লন্ডনে এমন ব্যাপক পরিসরে বইমেলার উদ্বোধন করতে পেরে সত্যিই আমি আনন্দিত–বন্যা
লন্ডন, ১৬ সেপ্টেম্বর: সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ ইউকের উদ্যোগে আয়োজিত বইমেলা ও সাংস্কৃতিক উতসবের উদ্বোধন করে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, লন্ডনে এমন ব্যাপক পরিসরে বইমেলার উদ্বোধন করতে পেরে সত্যিই আমি আনন্দিত। বাংলাদেশের বাইরে এত সুন্দর আয়োজন আমাকে মুগ্ধ করেছে। বইমেলায় অংশ নিতে পেরে আমি ঋদ্ধ হয়েছি।
বইমেলা ও সাংস্কৃতিক উতসবে প্রধান অতিথি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বিজ্ঞানী বীর মুক্তিযোদ্ধা একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক ড. নুরুন্নবী। এছাড়া বিশেষ অতিথি ছিলেন ড. জিনাত নবী ও বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার হযরত আলী খান। ড. নুরুন্নবী বলেন, লন্ডনে এমন একটি বইমেলায় আমি উপস্থিত থাকতে পেরে গর্বিত। উদ্বোধনী পর্বে প্যাভেলিয়ানের গেইটে এ সময় উপস্থিত ছিলেন তাদের সাথে শতাধিক লেখক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, সুধীজনসহ পাঠক ও শিশুকিশোর।
পাঠক ক্রেতা, লেখক প্রকাশক ও দর্শনার্থীদের সমাগমে একাদশতম বাংলাদেশ বইমেলা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব গত ১০ সেপ্টেম্বর রোববার পূর্ব লন্ডনের মাই ল্যাণ্ড পার্কের দ্যা আর্ট প্যাভিলিয়নে দুইদিনব্যাপী এ উতসব অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর আড়াইটায় মেলার উদ্বোধন করা হয়। বেলুন ও ফিটা কেটে মেলার উদ্ধোধন করেন অতিথিবৃন্দ।
উদীচী ও সত্যেন সেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উদ্বোধনীর আলোচনা পর্ব। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কবি একেএম আব্দুল্লাহর সঞ্চালনায় এ পর্বে সভাপতি কবি ময়নূর রহমান বাবুল আমন্ত্রিত অতিথিদের স্বাগত জানান। উদ্বোধনী প্রথম পর্বের মূল অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন বাচিকশিল্পী মুনিরা পারভীন। তার প্রাঞ্জল উপস্থাপনা ছিল মনোমুগ্ধকর।
উদ্বোধনের পর রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ড. নুরুন্নবী ও ড. জিনাত নবীসহ অতিথিবৃন্দ বইয়ের স্টলগুলো ঘুরে দেখেন। মেলায় প্রথম দিনেই পাঠক ও লেখকদের ভীড় ছিল চোখে পড়ার মত।
এবারের বইমেলায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের স্বনামধন্য ১৭ টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে মেলায় অংশ নিয়েছেন। প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকার বাংলা একাডেমী, সময় প্রকাশনী, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, অনার্য, ইউপি এল, সাহিত্য প্রকাশ, অনন্যা প্রকাশনী, কবি প্রকাশনী, স্বরবৃত্ত প্রকাশন, চারুলিপি প্রকাশন, শব্দশৈলী, পরিবার প্রকাশন, সিলেটের অভ্র প্রকাশনী, বাসিয়া প্রকাশনী এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রকাশনীসমূহ। এছাড়া ছিল হাইকমিশনের তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বইয়ের বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়ন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বইয়ের সমাবেশ ছিল বঙ্গবন্ধু প্যাভেলিয়ান।
উল্লেখ্য, শুধু মাত্র চলতি বছরের লন্ডন বইমেলা উপলক্ষে ২১ টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গনে, প্রকাশিত বইগুলোর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। আরো মোড়ক উন্মোচন করা হয় সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত সংকলন ‘ তৃতীয় বাংলা’দ্বিতীয় সংখ্যা, কবিতা সংকলন ‘পোয়েটিক’ এবং মেলার তথ্য সমৃদ্ধ একটি স্মারক সংকলন।
