সারওয়ার-ই আলম
কিছু মানুষ সবসময় ঠোঁটের কোণে এক টুকরো আনন্দ ঝুলিয়ে রাখতে পারে। যেন তাঁদের কোনো দুঃখ নেই, কোনো কষ্ট নেই, কোনো শোক নেই, কোনো হাহাকার নেই। এঁদের সঙ্গে কথা বলার আনন্দই আলাদা। মুহূর্তের আলাপচারিতায় মন ভাল হয়ে যায়। কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন সেরকম একজন মানুষ। মানুষকে সহজে আপন করে নেয়ার এক বিরল গুণ ছিল তাঁর। আলাপনে মনে হতো অনেক আপন, অনেক দিনের চেনা। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকটা। তখন ঢাকা কলেজের বিপরীতে তাঁর বাসা ছিল। কখনো কবিতা আনতে, কখনো সাক্ষাৎকার নিতে বহুবার সে বাসায় গিয়েছি। প্রতিবারই সেই প্রিয় হাসি, সেই প্রিয় সান্নিধ্য। আপাদমস্তক একজন নিরহংকার মানুষের প্রতিকৃতি।
কখনো যদি জানতেন দুপুরে খেয়ে গিয়েছি, বলতেন – আমার বাসায় আসছো জেনেও খেয়ে আসলে কেন? আহা কী স্নেহ, কী ভালবাসা! বাংলা একাডেমিতে কোনো কাজে গেলে একবার আসাদ ভাইয়ের রুমে ঢুঁ না মেরে ফিরতাম না। না, কোনো কাজের জন্য নয়। একান্তই প্রাণের টানে। হয়তো গিয়েছি পাশের ভবনে। কাজ শেষ করে আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা না করে ফিরিনি। আসাদ ভাইয়ের প্রতি আমার আকর্ষণটা তৈরী হয় মাইজদী থেকে। আমাদের শহরে একবার সাহিত্য সম্মেলনে গিয়েছিলেন তিনি। সে অনুষ্ঠানে আমার কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সামনে। আমি লক্ষ্য করলাম গভীর মনোযোগ দিয়ে কবি শুনছেন আমার কবিতা পাঠ।
পরে, তাঁর বক্তৃতা পর্বে আমার কবিতাটির প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, সারওয়ারের কবিতাটি আমার মনোযোগ কেড়েছে। ওর ভাষা সুন্দর। সাবলীল ও প্রাণবন্ত। কবিতাটি যেন সাবান দিয়ে ধোয়া- ঝকঝকে। সেদিন আমার মাথার মধ্যে আসাদ ভাইয়ের ওই ‘ঝকঝকে’ কথাটি গেঁথে গিয়েছিল। একজন তরুণ, কবিতা চর্চায় যার সবেমাত্র হাতেখড়ি, তার কবিতা সম্পর্কে দেশবরেণ্য কবির ওই প্রশংসা কী যে অপরিমেয় আনন্দের ছিল তা বলে বোঝাতে পারব না। সেদিন আনন্দে আমার বুকটা ভরে গিয়েছিল। তাঁর ওই প্রশংসা আমার আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। আজো, এখনো মাঝে মাঝে আমি যেন তাঁর সেই কথাগুলো শুনি, মাইজদীর স্মৃতি মানসপটে ভেসে আসলে তাঁর সে কথাগুলো আমার কানে বাজতে থাকে।
কী আশ্চর্য! আমি বলছি প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা। তবে কী মানুষ সবচেয়ে বেশী উচ্ছ্বসিত হয় তার প্রশংসায়! পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর রাজধানীতে সাংবাদিকতা করার সুবর্ণ সুযোগ মেলে যায়। পেশাগত কারণে যোগাযোগ করার সুযোগ তৈরী হয় দেশ বরেণ্য ব্যক্তি বর্গের সঙ্গে। কাছে আসার সুযোগ পাই আসাদ ভাইয়েরও। একদিন কথায় কথায় মাইজদীর কথা মনে করিয়ে দেই। বলেন, খুব মনে আছে সারওয়ার। আমি বলেছিলাম তোমার কবিতা সাবান দিয়ে ধোয়া কবিতার মত ঝকঝকে সুন্দর। কথাগুলো ভাবতে আজো আত্মশ্লাঘা অনুভব করি। আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে একবার দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমনের সুযোগ হয়েছিল। সেবার আমরা যাচ্ছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে। আসাদ ভাই যাচ্ছেন প্রধান অতিথি হয়ে। তাঁর সঙ্গে বিশেষ অতিথি জনকণ্ঠের সে সময়কার সাহিত্য সম্পাদক কবি নাসির আহমেদ। সঙ্গে আমরা সাঙ্গপাঙ্গ কয়েকজন- কবি মতিন রায়হান, কবি প্রত্যয় জসীম, কবি আলেয়া শারমিন প্রমূখ। পুরো ট্রেন ভ্রমনটা যে কী অসাধারণ উপভোগ্য ছিল সে কথা কী আর বলব। পুরোটা সময় আসাদ ভাই, নাসির ভাই আমাদেরকে তন্ময় করে রেখেছিলেন- কথায়, হাস্যরসে, জীবনের বিপুল, বিচিত্র, প্রাণোচ্ছল অলকানন্দা আলাপনে। ব্যবহারে এতটা নম্র, আচরণে এতটা বিনয়ী, বয়সের ব্যবধান টপকিয়ে অনুজদের সঙ্গে এতটা বন্ধুবৎসল মানুষ জীবনে খুব কম দেখা মেলে। আসাদ ভাই তরুণদের