আপনার শিশুকে মিজেল, মাম্পস ও রুবেলা থেকে রক্ষা করুন

মিজেল (হাম) শুধু ফুসকুড়ি নয়, এরচেয়ে অনেক গুরুতর কিছু। আপনার সন্তানদের MMR টিকা দিতে আপনার জিপির সাথে যোগাযোগ করুন।

আপনার শিশুকে মিজেল, মাম্পস ও রুবেলা থেকে রক্ষা করুন

“টিকার মাত্র দুটি ডোজ মিজেল, মাম্পস এবং রুবেলার বিরুদ্ধে সারা জীবনের জন্য কার্যকর সুরক্ষা দেয় যা তাদেরকে এবং আশেপাশের মানুষজনকে নিরাপদ রাখে।”

ডাঃ মুহাম্মদ নকভি, জিপি, লণ্ডন

আপনার শিশুকে মিজেল, মাম্পস ও রুবেলা থেকে রক্ষা করুন

“যদি আপনাকে বা আপনার শিশুকে টিকা না দেওয়া হয়ে থাকে তবে আপনি মিজেলে আক্রান্ত হবার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন।”

ডাঃ মুহাম্মদ নকভি, জিপি, লণ্ডন

উত্তাল মার্চ

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

সাময়িকী

ক্রীম

মে ১৬, ২০২৩ ১:১৫ অপরাহ্ণ

মূল: হারুকি মুরাকামি

অনুবাদ: মিলটন রহমান

আমার এক তরুণ বন্ধুকে অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া একটি অদ্ভুদ ঘটনা সম্পর্কে বলছিলাম। তখন আমার বয়েস ছিলো আঠারো।  ঠিক মনে করতে পারছিনা কেনো তাকে সে ঘটনা বলতে শুরু করেছিলাম। কথা প্রসঙ্গেই ঘটনাটি উঠে এসেছিলো। অনেক আগের সেই ঘটনা। বলা চলে প্রাচীন। যদিও ওই ঘটনার কোন উপসংহারে আমি পৌঁছুতে পারি নি।

‘সবে মাত্র হাই স্কুল পাশ করেছি, তখনও কলেজে ভর্তি হই নি‘।

বন্ধুকে বললাম, আমি ছিলাম যাকে বলে একাডেমিক নিধিরাম সর্দার। যার কোন শিক্ষক কিংবা গুরু নেই। যে ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায় বিফল হয়ে অপেক্ষা করছে আরেকটি পরীক্ষার জন্য। এসব ভর্তির বিষয় আমার কাছে অনেকটা বায়ুবীয় মনে হয়েছিলো। ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আমি তেমন কোন দ্বিধা অনুভব করি নি। আমি জানি চাইলেই মোটামোটি ভালো একটি প্রাইভেট কলেজে  ভর্তি হতে পারি। কিন্তু বাবা-মা চান, আমি যেনো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করি। সুতরাং আমি পরীক্ষা দিয়েছি এ জেনে যে এবারের পরীক্ষায়ও বাতিলের খাতায় আমার নাম যাবে। অকার্যকর যে হবো সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় এলো। সেখানে আবশ্যকীয় বিষয় হিশেবে আছে অংক। উচ্চতর গণিতশাস্ত্রে আমার আগ্রহ একেবারে শূণ্যের কোটায়। পরের বছর আমি কেবল সময় অপচয় করে কাটিয়েছি, তৈরী করেছি বেঁচে যাওয়ার নানান অজুহাত। পরবর্তী পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার পরিবর্তে আমি যাওয়া আসা শুরু করেছিলাম স্থানীয় লাইব্রেরীতে।  মোটা উপন্যাসের পাতায় নিজেকে ঠেসে ধরলাম। আমার বাবা-মা মনে করতেন, আমি লাইব্রেরীতে পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করছি। আরে একটাইতো জীবন। দেখলাম ক্যালকুলাসের সূত্র সম্পর্কে ধারণা নেয়ার চেয়ে আমি বালজাকের উপন্যাস পড়া অনেক বেশি উপভোগ করছি।

সে বছর অক্টোবরের শুরুর দিকে, আমি একটি মেয়ের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পত্র পেলাম তার ‘পিয়ানো কনসার্টে‘ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য। সেই মেয়েটি স্কুলে আমার এক বছরের জুনিয়র ছিলো। তবে আমরা দু‘জনেই একই শিক্ষকের কাছে পিয়ানো বাজানো শিখতাম। একবার আমরা দু‘জনে একসাথে মোজার্টের সর্ট ফোর-হ্যান্ডস পিয়ানোর নোট বাজিয়েছিলাম।  ষোল বছর বয়সে আমি পিয়ানো তালিম নেয়া বাদ দেই। এরপর মেযেটির সাথে আমার আর কখনো দেখা হয় নি। অতএব আমি বুঝতে পারছি না কেনো সে আমাকে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পত্র পাঠালো। আমাকে কি সে পছন্দ করতো? সেটা কিভাবে সম্ভব! মেয়েটি ছিলো দেখতে অত্যন্ত রূপবতী, তার যে জীবন যাপন তা আমার মতো ছিলো না। পোশাকে-আশাকে সে ছিলো অত্যন্ত ফ্যাশন সচেতন। পড়তো একটি নামি-দামি প্রাইভেট গার্লস স্কুলে। আমার মতো দেখতে একটি কারখানা শ্রমিকের জন্য ঝাপিয়ে পড়ার মতো সে ছিলো না।

আমরা এক সাথে পিয়ানো বাজানোর সময়, মেয়েটি সব সময় তীর্যক এক দৃষ্টিবাণে আমাকে আঘাত করতো, আর আমি ভুল নোট বাজাতাম। আমার তুলনায় সে অনেক ভালো পিয়ানো বাজাতো। আমি কিছুটা অস্থিরমতি ছিলাম। সুতরাং আমরা পাশাপাশি বসে যখন পিয়ানো বাজাতাম, তখন আমি অনেকগুলো নোট এলোমেলো ভাবে বাজাতাম। সে সময় আমার কুনুইও তাকে বার কয়েক খোঁচা দিতো। আমার স্বরলিপি তেমন কঠিন ছিলো না । প্রতিবার আমার অংশ যখন বাজাই,তখন সে যেনো ‘আমাকে একটু রেহাই দাও‘ ধরণের বিরক্তি প্রকাশ করতো চোখে-মুখে। সে তার জিহ্বায় আঙুল ঠেকিয়ে বলতো-এতো উচ্চস্বরে নয়, সেটুকু উচ্চস্বরে বাজাও যাতে আমি বুঝতে পারি। আমি এখনো সেই শব্দ শুনতে পাই, এমনকি এখনো শুনছি। আমার পিয়ানো বাজানো ছেড়ে দেয়ার পিছনে সম্ভবত সে শব্দের একটি ভুমিকা ছিলো।

