গবেষণা এবং শিক্ষাদানের উৎকর্ষতা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপাদান
।। নিলুফা ইয়াসমীন হাসান।।
লণ্ডন, ০৫ জুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের উদোগে আয়োজিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উৎকর্ষতা এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক রিসার্চ সেমিনারে বক্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বিভিন্ন একাডেমিক পদে নিয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তনের আহবান জানিয়েছেন।
গত ২৮ মে রোববার পূর্ব লণ্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান বক্তা ছিলেন লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মোহাম্মাদ মুশফিক উদ্দিন। ভার্চুয়ালি আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর এ কে এম মাকসুদ কামাল, ইউনিভার্সিটি অফ লিঙ্কনের এসোসিয়েট প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান এবং বার্মিংহামের নিউম্যান ইউনিভার্সিটির হেড অফ বিজনেস ড. তৈমুর শরীফ। সেমিনারে সভাপতিত্ব এবং পরিচালনা করেন সংগঠনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গৌস সুলতান। সেমিনারের সূচনালগ্নে সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেইন এবং এডুকেশন এণ্ড রিসার্চ সেক্রেটারি ও রিসার্চ টীমের আহ্বায়ক এরিনা সিদ্দিকী সুপ্রভা স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
প্রধান বক্তা প্রফেসর মোহাম্মাদ মুশফিক উদ্দিন লিখিত বক্তব্যে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, যার রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল ইতিহাস। তিনি তাঁর সূচনা বক্তব্যে বলেন, ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিভিন্নভাবে জাতির প্রতি অবদান রেখে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা ৫০ দশকের শুরুতে ভাষা আন্দোলনে এবং ১৯৬০ দশকের শেষ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে অপরিমেয় ভূমিকা পালন করেছেন। প্রফেসর মুহাম্মাদ মুশফিক উদ্দিন বর্তমানে লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ার এবং ডিপার্টমেন্টাল ডাইরেক্টর ফর ইন্টারন্যাশনালাইজেশনের দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রফেসর সত্যেন্দ্র নাথ বসু, আর্কিটেক্ট ফজলুর রহমান খান, নোবেল জিয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখের নাম তার বক্তৃতায় গুরুত্ব সহকারে উলেখ করেন। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে অগণিত রাজনীতিবিদ, আইন প্রণেতা, সিভিল সার্ভেন্টস এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যারা জাতির বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নে অবদান রেখে চলেছেন।
প্রফেসর মোহাম্মদ মুশফিক উদ্দিন আরো বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক বিখ্যাত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন এবং গেøাবাল পর্যায়ে অবদান রাখছেন। প্রফেসর মুশফিক উদ্দিন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে রয়েছে ১৩টি ফ্যাকালটি এবং ৮৪টি বিভাগ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো রয়েছে ১২টি ইনস্টিটিউশন এবং ৫০ টি রিসার্চ সেন্টার এবং ব্যুরো। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৬ হাজার ছাত্রছাত্রী এবং ২ হাজার ২ শত একাডেমিক স্টাফ রয়েছে। প্রতি ২০ জন ছাত্রের জন্য একজন একাডেমিক স্টাফ রয়েছে। এই অনুপাত যুক্তি সঙ্গত এবং গেøাবাল মানসম্মত বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সুবিধা এবং ছাত্রছাত্রীদের বাসস্থানের সুবিধা থাকলেও ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় এগুলো যথেষ্ট নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
