আলমগীর শাহরিয়ার
রাঢ়িখাল-তিন ভাগ পানি আর এক ভাগ মাটির ছোটবড়ো অনেক পুকুর আর ডোবাভরা এক গ্রাম। এক সময় বাংলার গ্রামগুলি এমন ছিল। নদীর পাড়ে পাড়ে গঞ্জ। খালের পাড়ে পাড়ে গ্রাম। বিলম্বিত বর্ষায় গ্রামের চারপাশে ফোটে থাকতো শাপলা ফুল। জারুল স্বাগত জানাতো গ্রীষ্ম ও বর্ষাকে। ছোটবড় অসংখ্য জলের চ্যানেল যুক্ত করেছিল গ্রাম-বাংলার প্রান্তিক মানুষকে সভ্যতা ও পৃথিবীর সঙ্গে। কিন্তু সেই চিরচেনা গ্রামগুলি আমূল বদলে গেছে। বদলে গেছে গ্রামের নৈসর্গিক সুন্দরের আবহমান রূপ। কৃষির বাইরে বিকাশমান নতুন অর্থনীতি, রিয়াল, ডলার, পাউন্ড গ্রামকে আমূল বদলে দিয়েছে। প্রমত্তা পদ্মার পাড়ে ইতিহাস-প্রসিদ্ধ জনপদ বিক্রমপুর। বিক্রমপুরেরই একটি গ্রাম রাঢ়িখাল। প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের গ্রাম। যা কিছু সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ তিনি এই গ্রামীণ জীবনের নির্মল শৈশবেই দেখেছিলেন। এক সময় রাঢ়িখালের অদূরে প্রমত্তা পদ্মা থেকে স্টিমার ছুটে যেত অবিভক্ত বাংলার রাজধানী শহর কলকাতায়, বিলেতে। রাঢ়িখালেই উনিশ শতকে জন্ম নিয়েছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু। আরেকজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি। যার কীর্তি ছড়িয়ে পড়েছিল জগতময়। উদ্ভিদের প্রাণ আর বেতার তরঙ্গ আবিষ্কারের জন্য তিনি খ্যাতিমান হয়েছিলেন। তাঁর নামেই প্রতিষ্ঠিত স্যার জেসি বোস ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা করেছেন হুমায়ুন আজাদ। রাঢ়িখাল গ্রামের পাশেই পদ্মার স্নেহলালিত আড়িয়ল বিল কতভাবেই না এসেছে হুমায়ুন আজাদের লেখায়। রাঢ়িখালের মুগ্ধ সেই কিশোরের চোখে গ্রামীণ জীবনের যা কিছু মন মাতানো বিস্ময়কর সুন্দর তারই সাবলীল বর্ণনায় পূর্ণ তাঁর লেখা বই ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না।’ বিহ্বল শৈশবে শাপলা, শালুক, ঝিনুক, মাছ আর পাখির কথা। দইকুলি বা দোয়েল পাখির কথা। কচি সবুজ লাউয়ের ডগা আর পুকুরের সরপুঁঠি আর রয়না মাছের কথা। পদ্মার রূপালী ইলিশের কথা, বোশেখের রোদ, শাওন মাসের মেঘ, হলদে কুমড়ো ফুলের কথা। একটি পাখির পেছনে ছুটতে ছুটতে কীভাবে এক কিশোরের সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায় তারই গল্প। কীর্তিনাশা পদ্মার পাড়ের খাল ভরতি গ্রাম কামারগাঁও আর ভাগ্যকূলে মেলা দেখে বড় হওয়া কিশোরের লাল ছেলেবেলার গল্প অফুরান। জমিদার যদুনাথের বাড়ি, বিশাল দিঘি, গোলাপ ও বিচিত্র বৃক্ষের দিকে চেয়ে থাকা বিহ্বল কিশোরের দিন কেটেছিল কী দারুণ বিস্ময় আর আনন্দে। বিক্রমপুর অঞ্চলের বিখ্যাত টিনের ঘর ও টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ তাকে মুগ্ধ করতো। শৈশবের লেবুর ঘ্রাণ আর জোনাকিপোঁকার স্মৃতি তাকে জাগিয়ে রাখতো অসুন্দর কংক্রিটের নগরে। এমন অনেক গল্পই সময়ের আবর্তে এখন রূপকথার মতো শোনায়।