একই পিয়ানো স্কুলে আমরা পড়তাম, এই ছিলো আমাদের মধ্যে সম্পর্ক। দেখা হলে একে অপরকে ‘কেমন আছো‘ এটুকুই, জিজ্ঞেস করতাম। মনে পড়েনা আমরা কখনো নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলেছি। হঠাৎ করে তার পিয়ানো অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ(তার একার নয় আরো তিনজনের সাথে বাজাবে) পেয়ে আমি যার পর নাই বিস্মিত হয়েছিলাম-যা আমাকে রীতিমত হতবাক করেছিলো। তখন আমার হাতে অনেক সময় ছিলো, তাই আমন্ত্রপত্রের উত্তরে আমি জানিয়েছিলাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবো। এর একটা কারণ ছিলো, আমার খুব জানতে ইচ্ছে হলো, এই আমন্ত্রণ পাঠানোর পিছনে কি কারণ আছে-যদি সত্যিই কোন উদ্দেশ্য থাকে! এতোদিন পরে কেনো আমাকে এমন একটি অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হলো? সম্ভবত সে এখন অনেক ভালো পিয়ানো বাজায় তা আমাকে দেখাতে চায়। অথবা সম্ভবত ব্যক্তিগত কোন কথা ছিলো যা সে আমাকে জানাতে চায়। আমি তখনো চেষ্টা করেছিলাম কিভাবে আমার কৌতুহল সংবরন করা যায় এবং অবনত চিত্তে সবকিছুর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারি।

অনুষ্ঠানের হলটি ছিলো কুবে পাহাড়ের একেবারে উঁচুতে। আমি হেনকো ট্রেনে চড়ে বসলাম যাতে করে যতটুকু সম্ভব পাহাড়টির কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে বাসে উঠলাম। আঁকা-বাঁকা ঘুরানো একটি পথ বেয়ে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছালো বাস। আমি প্রায় পাহাড় চূড়ার কাছাকাছি নেমে পড়লাম। সেখান থেকে অল্প হেঁটেই পৌঁছুলাম আধুনিক একটি কনসার্ট ভ্যানুর সম্মুখে। ভ্যানুটির মালিক এবং পরিচালনা করে একটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আমি জানতাম না যে সেখানে একটি কনসার্ট হল ছিলো-পাহাড় শীর্ষে এমন দূর্গম এবং শান্ত আবাসিক প্রতিবেশে! এ হিশেবে তুমি মনে করতে পারো পৃথিবীতে অনেক বিষয় রয়েছে যার সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিলো না।

আমার এমন কিছু নিয়ে যাওয়া উচিত যাতে করে বুঝা যায় যে আমন্ত্রণ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ।  ট্রেন স্টেশনের কাছে একটি ফুলের দোকান থেকে এক গুচ্ছ ফুল নিলাম যা অনুষ্ঠানের সাথে মানানসইও বটে। সে ফুলগুলোকে একটি ঝুড়িতে র্যাপিং পেপার দিয়ে মুড়ে নিলাম। এরপর বাস দেখা মাত্রই উঠে পড়লাম। সময় ছিলো রবিবারের ঠান্ডা বিকাল। পুরো আকাশ ধূসর মেঘে ঢাকা। মনে হচ্ছিলো যে কোন সময় ঠান্ডা বৃষ্টি নেমে আসতে পারে। যদিও কোন বাতাস ছিলো না। আমি পড়েছিলাম নীল রঙের হ্যারিংবোন জ্যাকেটের নীচে পাতলা একটা স্যুয়েটার, এবং আমার কাধে ঝুলানো ছিলো একটি ক্যানভাস ব্যাগ। আমার জ্যাকেট ছিলো একেবার নতুন। ব্যাগটি ছিলো পুরনো এবং জীর্ণ। আমার হাতে ছিলো সেলোফ্যান মোড়ানো দৃষ্টি নন্দন লাল ফুলের তোড়া। আমি যখন বাসে উঠলাম লক্ষ্য করলাম অন্য যাত্রীরা আমার দিকে তাকাচ্ছে বারবার। অথবা তাকিয়ে থাকা যাত্রীরা মনে করছিলো যে তারা যদি এমন করতে পারতো-তাদের দৃষ্টি ছিলো তেমনই। সে পরিবেশে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম।  লাল হয়ে উঠেছিলো দুই চোয়াল। কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো আমি মানুষের সামান্য দৃষ্টিবানেই লজ্জিত-একথা ভাবতেই আমার মুখ থেকে লালাভ ভাব চলে গেলো।

নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি এখানে কেনো? বাসের সিটে বসে ঘাড়ে হাতের তালু বুলিয়ে কিছুটা স্থির হওয়ার চেষ্টা করি। আমি কেবল ওই মেয়েটিকে দেখতে চাই নি, শুনতে চাই নি তার পিয়ানো বাজানো। তাহলে আমি এক গোছা ফুল নিয়ে নভেম্বরের এমন ভয়ংকর ঠান্ডা বিকালে কেনো পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যাচ্ছি! আমন্ত্রণের উত্তরে পোস্ট কার্ডটি ডাক বাক্সে ফেলা কি ভুল হয়েছিলো? 

আমরা যখন পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাই তখন বাসে কয়েকজন মাত্র যাত্রী অবশিষ্ট ছিলো।  কিছুক্ষণ পর নির্দিষ্ট বাসস্টপে পৌঁছাই শুধু আমি এবং বাস ড্রাইভার। বাস থেকে নেমে পড়ি।  আমন্ত্রণ পত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী ঢালু পথ ধরে হাটতে থাকি। যতবার আমি কোন বাঁক পরিবর্তন করি ততবার একটা বন্দর দৃষ্টি সীমায় ধরা দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ছিলো নিস্তেজ রঙে ম্লান, যেনো সীসার আবরণে ঢাকা। বন্দরে সারি সারি ক্রেন দেখা যাচ্ছে, যা কতিপয় অদ্ভুদ প্রাণীর এন্টেনার মতো বাতাসে ঝাপিয়ে পড়ছে এবং হামাগুড়ি দিয়ে সমুদ্রে মিলিয়ে যাচ্ছে।

পাহাড়ের ঢালুর বাড়িগুলো ছিলো বৃহৎ এবং অত্যন্ত বিলাসবহুল। চতুর্দিকে চোখ ধাঁধানো পাথরের দেয়াল, অত্যন্ত নান্দনিক গেইট এবং দু‘টো গাড়ীর গ্যারেজ। আজারিয়া ফুলের তৈরী দেয়াল চমৎকারভাবে ছাটা। শুনলাম কোথাও অনেকগুলো কুকুর  সমস্বরে ডাকছে। কুকুরগুলি উচ্চস্বরে তিনবার ডাকার পর কে যেনো তাদের থামিয়ে দিলো। এরপর চারপাশ একেবার নিস্তব্দতায় ঢেকে গেলো। 

আমি আমন্ত্রণ পত্রের ম্যাপ অনুসরণ করে আগাচ্ছিলাম। তবে কেবলই মনে হচ্ছিলো কোথাও যেনো বাঁধা পড়ে যাচ্ছি। প্রথমত, রাস্তায় কোন জনমানবের দেখা মিললো না। বাস থেকে নামার পর থেকে আমি একটি পথচারিও দেখলাম না। কেবল দু‘টো কার চলে গেলো পাহাড়ী ঢালু পথ বেয়ে নীচের দিকে। যদি এখানে কোন পিয়ানো কনসার্টের আয়োজন করা হয়ে থাকে তাহলেতো অনেক মানুষের সাথে দেখা হওয়ার কথা। প্রতিবেশিদের মধ্যেও বিরাজ করছে নিরবতা। যেনো উপরের মেঘগুলো সমস্ত সরব শব্দ গিলে ফেলছে।    

আমার কি বুঝতে ভুল হয়েছে?

