ্ডণ্ডণ্ড আর্বিটেশনের দায়িত্ব থাকা ড. হাসনাত হোসেন এমবিই সাপ্তাহিক পত্রিকাকে বলেন, সংবিধানে পেট্রনদের আর্বিটেশনের ক্ষমতা দেয়া থাকলেও সংগঠনের ৩৩ বছরের ইতিহাসে কখনো পেট্রনদের হস্তক্ষেপ করতে হয়নি। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এতটা সমস্যা জমা হয়েছে, যে কারণে বিষয়টি সমাধানের জন্য শুধু সংগঠনের ভেতরের ব্যক্তিরা নন, কমিউনিটির বিভিন্ন লোকও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমাধানের অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, গত ৬ জানুয়ারি আমরা লিখিতভাবে সকল পক্ষকে একটি প্রাথমিক পরামর্শ দিয়েছি। এটা মানা হলে সমাধান সহজ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।