লন্ডন, ৭ই মার্চ: গত সোমবার থেকে ব্রিটেনে শুরু হয়েছে জাতীয় ক্যারিয়ার সপ্তাহ। সপ্তাহব্যাপী চলা এই কর্মসূচিতে এদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ এনএইচএস-এর ‘উই আর দ্যা এনএইচএস’ প্রচারাভিযানে তুলে ধরা হচ্ছে দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রেরণাদায়ক নানা কাহিনী। একই সাথে এনএইচএস-এ যে নানা ধরনের আকর্ষণীয় নার্সিং কাজ রয়েছে তা-ও এই প্রচারাভিযানে তুলে ধরা হচ্ছে।
দক্ষিণ এশীয়দের নার্সিং পেশায় যোগ দিতে উৎসাহ দিচ্ছেন এনএইচএস-এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা
আশা দে এনএইচএস-এর একজন নার্স। তাঁর ছোট ভাইবোনের জন্ম হয় নির্ধারিত সময়ের আগেই। তিনি তখনই বুঝে নিয়েছিলেন সে সময় মাকে সহায়তায় তাঁর এগিয়ে আসতে হবে। আশা দে বলেন, ‘সে সময় প্রায়শঃই হাসপাতালের অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলোতে আমার ছোট জমজ ভাই-বোনদের নিয়ে যেতে হতো। আমার বয়স মাত্র ১০ বছর হলেও তখনই আমি উপলব্ধি করেছিলাম তাদের জীবন রক্ষার জন্য একটি ভালো স্বাস্থ্যসেবা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’
জীবনের প্রথম দিকের এই অভিজ্ঞতাই আশাকে এনএইচএস-এ যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করে তুলে। আশা দে বলেন, তার জমজ ভাই-বোনদের প্রতি এনএইচএস-এর নার্স কর্মীদের পরিচর্যা, মমতা এবং উদার ব্যবহার তাকে কিভাবে নিজেকে এমন একটি পেশায় নিয়োজিত হতে উৎসাহিত করে তুলেছে যাতে তিনি নিজেও মানুষকে সাহায্য করতে পারেন।
আজ ৪০ বছর পর এন এইচ এস এর একজন নার্স হিসেবে কাজ করার পর তিনি নিজেকে অন্য আর কোথাও ভাবতে পারেন না। আশা দে বলেন, আমি বর্তমানে একজন জ্যেষ্ঠ (সিনিয়র) নার্সের দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু আমি আমার পেশাগত জীবনের শুরুতে এই দায়িত্বে আসতে পারবো তা কল্পনাও করতে পারিনি।
আশা এখন লেস্টারশায়ার পার্টনারশিপ এনএইচএস ট্রাস্টের আন্তর্জাতিক নিয়োগ বিভাগ (ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট)-এর প্রধান এবং নার্সিং, মিডওয়াইফারি এন্ড এএইচপিএস ইনক্লুশন, এলএলআর আই সিবি-এর প্রধান হিশেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আশার প্রতিদিনের দায়িত্বের একটি হচ্ছে- এনএইচএস-এ আন্তর্জাতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত নার্সদের পেশাগত জীবনের শুরুর সময়টাতে সহায়তা প্রদান । আশা বলেন, এরই অংশ হিশেবে আমি তাদেরকে ‘ক্লিনিক্যাল’ প্রশিক্ষণ, পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি আবেগগত ও মানসিক প্রশান্তির ক্ষেত্রেও সহায়তা করে থাকি।
আজ আশা শুধু তার পছন্দের পেশাতেই নিয়োজিত নন বরং এনএইচএস-এর কাজকে পেশা হিশেবে বেছে নেয়ার স্বপ্নপূরণে অন্যদেরও সাহায্য করছেন। আশা বলেন, জনস্বাস্থ্য (পাবলিক হেলথ)-এ আমি প্রথম যখন যোগ দেই তখন অনেক বৈষম্য লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এরপর পরিস্থিতির যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি গর্বের সাথে বলেন, আমাদের চমৎকার সব আন্তর্জাতিক নার্সদের দেখুন যারা আমাদের কর্মীবাহিনীকে শক্তিশালি করেছেন।