আমি পকেট থেকে আমন্ত্রণ পত্রটি বের করে আবার দেখে নিলাম। সম্ভবত সেটি ভুল পড়ে থাকতে পারি। খুব সতর্কভাবে পুরো আমন্ত্রণ পত্রে চোখ বুলিয়ে নিলাম, কোন ভুল চোখে পড়লো না। ঠিক বাস স্টপে নেমে সঠিক রাস্তায় এসেছি, সময় এবং তারিখ সবই ঠিক আছে। নিজেকে হালকা করার জন্য একটি দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে স্থির হয়ে বসলাম। তবে আমি ঠিকঠাক কনসার্ট হলটি দেখতে পেয়েছি। দেখলাম ভবনটির সম্মুখে বিশালকায় স্টীলের গেইটে একটা তালা ঝুলছে। মোটা একটি চেইন পেচিয়ে আছে গেইটে, তাতে ঝুলছে তালা। আশে-পাশে কাউকে দেখা গেলো না। গেইটের একপাশে কিঞ্চিত খোলা। পিছনে গাড়ি পার্কিং এলাকা, কিন্তু সেখানে একটাও গাড়ি পার্ক করা নেই। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে হালকা ঘাস গজিয়েছে। পার্কিং এলাকাটি দেখে মনে হলো তা আর ব্যবহার হয় না। তবে হলের সম্মুখে ঝুলে থাকা বিশাল সাইবোর্ড বলে দিচ্ছি এটিই সেই অনুষ্ঠানের স্থান, যেটি আমি খুঁজছিলাম।

আমি গেইটের পাশে রাখা ইন্টারকমে বার কয়েক চাপ দিলাম। ভেতর থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেলো না।  কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার ইন্টারকম বাজালাম, এবারও কোন সাড়া পাওয়া গেলো না। ঘড়ির দিকে তাকালাম। অনুষ্ঠান শুরু হতে আর পনের মিনিট বাকি। কিন্তু অনুষ্ঠানের জন্য গেইট খোলার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। জং ধরা গেইট থেকে রঙ খসে খসে পড়ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবোÑআরো একবার ইন্টারকমে চাপ দিলাম। এবার চাপ দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে রাখলাম, কিন্তু ফলাফল একই-কোন সাড়া পাওয়া গেলো না। চতুর্দিকে গভীর নিরবতা।

বুঝে উঠতে পারছিলামনা কি করবো। গেইটের সাথে হেলান দিয়ে প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার আশা ছিলো, কেউ একজন হয়তো আসবে। কিন্তু কেউ এলো না। ভিতরে বাইরে কোথাও কোন জন মানবের আসা যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেলো না। এমনকি সেখানে বাতাস পর্যন্ত নেই। কোন পাখি কিংবা কুকুরের ডাকও শুনা গেলো না। আগের মতোই থান থান ধুসর মেঘের কম্বলে ঢেকে আছে সব।

অবশেষে আশা ছেড়ে দিলাম,  কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কি করবো? দ্রুত পায়ে ঢালু পথ বেয়ে বাস স্টপের দিকে হাঁটতে থাকি। কি ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, সব কেমন যেনো কূয়াশাচ্ছন্ন।  তবে পরিস্কার বুঝতে পেরেছিলাম যে সেখানে কোন পিয়ানো কনসার্ট বা অনুষ্ঠান নেই। আমি লাল ফুলের তোড়াটি হাতে নিয়ে বাড়ি মুখি যাত্রা শুরু করি। মা আমাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেÑফুলগুলো কেনো? ঠিক করি ফুলগুলো স্টেশনের বীনে ফেলে দেবো।  যদিও ফুলগুলো আমার কাছে ছিলো অমূল্য।

পাহাড়ের পাদদেশে  দেখা মিললো একটি ছোট্ট গোছানো পার্ক। আকারে একটি বাড়ির মতো। পার্ক থেকে কিছুটা দূরে এবং রাস্তার অদূরে ছিলো কোনাকৃতি একটি প্রাকৃতিক শীলা প্রাচীর। শুধুই একটি পার্কÑসেখানে ছিলো না কোন জলের ফোয়ারা কিংবা খেলাধুলার সরঞ্জাম। পার্কের মাঝখানে ছিলো অনেকটা ডুব দেয়া ছোট একটি বনকুঞ্জ। সেই বনের দেয়ালটি ঢাকা ছিলো লতাগুল্মে। চারদিকে ছিলো ঝোপঝাড়, সমতলে বিছানো ছিলো হেটে যাওয়ার চারকোনা পাথর। বলা মুস্কিল ছিলো যে কেনো এই পার্ক তৈরী করা হয়েছে, তবে কেউ একজন এই পার্কের পরিচর্যা করে; গাছ এবং লতাগুল্মগুলো চমৎকারভাবে ছাটা, চারপাশে কোন আগাছা বা আবর্জনা নেই। আমি পাহাড়ের উঁচুতে এ পার্কের পাশ দিয়ে গেলেও খেয়াল করিনি।

নিজেকে কিছুটা সামলে নিতে আমি পার্কের ভেতরে প্রবেশ করে বনকুঞ্জের পাশে একটি বেঞ্চিতে বসে পড়ি। ঠিক করি, এই এলাকাটি সম্পর্কে ধারণা নিতে আরো কিছু সময় আমার সেখানে থাকা উচিত। বসার পরে বুঝতে পারলাম আমি কতটুকু ক্লান্ত। এ যেনো অদ্ভুদ এক ক্লান্তি যা আমি এতক্ষণ খেয়াল করিনি। বসার পরেই জগতের সব ক্লান্তি আমার উপরে চেপে বসলো। বনকুঞ্জের পাশ থেকে পরিস্কার দেখা যায় বন্দর। কিছু বড় কন্টেইনার জাহাজ বন্দরের জেটিতে নোঙর করেছে। পাহাড়ের উপর থেকে জাহাজে থরে থরে রাখা কন্টেইনারগুলোকে ছোট ছোট টিনের মতো মনে হচ্ছে, যেনো টেবিলের ওপর কয়েন বা পেপার ক্লিপ রাখার পাত্র।   

কিছুক্ষণ পর অদূরে একটি পুরুষ কন্ঠ শুনতে পাই। সে কন্ঠ স্বাভাবিক নয়, সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে উচ্চশব্দে প্রচারিত। আমি বুঝতে পারিনি কি বলছিলো, তবে প্রত্যেক বাক্য উচ্চারণের পর একটু বিরতি দিচ্ছিলো, এবং পরিস্কার উচ্চারণে কথা বলছিলো। কোন রকম আবেগ ছাড়া, যেনো গুরুত্বপূর্ণ কোন বার্তা দেয়ার চেস্টা করছিলো। আমার মনে হয়েছিলো সে বার্তা আমাকে দেয়া হচ্ছিলো। আমার কোথায় ভুল ছিলো তা যেনো কেউ একজন বলার চেস্টা করছে, যা আমি উপেক্ষা করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তা আর এমন কি, কিন্তু ঘটনাটি আমাকে ভীষণভাবে আঘাত করেছিলো। আমি একাগ্রচিত্তে শুনছিলাম সে বার্তা। কন্ঠটি উচ্চ কিন্তু স্থির হয়ে এলো যা আমার পক্ষে বুঝতে সহজ হলো। কন্ঠটি নিশ্চিত কারের উপরে বাঁধা কোন সাউন্ডবক্স থেকে আসছিলো। কারটি ঢালু পথ বেয়ে ধীরে ধীরে আগাচ্ছিলো। অবশেষে আমি বুঝতে পারলাম একটি কার থেকে খ্রীস্টান বার্তা প্রচার করা হচ্ছিলো।