শুধু কি সৌন্দর্যরাশি? না, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে দেওয়া মহামারী ব্যাধি ও বেদনার গল্পও উঠে আসে তাঁর রচনায়। কালো গাইয়ের দুধখ্যাত দারুণ উপমায় গরম ভাতের ফ্যানের জন্য লালায়িত দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের গল্প স্পর্শ করে। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে সংযোগে আমাদের চিরচেনা গ্রামগুলিও মরে যায়, তার চিরচেনা রূপ হারায়। গ্রামের এই মৃত্যু তাকে বেদনার্ত করে। তবু লাল ছেলেবেলার গ্রাম যেন ভালো থেকো সেই আকুলতা ফুটে ওঠে অনবদ্য সৃষ্টিতে।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
বড়দের জন্য, বড়দের বোধগম্য ভাষায় লেখা যায় কিন্তু শিশুদের উপযোগী করে শিশুমন নিয়ে লেখা বড় কঠিন। তিনি সে কঠিন কাজ সংবেদনশীল হৃদয় নিয়ে করতে পারতেন। তাই বাংলা ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। ‘বুক পকেটে জোনাকিপোকা’,‘আব্বুকে মনে পড়ে’, ‘আমাদের শহরে একদল দেবদূত’, ‘অন্ধকারে গন্ধরাজ’-এর মতো রচনা ছাড়াও ‘লাল নীল দীপাবলি’ কিংবা ‘কত নদী সরোবর’ শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী এমনকি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্ম ও সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে কৌতূহলী যে কারো জন্যে সেরা দুটি বই। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষার সৃষ্টি, বিকাশ ও উন্মেষকালের প্রাঞ্জল বর্ণনা যেন পলকে ইতিহাসের টাইমলাইন ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। সাহিত্যের আলো ও অন্ধকার যুগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে রেনেসাঁর আলো রবীন্দ্রনাথ, বিশ শতকের আধুনিকতা কিছুই বাদ পড়ে না। ভাষার বিকাশের কঠিন কালক্রমকে তিনি তুলে ধরেন সুখকর গদ্যে। দুরূহ রচনা প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। ‘লাল নীল দীপাবল’ বইয়ের পাঠকদের উদ্দেশ্য করে লেখক বলছেন, “এ-বইয়ের পাঠক হিশেবে আমার কল্পনায় ছিলো স্বপ্নকাতর সে-কিশোরকিশোরীরা তরুণতরুণীরা, যারা আছে কোমল কৈশোরের শেষ রেখায়, বা যারা কৈশোর পেরিয়ে ঢুকেছে এক বিস্ময়কর আলোতে, যাদের সৌরলোক ভ’রে গেছে সাহিত্যের স্বর্ণশস্যে। একদা আমি সবুজ বাল্যকাল পেরিয়ে সাহিত্যের মধ্যে মহাজগতকে দেখেছিলাম, ‘লাল নীল দীপাবলি’ তাদেরই জন্যে যারা আজ একদা আমার মতো।” বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের আলো জ্বেলেছেন লেখক বইটিতে। ‘লাল নীল দীপাবলি’ এবং ‘কতো নদী সরোবর বা বাংলা সাহিত্যের জীবনী’ আমাদের দুঃখিনী বর্ণমালার সাহিত্য ও ভাষার কথা বলে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের শাস্ত্রভাষা সংস্কৃত, আশরাফ মুসলমানদের ফার্সি, উর্দু নয়—এই বদ্বীপের খুব সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ও বাঙালির হাজার বছরের আত্মপরিচয়ের আখ্যান-সমৃদ্ধ বইগুলো কিশোর-কিশোরীদের পাঠ্যতালিকায় থাকা খুবই জরুরি।