মেলা মঞ্চে ছিল শিশুদের নানারকম সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, সাহিত্যালোচনা, সাহিত্য পুরস্কার প্রদান, নৃত্য, কবিতা আবৃত্তি, সাহিত্য বিষয়ক সেমিনার, নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, অ্যাপাসেন লার্নার্স কালচারাল গ্রæপের পরিবেশনা, স্বরচিত কবিতাপাঠ, প্রকাশকদের সাথে মতবিনিময় ও ক্রেস্ট প্রদানসহ নানা আয়োজন।
অ্যাপাসেন লার্নার্স কালচারাল গ্রুপের পরিবেশনার নেতৃত্ব দেন সঙ্গীতশিল্পী গৌরী চৌধুরী। ব্যতিক্রমী এ পরিবেশনায় শ্রোতা ও সুধীজন মুগ্ধ হন। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত, দেশাত্বকবোধক ও লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পীদের মধ্যে জুবের আখতার সুহেল, সোমা দাস, শরমিলা দাসসহ বিশিষ্ট শিল্পীরা। এই পর্বটি পরিচালনা করেন সংস্কৃতিকর্মী হেনা বেগম ও নূরুল ইসলাম। সঙ্গীতপর্বে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যশিল্পী দ্বীপ ও গঙ্গা।
বইমেলায় আয়োজিত প্রথম দিনের সেমিনারে ‘বহির্বিশ্বে বাংলাসাহিত্য চর্চার সাম্প্রতিক প্রবণতা’ বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন কবি মিল্টন রহমান। কবি ইকবাল হোসেন বুলবুলের সভাপতিত্বে এবং কবি ও অনুবাদক ফারাহ্ নাজের সঞ্চালনায় প্রবন্ধ বিষয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক সালেহা চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক সাগুফতা শারমীন তানিয়া এবং সাংবাদিক ও নাট্যকার বুলবুল হাসান। সংস্কৃতিকর্মী মোস্তাফা জামান নিপুনের উপস্থাপনায় আবৃত্তিপর্বে অংশ নেন বাচিকশিল্পীদের মধ্যে উর্মি মাজহার, মুনিরা পারভীন, শহিদুল ইসলাম সাগর, শতরূপা চৌধুরী, নজরুল ইসলাম অকিব, সৈয়দ হিলাল সাইফ, লুতফুর নাহার বেবি, আরফুমান ছৌধুরী, ফয়জুল ইসলাম ফয়জুন নূর, মুরশিদ উদ্দিন আহমদ, স্মৃতি আজাদ, বর্নালি চক্রবর্তী, ও ইয়াসমীন মাহমুদ পলিন।
স্বরচিত কবিতা পাঠে অংশ নেন কবিদের মধ্যে সাফিয়া জাহির, শামীম আহমদ, কাজল রশিদ, শিব্বির আহমদ, নাজমা সুলতানা নার্গিস, আহমদ হোসেন হেলাল, নুরুল হক, সুফিয়া নুরুজ, মোহাম্মদ ইকবাল, নোমান আল মনসুর, সৈয়দ মাসুম, সৈয়দ ইকবাল,তালুকদার রায়হান, নজরুল ইসলাম আসলামী, মুজিবুল হক মনি, শাহাদত করিম, আফিয়া বেগম শিরি, সাইফুল্লাহ খালেদ, মুহাম্মদ মুহিদ, লুতফুর নাহার, উদয় শংকর দূর্জয়, মরিয়ম চৌধুরী, খসরুজ্জামান খসরু, সাইফ উদ্দিন আহমদ বাবর, আজিজুল আম্বিয়া, সৈয়দ হিলাল সাইফ, শাহ সোহেল, আবদুল কাউয়ম, জামিল সুলতান, আসমা মতিন, ফাহমিদা ইয়াসমীন, জুয়েল রাজ, মোমিন আলী, শেখ সমছুল ইসলাম প্রমুখ। দুই পর্বে স্বরিচত কবিতা পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। কবিতা পাঠ প্রথমপর্বে সভাপতিত্ব করেন কবি আবু মকসুদ পরিচালনা করেন কবি এম মোশাইদ খান এবং দ্বিতীয় পর্বে সভাপতিত্ব করেন কবি আতাউর রহমান মিলাদ, পরিচালনা করেন সংস্কৃতিকর্মী হেনা বেগম।
দ্বিতীয় দিনে “মুক্তিযুদ্ধে বিলাতবাসী নারীসমাজের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন লেখক ফারুক আহমদ। আলোচক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রবাসী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ড. জিনাত নবী, সাংবাদিক নিলুফা ইয়াসমিন হাসান, ব্রিটিশ বাংলাদেশি লেখক সেজুতি মনসুর। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন লেখক-সাংবাদিক সুজাত মনসুর। এছাড়া সবশেষে ছিল বিলাতবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি স্মৃতিচারণমূলক আলোচনাপর্ব।