শান্ত কন্ঠে বলছে, ‘সবাইকে একদিন মরতে হবে। প্রত্যেককে একদিন দেহত্যাগ করতে হবে। কেউ মৃত্যু এবং তার পরবর্তী সৃষ্টিকর্তার বিচার থেকে বাঁচতে পারবে না। প্রত্যেকে মৃত্যুর পর তার কৃতকর্মের জন্য বিচারের মুখোমুখি হবে‘।   

আমি  বেঞ্চে বসে সে বার্তা শুনছিলাম । পাহাড় চূড়ায় এমন নির্জন এলাকায় কে এভাবে ধর্ম প্রচার করছে, তা ভেবে কিছুটা বিস্ময় জেগেছিলো। এখানে যারা বসবাস করে প্রত্যেকে ধনী, এক একজনের গাড়ী আছে কয়েকটা। আমার মনে হলো, তারাই হয়তো পাপ থেকে মুক্তি চাইছিলো, অথবা তারা কি পাপী ছিলো? তাদের আয় এবং জীবন যাপন পাপ ও পরিত্রাণ যোগ্য নয়!

‘যারা যিশুখখ্রীস্টের মধ্যে মুক্তি খুঁজছে এবং নিজের পাপের জন্য অনুতপ্ত হচ্ছে, তাদেরকে ঈশ্বর ক্ষমা করবে। তারা নরকের আগুন থেকে বেঁচে যাবে। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখ, শুধুমাত্র এই জন্যেই ঈশ্বর বিশ্বাসীরা মৃত্যুর পর ক্ষমা পাবে এবং অমরত্ব লাভ করবে।‘

আমি খ্রীস্টান মিশনারী কারটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম এবং আরো শুনতে চাইছিলাম মৃত্যুর পর কি বিচার হবে। মনে করেছিলাম, আশ্বস্ত হওয়ার মতো আরো কিছু কথা শুনবো, স্থির কন্ঠে, কোথা থেকে বলছে সেটা কোন বিষয় নয়। কিন্তু না কারটি আমার চোখে পড়লো না। এক সময় সেই কন্ঠ ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছিলো, কিছুক্ষণ আর আর কিছুই শুনতে পেলাম না। গাড়িটি আমি যেখানে আছি সেখান থেকে হয়তো উল্টো পথে যাত্রা শুরু করেছে। গাড়িটি মিলিয়ে যাওয়ার পর মনে হলো পৃথিবী যেনো আমাকে বিসর্জন দিয়েছে।

হঠাৎ নিজের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগলো, সম্ভব এই গোলকধাঁধা ওই মেয়েটিই তৈরী করেছে। এই পরিকল্পনা অন্য কোথাও থেকে আসছে না। যে কোন কারণে আমি জানতে পারিনিÑমেয়েটি আমাকে একের পর এক ভুল তথ্য দিয়ে রোববার বিকালে টেনে এই  দূর্গম পাহাড় চূড়ায় উঠিয়েছে। হয়তো এমন কিছু করেছি যার ফলে আমার বিরুদ্ধে তার মনে ক্ষোভ জমেছে।  অথবা হতে পারে বিশেষ কোন কারণ নয়, আমাকে সে অতিশয় নিরস মানুষ হিসেবে পেয়েছে, যা সে আশা করে নি। তাই সে আমাকে অনুষ্ঠানের নাম করে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে এখন মজা নিচ্ছে। হয়তো সে এখন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছে বা আন্দাজ করছে আমি কোন পরিস্থিতিতে পড়েছি-সে আমাকে কতটুকু বোকা বানিয়েছে, আর এ পরিস্থিতিতে পড়ে আমাকে কতটুকু করুণ এবং হাস্যকর দেখাচ্ছে।

একজন ব্যক্তি কিভাবে আরেকজনকে বিপাকে ফেলার জন্য এতো জটিল পরিকল্পনা করতে পারে, ভেবে পাচ্ছি না। আমন্ত্রণ পত্র ছাপার জন্যওতো তাকে সময় দিতে হয়েছে। এমন করার কি কোন মানে হয়? মেয়েটি আমার ওপর ক্ষেপে থাকার মতো কোন কাজ করেছি বলে কোন মতেই মনে পড়ে না।  তবে কোন কোন সময় এমনও হয় আমরা না বুঝেই, অন্যের অনুভুতির উপর আঘাত করি, তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি, তাদের মন খারাপের কারণ হই। আমি অযাচিত ঘৃণার আশংকাও করছি, হয়তো কোন একটা ভুল বুঝাবুঝি আমাদের হয়েছিলো, তবে সঠিক কোন কিছুই আমি মনে করতে পারছি না। নিরর্থক আবেগের এক গোলক ধাঁধায় আমি ঘুরে ফিরছি-মনে হচ্ছে আমার অনুভুতি গতি হারাচ্ছে। এমন মনে হওয়ার আগে, আমি শ্বাস কস্টে ভুগছিলাম।

প্রতি বছর দু‘একবার আমার এমন হয়। মনে হয় তা ছিলো মানসিক চাপে সৃষ্ট শ্বাসকষ্ট। কিছু একটা আমাকে ঝাকুনি দিচ্ছে,গলা শুকিয়ে আসছে, এবং বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমি আতংকিত হয়ে পড়ি, যেনো প্রচন্ড স্রোতে তলিয়ে যাচ্ছিলাম, জমে যাচ্ছিলো শরীর। সেই সময় আমি মাথা গুঁজে বসে, চোখ বন্ধ করে, ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছিলাম কখন আমার শরীর স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার এ উপসর্গ কেটে গেলো(কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি নিজেই একে রোধ করতে সক্ষম হই) যদিও কৈশোরে এ সমস্যা আমাকে অনেক ভূগিয়েছিলো।

আমি কুঞ্জবনের পাশে বেঞ্চিতে স্থির দৃষ্টি রেখে উপুড় হয়ে বসে থাকি, এবং সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়ার চেস্টা করি। এভাবে হয়তো পাঁচ মিনিট কিংবা পনের মিনিট ছিলাম। ঠিক বলতে পারবো না কত সময় ছিলাম। পুরো সময় দেখতে পেলাম অদ্ভুদ কিছু একটা চোখের সম্মুখে আসছে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। ধীরে সেগুলো গুনতে থাকলাম এবং নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে আনার চেস্টা করলাম। আমার হৃদস্পন্দন পাঁজরের ভেতর দুমড়ে মুষড়ে দিচ্ছে, যেনো আতংকগ্রস্থ কোন ইঁদুর ভেতরে ধাপাধাপি করছে।