একাডেমিক উৎকর্ষতা প্রসঙ্গে প্রফেসর মুশফিক বলেন, এর উৎকর্ষতা প্রধানত নির্ভর করে গবেষণা ও শিক্ষাদানের ওপর, যা কিনা আগত চ্যালেঞ্জ সমূহকে মোকাবিলা করবে এবং ঐসব চ্যালেঞ্জ সমূহকে দক্ষভাবে মোকাবিলা করার জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভালোভাবে প্রস্তুত করে তুলবে। তাই, আমরা কি ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঐগুলো মোকাবিলা করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ সমূহের মধ্যে প্রফেসর মুশফিক উদ্দিন পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সমূহের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দেশের প্রধান একাডেমিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দায়িত্ব হচ্ছে, উচ্চমানের গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাদান নিশ্চিত করে, বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে মোকাবিলা করা।
তিনি আরো বলেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ফাণ্ডিং সংস্থাগুলো থেকে গবেষণার তহবিল সংগ্রহের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সংক্রান্ত অনুষদগুলোকে অবশ্যই আরো তৎপর হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য প্রফেসর এ কে এম মাকসুদ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের এই সেমিনারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, অ্যালামনাইদের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপকৃত হবে। তিনি সকল অ্যালামনাইর ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার আহবান জানান। নিউম্যান ইউনিভার্সিটির হেড অফ বিজনেস ড. তৈমুর শরীফ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের জন্য দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরী করা। বাজেট নিয়ে সব সময়ই আমাদের অভিযোগ থাকে। সব সময়ই বলা হয়ে থাকে যে বাজেট যথেষ্ট নয়। তিনি আরো বলেন, কিছু সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে একজন প্রভাষকের প্রমোশন পেতে হলে একটি সুনিদিষ্ট পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে প্রমোশন পাওয়ার কথা। আমার মনে হয়, আমাদের দেশে ঐ পদ্ধতিটাই নাই। যেমন এখানে রয়েছে রিসার্চ এক্সসিলেন্ট ফ্রেমমওয়ার্ক।
প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি ৫/৬ বছর পর পর তাদের রিসার্চ সংক্রন্ত অবদান পেশ করে। এর ভিত্তিতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রেটিং নির্ধারিত হয়। দূর্ভাগ্যবশতঃ বাংলাদেশে এধরনের কিছু নেই। ইউনিভার্সিটি অফ লিঙ্কনের এসোসিয়েট প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান রিসার্চের ওপর গুরুত্বারোপ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা বৃদ্ধির আহবান জানান। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ এবং প্লেইসমেন্ট না থাকায় যারা ডিগ্রি নিয়ে ইউকেতে আসেন, তারা অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে থাকেন। সংগঠনের সভাপতি দেওয়ান গৌস সুলতানের সভাপতিত্বে এবং পরিচালনায় সেমিনারের শেষ পর্বে অনুষ্ঠিত হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। প্রশ্নোত্তর পর্বে সংগঠনের সদস্য এবং আমন্ত্রিত অতিথি অর্থাৎ কমিউনিটির বিশিষ্টজনেরা অংশ নেন।
সেমিনারে উপস্থিত তিন বক্তার হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের ক্রেস্ট তুলে দেন সভাপতি দেওয়ান গৌস সুলতান, সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আব্দুর রাকীব, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মারুফ আহমেদ চৌধুরী এবং এডুকেশন এণ্ড রিসার্চ সেক্রেটারি এরিনা সিদ্দিকা সুপ্রভা। রিসার্চ টীমে কনভেনার ছাড়া সদস্যদের মধ্যে ছিলেন প্রশন্ত পুরকায়স্থ, নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, সৈয়দ হামিদুল হক, সৈয়দ ইকবাল, মাহারুন আহমেদ, মিজানুর রহমান, এম কামরুল হাসান এবং পদাধিকার বলে সভাপতি দেওয়ান গৌস সুলতান এবং সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন। সেমিনারকে সাফল্যমণ্ডিত করতে সহযোগিতায় যারা ছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এরিনা সিদ্দিকী। এই আয়োজনে সহযোগিতায় ছিলেন মোহাম্মদ আবুল কালাম, সৈয়দ ইকবাল, মোহাম্মদ সামসুল আরেফিন, মোহাম্মদ কামরুল হাসান, মারুফ আহমেদ চৌধুরী, মেসবাহ উদ্দিন ইকো, সৈয়দ জাফর, ড. কামরুল হাসান, আবদুল মতিন চৌধুরী, সাহাব আহমেদ বাচ্চু এবং মির্জা আসহাব বেগ। সেমিনার শেষে নৈশভোজ অনুষ্ঠিত হয়।