জন্য এক সমুদ্র ভালবাসা ধারণ করতেন। কবিতার পাশাপাশি তাঁর অন্তরের সৌন্দর্যে বিমোহিত ছিলাম আমরা তরুণেরা। কবিতার মতো তাঁর ব্যবহারেও এক ধরণের সম্মোহনী শক্তি ছিল। অন্তরে সজীব স্নিগ্ধতার উদ্যান না থাকলে এমন সম্মোহনী শক্তি অর্জন করা যায়না। ব্যক্তিত্বের মতো আসাদ ভাইয়ের কবিতাও মন কাড়ানিয়া। অন্তহীন সুন্দর। সহজে বোধগম্য। অপ্রয়োজনে শব্দের স্তূপ তৈরী করেননি তিনি। শব্দগুলো, উপমাগুলো, চিত্রকল্পগুলো আমাদের চেনাজানা। একাবেরা পড়শীর মতো। পড়তে অভিধানের প্রয়োজন পড়ে না। তরতর করে একেকটি কবিতা পাঠকে নিয়ে যায় অনুভূতির একেবারে শীর্ষে।
সহজ কথামালায় তিনি ধারণ করেছেন বঙ্গভূমির আনন্দ বেদনার কাব্য, সাবলীল ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন বাঙালী সংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য, ফুটিয়ে তুলেছেন প্রেম, বিরহ ও দ্রোহের অনুপম আখ্যান। তখন সত্যি মানুষ ছিলাম কবিতাটি যখন পাঠ করি, তখন কবিতার কিছু কথা বুকের ভেতর তীব্রভাবে নাড়া দিয়ে যায়। যখন পড়ি- নদীর জলে আগুন ছিল আগুন ছিল বৃষ্টিতে আগুন ছিল বীরাঙ্গনার উদাস করা দৃষ্টিতে আহা কী কথা। এ যেন সমগ্র বাংলাদেশের অনুভূতি। অনুভূতি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। এ কবিতাটির শেষ কয়েকটি পংক্তি ক’টা গণমানুষের মুখে মুখে ফেরে। কথাগুলো এরকম- এখন এ সব স্বপ্নরা দূরের শোনা গল্প তখন সত্যি মানুষ ছিলাম এখন আছি অল্প আহা কী পর্যবেক্ষণ। সময়ের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে কী নিবিড় বীক্ষণ, ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম, এখন আছি অল্প’।
তাঁর বারবারা ডিলারকে কবিতাটিও বিপুল জনপ্রিয় কবিতাগুলোর মধ্যে একটি। সাহিত্যের সভা-সমাবেশে আবৃত্তিকাররা এ কবিতাটি আবৃত্তির জন্য বেছে নেন। কারণ কবিতাটি ধমনীতে ঢেউ তোলে, যেখানে তিনি বারবারা ডিলারকে জিজ্ঞেস করছেন, তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়, বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো, ওটা একটা জল্লাদের ছবি, পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে, মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে অদ্ভূত জাদুকরকে দেখ বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায় দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙ্গে গ্রন্থাগার, উপসনালয়, ছাত্রাবাস, মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ী সাত কোটি মানুষের আকাঙিক্ষত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয় থেতলে দেয়। আহা কী কথা। স্বদেশের কষ্টকে কী আপন করে ধারণ করা। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের অভিজ্ঞতাই হয়তো তাঁর হৃদয়ে প্রোথিত করেছে দেশ প্রেমের সুদৃঢ় শপথ। আর সে শপথ ধ্বনিত হয় তাঁর কবিতায় যখন তিনি লেখেন, তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা বাংলাদেশ। আজকের বাংলাদেশে, স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পর, এই বিপ্রতীপ সময়ের বাঁকে দাঁড়িয়ে এই অনিবার্য প্রশ্নটি কি আমার, আপনার- আমাদের সবার নয়। এভাবেই নিপুন শব্দ শৈলীতে গণমানুষের আবেগ-অনুভূতিকে কবিতার অনুপম ভাষায় ধারণ করেছেন আসাদ চৌধুরী। ধারণ করেছেন বাংলাদেশের ধমনীতে প্রবাহিত টগবগে রক্তের ঢেউ। সুজলা সুফলা বাংলাদেশের গণমানুষের প্রেম, আনন্দ, বিরহ ও উচ্ছ্বাস। তিনি ধারণ করেছেন- “প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম আমাদের নারীদের কথা। তিনি ধারণ করেছে সরলপ্রাণ সত্য ফেরারীর অগণিত জিজ্ঞাসা। শান্তিতে ঘুমান আসাদ ভাই! বাঙালির হৃদয়পটে আপনি চিরজীবী হয়ে থাকবেন ‘প্রতিবাদের প্রবল ঝড়’, কিংবা কাব্যপ্রেমী মানুষের ‘স্বপ্ন ঢলের বন্যায়’!
ইলফোর্ড, এসেক্স, ৫ই অক্টোবর ২০২৩ লেখক: কবি, সাংবাদিক
——————————————-