আমি অদ্ভুদ সেই বস্তুটি খুব সতর্কতার সাথে গুনছিলাম, ফলে অন্য কেউ একজন যে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তা টের পেতে কিছুটা সময় লাগলো। মনে হলো কেউ সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। সাবধানে, ধীরে ধীরে চোখ খুলে মাথা তুললাম। তখনো আমার অস্বাভাবিক রকম হৃদকম্প হচ্ছিলো। অলক্ষ্যে এক বৃদ্ধ লোক টেবিলের প্রান্তে বসে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কোন তরুণের পক্ষে একজন বয়োবৃদ্ধ লোকের বয়স নির্ণয় করা অতো সহজ নয়। আমার কাছে তারা সবাই বৃদ্ধ লোক। ষাট, সত্তর-কি পার্থক্য তাতে? তারাতো আর তরুণ নয়, সেটাই আমার কাছে বিবেচ্য। লোকটি পরেছে নীল-ধূসর রঙের একটি উলের কার্ডিগান, কড কাপড়ের বাদামী পেন্ট এবং আকাশী-নীল রঙের এক জোড়া জুতো। তার পরনের পোশাক নতুন না পুরাতন তা বুঝতেও চলে গেলো কিছু সময়। এমন  নয় যে তিনি নোংরা বা সেরকম কোন পোশাক পরেছে। তার ধূসর-ঘন চুল ছিলো বেশ খাড়া। পাখি স্নান সারার পর ডানা দু‘টি যেভাবে মেলে ধরে টিক সেরকম লোকটির দুই কানের উপর চুলগুলি খাড়া হয়ে আছে। তার চোখে কোন চশমা ছিলো না। জানিনা লোকটি সেখানে কতক্ষণ ধরে অবস্থান নিয়েছে। আমার ধারণা অনেক আগে থেকেই সে আমাকে লক্ষ্য করছে।

নিশ্চিত ছিলাম লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি ঠিক আছো?‘ বা সেরকম কিছু। কারণ দেখেই মনে হতে পারে যে আমি বিপাকে আছি(আমি ছিলামও তাই)। লোকটিকে দেখে আমার প্রথমে এমনটিই মনে হয়েছিলো। কিন্তু লোকটি কিছুই বলেনি, জিজ্ঞেসও করেনি কিছু, শুধু শক্তভাবে লাঠির মতো ধরে আছে একটি ছাতা। ছাতাটির পীতাভ তৈলস্ফটিক রঙের একটি কাঠের হাতল রয়েছে, যা প্রয়োজন হলে যেনো অস্ত্র হিশেবে ব্যবহার করা যায়। তার সাথে যেহেতু আর কিছুই ছিলো না, তাই আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে লোকটি এ পাড়ারই বাসিন্দা।

আমি সেখানে বসে নিজেকে স্থির করার চেস্টা করছিলাম, বুড়ো লোকটি নিরবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একবারের জন্যও চোখের পলক ফেলে নি। আমি তাতে অস্বস্তি বোধ করছিলাম- যেনো কারো বাড়ির পিছনের উঠোনে অনুমতি ছাড়া ঘুরাঘুরি করছিলাম। চেস্টা করছিলাম বেঞ্চ থেকে উঠে যত দ্রুত সম্ভব বাস স্টপে গিয়ে পৌঁছি। কিন্তু কেনো যেনো সেখান থেকে এক পাও এগুতে পারলাম না। সময় যাচ্ছে, এমন সময় বুড়ো বলে উঠলো-

‘একটি বৃত্তের মধ্যে অনেক কেন্দ্র‘।

আমি তার দিকে তাকালাম। চোখাচোখি হলাম। প্রসস্ত তার কপাল, টিকাল তার নাক। পাখির ঠোঁটের মতো শানিত। আমি কিছুই বলতে পারি নি। তাই বুড়ো আবার সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করলো- ‘একটি বৃত্তের মধ্যে অনেক কেন্দ্র।‘

প্রকৃতই, আমি বুঝতে পারছিলাম না যে সে কি বলতে চাইছিলো। এসময় মনে হলো, এই লোকটিই খ্রীস্টিয়ান সেই মাইকসহ কারটি চালাচ্ছিলো। পাশে কোথাও গাড়ি পার্ক করে এখানে বসেছে বিশ্রাম নিতে।  আবার মনে হলো, না তা হতে পারে না। আমি যার গলা শুনেছিলাম মাইকে তার কন্ঠ আর এই বুড়োর কন্ঠ এক নয়। সেই কন্ঠ কোন এক তরুণের ছিলো। অথবা হতে পারে, সে কন্ঠ রেকর্ড করা ছিলো।

‘তুমি কি বলেছো, বৃত্ত?‘ অনেকটা অনিচ্ছায় আমি জিজ্ঞেস করি। তিনি আমার চেয়ে অনেক বয়স্ক, তাই খুব ভদ্রভাবেই জানতে চাইলাম।

‘সেখানে অনেকগুলো কেন্দ্র রয়েছে-না, কখনো কখনো এ সংখ্যা অসীম। এবং এটি রহস্যাবৃত বৃত্ত‘। একথা বলেই বুড়ো ভ্রু কুঁচকালো-কপালে গভীর ভাজ। ‘তুমি কি নিজের চিন্তায় এমন কোন বৃত্ত দেখতে পাও?‘

আমি তখনো ধাতস্থ হয়ে উঠিনি-তবে তার কথা গুরুত্বসহকারে নিয়েছিলাম। একটি বৃত্ত, তার অনেকগুলো কেন্দ্র রয়েছে, কিন্তু তার কোন বেস্টনি নেই।  আমি এ বিষয়ে কিছুই কল্পনা করতে পারছিলাম না।

‘আমি কিছু বুঝিনি‘ বললাম।

বৃদ্ধ নিরবে আমার দিকে তাকালো। সম্ভবত এর চেয়ে ভালো কোন উত্তর আমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করেছিলো।

‘গণিতের ক্লাসে এধরনের কোন বৃত্তের বিষয়ে আমাদের পড়ানো হয়েছে, এমন মনে পড়ে না‘ আমি দু:খিত এমন ভাব নিয়ে কথা ক‘টি যুক্ত করলাম।

বৃদ্ধ ধীরে মাথা নাড়লো। ‘অবশ্যই না। যদিও তা প্রত্যাশিত ছিলো। তারা তোমাকে এ ধরনের কোন গণিত শিক্ষা দেয় নি। তুমি তা ভালোই জানো।‘

আমি ভালো জানি? কেনো লোকটি এভাবে অনুমান করছে?

‘সত্যিই কি এ জাতীয় বৃত্ত বিদ্যমান?‘  জিজ্ঞেস করলাম।

‘অবশ্যই বিদ্যমান‘ কয়েকবার ঝাকুনি দিয়ে বুড়ো বললো। ‘এই বৃত্ত আসলেই বিদ্যমান। কিন্তু সবাই তা দেখতে পায় না-তুমি জানো।

‘তুমি কি তা দেখতে পাও?‘

বুড়ো কোন উত্তর দেয় না। আমার প্রশ্নটি বেয়াড়ার মতো কিছুক্ষণ ঝুলে তাকালো, এবং এক সময় ধোঁয়াসা হয়ে মিলিয়ে গেলো।

বুড়ো আবার কথা বলে উঠলো, শুনো নিজের কল্পনা শক্তি দিয়ে তোমাকে তা অনুমান করতে হবে। তোমার সমস্ত বুদ্ধি দিয়ে তাকে দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। একটি বৃত্ত যার অনেকগুলো কেন্দ্র রয়েছে কিন্তু আয়তন নেই। তুমি এমন নিবিড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও, রক্তঘাম ঝরাও-দেখবে বৃত্তটি ক্রমান্বয়ে পরিস্কার হয়ে উঠছে। 