বিভিন্নপর্বে আলোচনায় অংশ নেন বীর মুক্তিযোাদ্ধা সুলতান মাহমুদ শরীফ, বাংলাটিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সামাদুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক ফরিদুর রহমান, নাট্য নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ হাসান এমবিই প্রমুখ।
শেষদিনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরুন্নবীর সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আলাপচারিতা অনুষ্ঠিত হয় বিলাতবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। আলাপচারিতায় অংশ নেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লোকমান হোসেন, দেওয়ান গৌছ সুলতান, আবু মুসা হাসান, আমান উদ্দিন, আবুল কাশেম খান, সৈয়দ গোলাম আলী। সঞ্চালনায় ছিলেন কবি মিল্টন রহমান। আলোচনায় মহান মুক্তিযুদ্ধের অনালোচিত নানা বীরত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা ও তথ্য উঠে আসে।
এছাড়া উপস্থিত প্রকাশকদের নিয়ে একটি আলোচনাপর্ব ছিল তথ্য সমৃদ্ধ। আলোচকবৃন্দ বিলাতে নিয়মিত এরকম বাংলা বইমেলার আয়োজন বাঙালি জাতির বিকাশ ও আর্ন্তজাতিক পরিসরে পরিচয় সুদৃঢ় করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন। আলোচনা শেষে প্রকাশকদের মধ্যে সময় প্রকাশনীর ফরিদ আহমদ, অনন্যা প্রকাশনীর মনিরুল হক, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের আদিত্য অন্তর, অনার্য প্রকাশনার সফিক রহমান, স্বরবৃত্ত প্রকাশনার রাহামাত উল্লাহ, শব্দশৈলীর ইফতেখার আমিন, পরিবার প্রকাশনীর সোহানুর রহিম শাওন, কবি প্রকামণীর সজল আহমদ সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। ক্রেস্ট হাতে তুলে দেন সম্মিলিত সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরষেদের পক্ষে লেখক আবুল কালাম আজাদ ছোটন।
বিভিন্ন পর্বে আরো অংশ নেন সংস্কৃতিকর্মী কবি শাহ শামীম আহমদ, সংস্কৃতিকর্মী নুরুল ইসলাম, কবি কাজল রশিদ, লেখক আবুল কালাম আজাদ ছোটন, লেখক ফারুক আহমেদ, কবি ইকবাল হোসেন বুলবুল, সংস্তৃতিকর্মী স্মৃতি আজাদ, কবি আতাউর রহমান মিলাদ, কবি আবু মকসুদ, কবি মোস্তফা জামান চৌধুরী, হেনা বেগম, কবি মো. মোসাইদ খান, লেখক আনোয়ার শাহজাহান, কবি মুহাম্মদ মুহিদ, কবি মোহাম্মদ ইকবাল, কবি শামীম আহমদ, কবি জুয়েল রাজ, কবি ফারাহ নাজ, সাংবাদিক রহমত আলী, ছড়াকার সৈয়দ হিলাল সাইফ, কথাসাহিত্যিক সাগর রহমান, কবি সাঈম উদ্দিন খন্দকার প্রমুখ।
অন্যদিকে, দুইদিনব্যাপী চলা বইমেলায় পাঠক ক্রেতাদের ভীড় ছিল অভাবনীয়। শেষ দিনে পছন্দের বই কেনার জন্য ক্রেতাদের ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। এতে স্টলগুলোতে আশানুরূপ বই বিক্রির কথা জানিয়েছেন বিক্রেতারা। তবে অভ্র প্রকাশনীর স্টলের সকল বই বিক্রি হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন স্টলের দায়িত্বে থাকা বাচিকশিল্পী মুনিরা পারভীন।
এবারের মেলায় প্রতিবারের মত যুক্তরাজ্যপ্রবাসী কবি হামিদ মোহাম্মদকে সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য সম্মাননা প্রদান করা হয়। হামিদ মোহাম্মদ কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও মননশীল সাহিত্যে ও সাংবাদিকতায় সক্রিয় একজন বিদগ্ধ লেখক। সম্মাননা গ্রহণের পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আমার এ সম্মাননা প্রাপ্ত পাঠকের অবদান, আমি পাঠকের কাছে কৃতজ্ঞ। বেশি বেশি বই পাঠ করার প্রতি তিনি নতুন লেখকদের প্রতি অনুরোধ জানান। মেলার উদ্বোধনীপর্বে কবির হাতে অতিথি রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যা, ড. নুরুন্নবী ও ডেপুটি হাইকমিশনার হজরত আলী খান সুশোভিত একটি ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট ও নগদ অর্থ তুলে দেন।