এনএইচএস ইংল্যান্ডের কর্মীবাহিনীর প্রধান কর্মকর্তা (চীফ ওয়ার্কফোর্স অফিসার) ডাঃ নাভিনা ইভান্স এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। নাভিনা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (সাইক্রিয়াটিস্ট) হিশেবে ইস্ট লন্ডন ফাউন্ডেশন ট্রাস্টে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। সেখানে তিনি কনসালটেন্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিশেবে পদোন্নতি পান। বর্তমানে তিনি উচ্চতর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন। নাভিনা বিভিন্ন দায়িত্বে কাজ করে ক্লিনিক্যাল পরিচালক (ডাইরেক্টার) পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আর এখন তিনি হেলথ এডুকেশন ইংল্যান্ড-এর প্রধান। তিনি এই পদে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম এশিয়ান নারী।
নাভিনা মনে করেন, এনএইচএস-এ বিরাজমান বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণের কাজটি শুধু নামকাওয়াস্তে চর্চার বিষয় নয়, এটি এর থেকে অনেক বড় কাজ । নাভিনা বলেন, নেতৃত্বে বৈচিত্র আনা এক্ষেত্রে শুরুর ধাপ মাত্র। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, নেতৃত্বে বৈচিত্র থাকলে তা প্রায়শঃই ভালো করে থাকে। এনএইচএস-এ সফল হতে হলে রোগী ও কর্মীবাহিনীর সাথে অর্থপূর্ণ সংযোগ গড়ে তোলা, এই সংস্থার সকল পর্যায়ের কর্মীর সাথে সংযুক্ত হওয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রোগীর যত্ন-পরিচর্যাকে প্রধান বিবেচনায় রাখতে হবে মনে করেন নাভিনা।
নাভিনা বলেন, নার্সরা হচ্ছেন এনএইচএস-এর মেরুদন্ড এবং সব সময়ই তাদের ব্যাপক চাহিদা থাকবে। স্বাস্থ্য সেবায় যে আরো বেশি বহুমুখীতা এবং খাপখাওয়ানোর সক্ষমতা দরকার তা মহামারী স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে। সিনিয়র নার্সিংয়ের দায়িত্বকে আমাদের অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে যা আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য সহায়ক হবে। সঠিক দক্ষতা এবং মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের জন্য এখন এনএইচএস-এ যোগ দেয়ার বড় সুযোগ রয়েছে।
নাভিনার মতই আশার পরিবারও তাদের পেশা চালিয়ে যাবার ক্ষেত্রে খুবই সমর্থন জুগিয়েছে। আশা বলেন, জরুরী চিকিৎসার অভিজ্ঞতা আমার পরিবারের রয়েছে এবং তারা নার্সিং গুরুত্বটি বোঝেন। তাই আমার সিদ্ধান্তকে তারা সর্বোতভাবে সমর্থন দিয়েছেন। কারণ তারা দেখতে পেয়েছিলেন যে আমি একটি ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম হব। এরপর আমি কি করবো এমনটি যারা ভাবছেন তাদের জন্য নার্সিং পেশা একটি চমৎকার পছন্দ হতে পারে বলে মনে করেন আশা।
আশা বলেন, রোগীরা প্রায়শঃই নার্সদের মনে রাখেন। অসুস্থ অবস্থায় তাদের সাথে উৎসাহব্যাঞ্জক কথাবার্তা বলা এবং প্রতিদিনের দায়িত্ব পালনকালে তাদের প্রতি উদারতা এবং সহমর্মিতা প্রদর্শন নার্সদের সম্পর্কে রোগীদের মনে একটি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যায়। তিনি আরো বলেন, এনএইচএস-এ নানা ধরনের পদে কাজ রয়েছে এবং পেশায় আপনার জন্য এগিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমরা যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান এবং এখানে সবার জন্যই কোনো না কোনো দায়িত্বে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
নার্সিং পেশা সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে চাইলে https://www.healthcareers.nhs.uk/we-are-the-nhs/nursing-careers ওয়েবসাইটটি ভিজিট করা যাবে।