‘বিষয়টি খুব জটিল মনে হচ্ছে‘ আমি বললাম। 

‘অবশ্যই জটিল-বুড়ো বললো। এমনভাবে বললো মনে হলো শক্ত কোন কিছু যেনো মুখ থেকে বের করছে। ‘পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যে যা সহজে তুমি পেতে পারো‘। তারপর  নতুন কিছু বলার জন্য খাকারি দিয়ে গলা পরিস্কার করে নিলো। ‘কিন্তু তুমি যদি এর পেছনে সময় এবং প্রচেস্টা অব্যহত রাখো, এবং জটিল বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে পারো, তাহলে তা তোমার জীবনের সেরা অর্জন(ক্রীম) হয়ে উঠবে।

‘ক্রীম?‘

‘ফ্রান্সে একটি শ্লোক আছে ‘ক্রীম দে লা ক্রীম‘ তুমি জানো সেটা?‘

বললাম ‘জানি না‘, ‘আমি ফ্র্যান্স জানি না।‘

ক্রিম এর ক্রীম। মানে ভালোর চেয়ে ভালো। এটাই জীবনের গূঢ় সারকথা-সেটা হচ্ছে ‘ক্রীম দে লা ক্রীম। বুঝতে পেরেছো? আর বাকি সব বিরক্তিকর এবং অর্থহীন।

আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না যে ‘ক্রীম দে লা ক্রীম‘ এর মধ্যে কি পেয়েছে?

‘এ বিষয়ে চিন্তা করো‘ বুড়ো বললো। আবার তোমার চোখ বন্ধ করো, গভীর ভাবে চিন্তা করো। একটি বৃত্ত যার অনেকগুলো কেন্দ্র রয়েছে কিন্তু আয়তন নেই। তোমার মস্তিস্ককে কঠিন বিষয়ে চিন্তা করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। যা তোমাকে এমন অবস্থানে নিয়ে যাবে, তাতে তুমি যা বুঝতে পারছো, তা প্রথমে বুঝতে পারো নি। তুমি অলসতা কিংবা অবহেলা করতে পারো না। ঠিক এখন খুব সংকটাপন্ন সময়। কারণ এটা হচ্ছে তোমার মস্তিস্ক এবং হৃদয়কে একিভুত করার সময়।

আমি চোখ বন্ধ করে আবার সেই বৃত্তটিকে দৃশ্যমান করার চেষ্টা করলাম। আমি অলস কিংবা অবহেলাকারী হতে চাই না। তবে লোকটি কি বলছে তাকে আমি কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি তা বিবেচ্য বিষয় নয়, কিন্তু সে কি বলছে তার অর্থ সে সময় আমার পক্ষে বুঝা প্রায় অসম্ভব ছিলো। আমি জানি বৃত্তের একটি কেন্দ্র আছে, এবং বাঁকানো একটি পরিধি পুরো বৃত্তকে একটি কেন্দ্রে স্থাপন করে। কম্পাস দিয়ে এমন একটি সাধারণ চিত্র আঁকা যায়। বৃত্ত তো এমনই, কিন্তু বুড়ো বৃত্তের বাইরে কথা বলছিলো কেনো? মানে আয়তন নেই কেনো বলছে? 

একবারও ভাবি নি যে বুড়ো মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলো। এও ভাবি নি যে লোকটি আমাকে খেপানোর চেস্টা করছিলো। সে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা আমাকে বলতে চাইছে। অতএব আমি আবার বুঝার চেস্টা করলাম, কিন্তু আমার মন কেবল চতুর্দিকে আকুলি বিকুলি করলো বুঝতে পারলো না কিছুই। কিভাবে অনেক কেন্দ্র রয়েছে (বা সম্ভবত অসংখ্য) এমন বৃত্ত একটি বৃত্তে উপস্থিত হতে পারে? এটি কি কোন পরিণত দার্শনিক রূপক ছিলো? আমি হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ খুললাম। বুঝার জন্য আমার আরো সূত্র বা ইঙ্গিত দরকার।

কিন্তু বুড়ো লোকটিকে আর দেখা গেলো না। আমি চতুর্দিকে তাকালাম, পার্কে কারো অবস্থানের কোন ইঙ্গিত পাওয়া গেলো না। মনে হচ্ছিলো এখানে কেউ ছিলোই না। আমি কি পুরো বিষয়টি কল্পনা করেছিলাম? না, অবশ্যই তা কোন কল্পনা ছিলো না। লোকটি আমার সম্মুখেই সেখানে ছিলো, হাতে শক্ত করে ধরা ছিলো একটা ছাতা, শান্তভাবে কথা বলছিলো, একটি অদ্ভুদ প্রশ্ন উত্থাপন করলো, এবং মিলিয়ে গেলো!

এতক্ষণে বুঝতে পারি আমার হৃদকম্পন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, শান্ত এবং স্থির। মানসিক চাপ কমে এসেছে। বন্দরের উপরে শূণ্য আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে যাচ্ছিলো। এক চিলতে আলোকরশ্নি ভেঙে ক্রেনের উপরে রূপোলী ধাতু নির্মিত ঘরের উপরে পড়েছে। সেই আলো নির্দিষ্ঠ কোন একটি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে এগুচ্ছে।  আমি দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম, মনে হলো তা একটি পৌরাণিক দৃশ্যে রূপ নিলো।

জরি কাগজে মোড়ানো একগুচ্ছ লাল ফুল আমার পাশেই ছিলো। যেনো এতক্ষণ যে অদ্ভুদ ঘটনা ঘটে গেলো তার স্বাক্ষী হয়ে রইলো। আমি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম কি করবো এ ফুল দিয়ে, বরং তা কুঞ্জবনের বেঞ্চে রেখে দিয়ে সে পর্বের শেষ করলাম। সেটাই ছিলো আমার জন্য সবচেয়ে সময়োপযোগি। উঠে দাঁড়ালাম এবং হাঁটতে শুরু করলাম বাস স্টপের দিকে, যেখানে নেমে আমি এখানে এসেছিলাম। প্রচন্ড বেগে বাতাস বইতে শুরু করেছে। ছুটতে শুরু করেছে স্তুপাকৃতি মেঘ।

গল্পটা বলা শেষ হওয়ার পর আমি একটু থামি। তারপর আমার তরুণ বন্ধু বলে ওঠে- ‘আমিও আসলে কিছু বুঝতে পারি নি। আসলেই কি হয়েছিলো? কার্যত সেখানে কি কোন নীতি বা উদ্দেশ্য ছিলো?‘ 

শরতের শেষের দিকে রবিবার বিকালে কোবে পর্বত চূড়ায় আমি এমন সব অদ্ভুদ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলাম। একটি আমন্ত্রণ পত্র অনুসরন করে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিলো-কিন্তু আবিস্কার করলাম জনমানবহীন একটি ভবন-এসব ঘটনার মানে কি? কেনো এসব ঘটেছে? আমার বন্ধু এসব জিজ্ঞেস করছিলো। একেবারে স্বাভাবিক প্রশ্ন। বিশেষত আমি তাকে যে গল্প বলেছি তা কোন উপসংহারে পৌঁছোতে পারি নি।

স্বীকার করলাম, ‘আমি নিজেও সে ঘটনা বুঝতে পারি নি, এমন কি এখনো না।‘

যা অমিমাংসিতই রয়ে গেলো, অনেকটা প্রাচীন ধাঁধার মতো। সেদিন যা ঘটেছিলো তা অবর্ণনীয় এবং অনধিগম্য। আঠারো বছর সে ঘটনা আমাকে বিস্ময় ও রহস্যের মধ্যে ঠেসে রেখেছিলো।

‘তবে আমি অনুভব করেছি‘ বললাম, ‘সেই ঘটনার উদ্দেশ্য বা  বিধেয় তেমন কোন বিষয় ছিলো না‘। 

আমার বন্ধু কিছুটা বিস্ময়াভিভুত দৃষ্টিতে বললো, তার মানে তুমি বলছো, কেনো ওই অদ্ভুদ ঘটনা ঘটেছিলো তার সম্পর্কে কিছুই জানার দরকার নেই?

আমি হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালাম।

সে বললো, যদি তোমার জায়গায় আমি হতাম তাহলে, অবশ্যই এর শেষ জানতে না পারাটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলতো। আমি এর সত্য জানতে চাইতাম, কেনো এমন ঘটনার অবতারণা হলো।

অবশ্যই, বিষয়টি আমাকেও অস্বস্তিতে রেখেছে। অনেক। ঘটনাটি এখনো আমাকে রীতিমতো আঘাত করে। তবে পরে ভেবে দেখলাম, অনেক সময় পার হয়ে গেলো, ঘটনাটিও স্মৃতিতে অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে, সেটা নিয়ে হতাশ হওয়াটা বুদ্ধির কাজ হবে না। আমি ভাবলাম জীবনের সুবর্ণ প্রাপ্তি(ক্রীম)‘র সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

‘জীবনের ক্রীম‘ সে পূনরোচ্চারণ করলো।

তাকে বললাম, এমন ঘটনা কোন কোন সময় ঘটতে পারে। অবর্ণনীয়, অযৌক্তিক ঘটনাগুলি খুব বিরক্তিকর। বরং আমরা এ বিষয়ে আর না ভাবলেই ভালো। চোখ বন্ধ করে সে ঘটনাগুলো অনুভব করো। ঠিক আমরা যেভাবে বিশাল বিশাল ঢেউ ঠেলে এগুই।      

আমার তরুণ বন্ধু কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকলো, অনুভব করলো সেই ঢেউ। সে অবশ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় দক্ষ ছিলো। ও এমন আরো অনেক জটিল বিষয় মোকাবেলা করেছে যা প্রচন্ড ঢেউয়ের মতো তেড়ে আসে। অবশেষে সে বলে, ‘তবে কোন বিষয়ে চিন্তা না করাটাও বেশ কঠিন হতে পারে।‘

‘ঠিক বলেছো, তাও কঠিন হতে পারে।‘

‘এই পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা তুমি সহজে পেতে পারো।‘ বুড়ো লোকটি বলেছিলো, অদম্য বিশ্বাসের সাথে। ঠিক পিথাগোরাস তার উপপাদ্য যেভাবে বিশ্লেষণ করেছিলো সেভাবে।

‘সেই বৃত্তের অনেক গুলো কেন্দ্র ছিলো কিন্তু কোন আয়তন ছিলো না‘, আমার বন্ধু বললো, এর কোন অর্থ তুমি খুঁজে পেয়েছো?

‘ভালো প্রশ্ন।‘ আমি বললাম। ধীরে মাথা উঁচু করলাম। সত্যিই আমি কি কোন উত্তর খুঁজে পেয়েছিলাম?

আমার জীবনে যখনি অনির্বচনীয়, অযৌক্তিক ও বিরক্তিকর ঘটনা ঘটে(বলছিনা যে সব সময় ঘটে, কখনো কখনো ঘটে), সব সময় আমি ফিরে আসি সেই বৃত্তের কাছে-একটি বৃত্ত, যার অনেকগুলো কেন্দ্র আছে কিন্তু কোন আয়তন নেই। তাই করি যা আমি আঠারো বছর বয়সে করেছিলাম বনকুঞ্জের পাশে বেঞ্চিতে বসে। চোখ বন্ধ করি আর হৃদপিন্ডের শব্দ শুনি।

কখনো কখনো আমি উপলব্দি করতে পারি কি সেই বৃত্ত, কিন্তু এর গভীর মর্মার্থ আমাকে থামিয়ে দেয়। সম্ভবত এটি মূর্ত কোন বৃত্ত নয়, সত্যিকারের গঠন কিন্তু, এটি কেবল বিদ্যমান আমাদের মস্তিস্কে। যখন আমরা কাউকে গভীর ভালোবাসি, অথবা কারো সাথে গভীর সমেবেদনা অনুভব করি, বা পৃথিবী কেমন হওয়া উচিত সেরকম ভাববাদী হয়ে উঠি, কিংবা আমরা যখন আবিস্কার করি বিশ্বাস(বা বিশ্বাসের কাছাকাছি কিছু)-তখন আমরা কেন্দ্রকে ধরতে পারি, ও নির্দিষ্ট করে তাকে হৃদয়ে ধারণ করি। স্বীকার করি, যদিও এটি আমার স্পষ্টতার বিপরীতে যুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। 

‘তোমার মস্তিস্ককে কঠিন বিষয়ে চিন্তা করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। যা তোমাকে এমন অবস্থানে নিয়ে যাবে,তুমি যা বুঝতে পারছো, তাই যা প্রথমে বুঝতে পারো নি। আর এটিই তোমার জীবনের সফলতা(ক্রীম)। বাকি সব বিরক্তিকর ও অর্থহীন।‘ এই কথাগুলোই ধূসর চুলের বুড়ো লোকটি আমাকে বলেছিলো। শরতের শেষে এক রবিবার মেঘাচ্ছন্ন বিকালে, কোবে পাহাড় চূঁড়ায়, আমার হাতে ছিলো এক গুচ্ছ লাল ফুল। এমনকি এখনো, যদি আমার বিরক্তিকর কোন কিছু ঘটে, আমি আবার বিশেষ করে সেই বৃত্তটিকে চিন্তা করি, বিরক্তিকর এবং অর্থহীন। অনন্য সেই ‘ক্রীম‘ প্রোথিত আছে আমার গভীরে।

০০০০

প্রসঙ্গ: সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে জাপানের কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামি(১৯৪৯)‘র আটটি গল্পের সংকলন ‘ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার‘(মূল জাপানী ভাষায় গ্রন্থের শিরোনাম-ইছিবানসু তানসু)। মূল জাপানী ভাষা থেকে সব ক‘টি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যে মুরাকামির গল্পগ্রন্থটি বিস্তর আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের প্রথম সারির প্রায় সব সাহিত্য পত্রিকা গল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে। এখনো দি নিউ ইয়র্কার, গার্ডিয়ান, দি টাইমস থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্রিকায় আলোচনা অব্যহত রয়েছে। সঙ্গীত, স্মৃতি এবং স্ফীত জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর মানসিক দর্শন গল্পগুলোর অবকাঠামো তৈরী করেছে। এ গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘ক্রীম‘। আমি ইংরেজি থেকে গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করেছি। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি মূলের ভাব এবং চিন্তার রেখা ঠিক রাখতে। বাকি গল্পগুলোও অনুবাদ করার ইচ্ছে রাখি।

আরও পড়ুন »

আহা ফিলিস্তিন দিলু নাসের ♦ গাজার আকাশে দানবের ছায়ামাটিতে শকুন-দৃষ্টিধূ ধূ প্রান্তরে তাইপ্রতিদিন শিশুর রক্তবৃষ্টি!  সাঁজোয়াযানে সুপ্রাচীন ভূমি করছে ছিন্নভিন্ন নারী পুরুষের বুকের উপরদানবীয় পদচিহ্ন! ধ্বংসস্তূপে আগুনের ধোঁয়া পথে-প্রান্তরে লাশ লাশের উপরে দানব...

মায়াবী রাত

মায়াবী রাত

|| অঞ্জন নন্দী ||
এখন মাঝরাত। আকাশে বিশাল রূপোর থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ থেকে মোম জোছনা গলে গলে পড়ছে। নিশাচর পাখি আর নেট জগতের মানুষ ছাড়া সবাই ঘুমের দেশে। কুয়াশা ভেদ করে শহরের পথে আয়েশি ভঙ্গিতে একটা বাঘ হেঁটে হেঁটে চলছে। যেনতেন বাঘ নয়, একেবারে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তাগড়া শরীর, জ্বলজ্বলে চোখ, ভ্রুক্ষেপহীন। তার পিঠে সওয়ার হয়ে আছে এক লিকলিকে বালক। ঘোর কৃষ্ণবর্ণের শরীরে পাঁজরের হাড়গুলো গোনা যাবে। তার পরনে কোন জামা নেই। ঋজু ভঙ্গিতে নিশ্চুপ বসে আছে, হাতে একটা বেত, ঠিক আগে যেমন স্কুলে টিচারদের হাতে দেখা যেতো যার এক ঘা পিঠে পড়লে সাতদিন দাগ থাকতো। বেতের ভয়ে ছাত্ররা …

হুমায়ুন আজাদ–রাঢ়ি খালের মুগ্ধকিশোর

আলমগীর শাহরিয়ার রাঢ়িখাল-তিন ভাগ পানি আর এক ভাগ মাটির ছোটবড়ো অনেক পুকুর আর ডোবাভরা এক গ্রাম। এক সময় বাংলার গ্রামগুলি এমন ছিল। নদীর পাড়ে পাড়ে গঞ্জ। খালের পাড়ে পাড়ে গ্রাম। বিলম্বিত বর্ষায় গ্রামের চারপাশে ফোটে থাকতো শাপলা ফুল। জারুল স্বাগত জানাতো গ্রীষ্ম ও...

স্মরিব ‘কাল নিরবধি’

সেলিম জাহান আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব তাঁর  শিক্ষার্থী ছিলেন। আমার অনেক অগ্রজেরও শিক্ষক ছিলেন তিনি। তবু পাঁচ বছর আগেও প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। যু্ক্তি ছিল তাঁর একটাই - তাঁর কন্যার শিক্ষককে তিনি ‘তুমি’ বলতে পারেন না। আশির...

‘মধুমালা’ মিষ্টির দোকান

‘মধুমালা’ মিষ্টির দোকান

|| হামিদ মোহাম্মদ ||
‘মধুমালা’মিষ্টির দোকান যেদিন যাত্রা শুরু করলো, সেদিন মানুষের ভিড় দেখে বিজয়পাল চমকে যায়। এতোদিন এতো মানুষ কোথায় ছিল? এরা তো এই এলাকারই লোক! তাদের আলাইঘর বা মিষ্টির দোকান চল্লিশ বছরের পুরোনো, এভাবে তো মানুষ ভিড় করেনি, লাইন ধরেনি মিষ্টি কিনতে। বিজয়পালের মিষ্টির দোকানের নাম নেই, কোনো সাইনবোর্ডও নেই, কিন্তু লোকে ‘মহাজানের মিষ্টির দোকান’ নামেই চেনে। সারা সিলেট তথা পুরো তল্লাটে এই দোকান চেনে না, এমন মানুষ কম। রমজান মাস এলেই ইফতারের বিশেষ আইটেম জিলিপি কিংবা রসগোল্লার জন্য কাছের টাউন থেকেও লোকজন আসে। তাদের দোকানের বিখ্যাত মিষ্টির নামডাক কতকালের।

আরও পড়ুন »

 

আহা ফিলিস্তিন দিলু নাসের ♦ গাজার আকাশে দানবের ছায়ামাটিতে শকুন-দৃষ্টিধূ ধূ প্রান্তরে তাইপ্রতিদিন শিশুর রক্তবৃষ্টি!  সাঁজোয়াযানে সুপ্রাচীন ভূমি করছে ছিন্নভিন্ন নারী পুরুষের বুকের উপরদানবীয় পদচিহ্ন! ধ্বংসস্তূপে আগুনের ধোঁয়া পথে-প্রান্তরে লাশ লাশের উপরে দানব...

মায়াবী রাত

|| অঞ্জন নন্দী || এখন মাঝরাত। আকাশে বিশাল রূপোর থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ থেকে মোম জোছনা গলে গলে পড়ছে। নিশাচর পাখি আর নেট জগতের মানুষ ছাড়া সবাই ঘুমের দেশে। কুয়াশা ভেদ করে শহরের পথে আয়েশি ভঙ্গিতে একটা বাঘ হেঁটে হেঁটে চলছে। যেনতেন বাঘ নয়, একেবারে রয়েল বেঙ্গল...

হুমায়ুন আজাদ–রাঢ়ি খালের মুগ্ধকিশোর

আলমগীর শাহরিয়ার রাঢ়িখাল-তিন ভাগ পানি আর এক ভাগ মাটির ছোটবড়ো অনেক পুকুর আর ডোবাভরা এক গ্রাম। এক সময় বাংলার গ্রামগুলি এমন ছিল। নদীর পাড়ে পাড়ে গঞ্জ। খালের পাড়ে পাড়ে গ্রাম। বিলম্বিত বর্ষায় গ্রামের চারপাশে ফোটে থাকতো শাপলা ফুল। জারুল স্বাগত জানাতো গ্রীষ্ম ও...

স্মরিব ‘কাল নিরবধি’

সেলিম জাহান আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব তাঁর  শিক্ষার্থী ছিলেন। আমার অনেক অগ্রজেরও শিক্ষক ছিলেন তিনি। তবু পাঁচ বছর আগেও প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। যু্ক্তি ছিল তাঁর একটাই - তাঁর কন্যার শিক্ষককে তিনি ‘তুমি’ বলতে পারেন না। আশির...

‘মধুমালা’ মিষ্টির দোকান

|| হামিদ মোহাম্মদ || ‘মধুমালা’মিষ্টির দোকান যেদিন যাত্রা শুরু করলো, সেদিন মানুষের ভিড় দেখে বিজয়পাল চমকে যায়। এতোদিন এতো মানুষ কোথায় ছিল? এরা তো এই এলাকারই লোক! তাদের আলাইঘর বা মিষ্টির দোকান চল্লিশ বছরের পুরোনো, এভাবে তো মানুষ ভিড় করেনি, লাইন ধরেনি মিষ্টি কিনতে।...

চারাভাঙ্গার কান্না…

সৈয়দ মনসুর উদ্দিন  হাইলাইট চারাভাঙ্গা ও তার আশপাশের পুরো এলাকা আস্তে আস্তে দানব হয়ে জেগে উঠছে। শত শত একরের ধান ক্ষেতে অপরিকল্পিত কারখানার আলো জ্যোৎস্নাকে হত্যা করছে তিলে তিলে, বেলঘরের চূড়ায় এখন আর গোধূলি নামে না, বিদায় নিয়েছে জোনাকী পোকারা, সাইরেন আর গাড়ীর...