লেবার পার্টিকে বয়কটের ডাক : সরব নন বাঙালি তিন কন্যা
পত্রিকা প্রতিবেদন ♦
লণ্ডন, ০৫ নভেম্বর: লেবার পার্টি সরকারে নেই। কিন্তু তবুও দলটির নেতা কিয়ার স্টারমার ইসরাইলের পক্ষে জোর দুতিয়ালিতে নেমেছেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো বর্বর ইসরাইলি হামলা ও গণহত্যাকে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এমন কথাও বলেছেন যে, গাজায় পানি, বিদ্যুত, তেল ও খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছে- সেটি ইসরাইলের অধিকার।
মানবিকতাহীন, বিবেকবহির্ভূত এমন মন্তব্যের কারণে লেবার পার্টিতে শুরু হয়েছে তুমুল মতবিরোধ। বিশেষ করে দলের মুসলিম ধর্মাবলম্বী সদস্য ও কাউন্সিলাররা দলনেতার সমালোচনায় মাঠে নেমেছেন। দেশব্যাপী তিন শতাধিক কাউন্সিলার লেবার নেতার বক্তব্য প্রত্যাহার চেয়ে গাজায় হামলা বন্ধের দাবি জানাতে চিঠি দিয়েছেন। এ পর্যন্ত ৩৪ জন কাউন্সিলার দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। দলের তৃণমূল সমর্থকদের কাছ থেকেই দাবি উঠেছে লেবার দলকে বয়কটের। অক্সফোর্ড কাউন্সিলের ৮ জন কাউন্সিলার লেবার দল ত্যাগ করার কারণে সেখানে কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে দলটি। সর্বশেষ গত রোববার বার্নলি কাউন্সিলের লীডারসহ ১১ জন কাউন্সিলার লেবার ছেড়েছেন। দল থেকে পদত্যাগ করেছেন পেণ্ডল বারা কাউন্সিলের লীডারও।
তৃণমূল লেবার সদস্যদের তুমুল চাপ সত্ত্বেও লেবার নেতা কিয়ার স্টারমার এখনও ইসরাইলের তথাকথিত আত্মরক্ষার পক্ষে সাফাই গাইছেন যা পক্ষান্তরে গাজায় ইসরাইলি গণহত্যাকে সমর্থন করার সামিল। গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পাল্টা পদক্ষেপে ইসরাইল গাজাবাসীর ওপর যে বর্বর বোমা হামলা ও গণহত্যা চালাচ্ছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও এমন বর্বরতা দেখেনি বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সসহ এর মিত্র দেশগুলো সরাসরি সমর্থন ও সহযোগিতায় ফিলিস্তিনিদের ওপর এমন বর্বরতা ও গণহত্যা চালাচ্ছে ইহুদি জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল। ইসরাইলের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না স্কুল, হসপিটাল, শরণার্থী শিবির ও জাতিসংঘের কর্মীরাও। গত এক মাসে ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইল। এর মধ্যে শিশু হত্যা করা হয়েছে ৪ হাজারের বেশি। নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে মারা হচ্ছে মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রকাশ্য মদদে। ইসরায়েলকে সমর্থনকারী সংশ্লিষ্ট দেশগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লাখ লাখ মানুষ ইসরাইলি বর্বরতা বন্ধে মিছিলে সামিল হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী এই গণহত্যা নিয়ে তোলপাড় চললেও ব্রিটেনের লেবার দলের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিন এমপি- রুশনারা আলী, রূপা হক এবং টিউলিপ সিদ্দিকও ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বরতার বিষয়ে সরব নন। বেথনাল গ্রীন অ্যাণ্ড বো আসনের এমপি রুশনারা আলী শুরুতে ইসরাইলের প্রতিরক্ষার পক্ষে সরাসরি দুতিয়ালি করে বক্তব্য দিয়েছেন। এর প্রতিবাদে তার নির্বাচনী এলাকার পার্টি অফিসের সমানে বড় ধরণের বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। রূপা হক এবং টিউলিপ সিদ্দিকের ঘটনা মূলত ইসরাইলের পক্ষেই ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এই বাঙালি তিন কন্যার বিপরীতে পপলার অ্যাণ্ড লাইম হাউজের লেবার দলীয় এমপি আপসানা বেগম ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বরতা বন্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
কিয়ার স্টারমার লেবার দলের দায়িত্ব নেয়ার শুরু থেকে নিজেকে একজন কট্টর ইসরাইলপন্থী হিসেবে তুলে ধরেন। কথিত ইহুদি বিদ্বেষের অভিযোগে তিনি দলের সাবেক নেতা জেরিমি করবিনকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। এমনও জানা গেছে যে, কিয়ার স্টারমার ইহুদি লবি থেকে গত এক বছরে ৫০ হাজার পাউণ্ডের অনুদান পেয়েছেন। ফলে ক্ষমতায় গেলে কিয়ার স্টারমার যে ইসরাইলের পক্ষে আরও জোরালো ভূমিকা রাখবেন এবং মানবিকতার কোনো তোয়াক্কা করবেন না, সে আশঙ্কা ইতিমধ্যে লেবার দলে জোরালো হয়েছে। সে কারণেই আগামী নির্বাচনে লেবার দলকে বয়কটের ডাক উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেবার নেতা ছবি সংবলিত পোস্টারে বলা হচ্ছে- লেবারকে ভোট দেয়া মানে গাজায় ইসরাইলি গণহত্যাকে সমর্থন দেয়া।
তবে লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভার সদস্যদের পাশাপাশি লণ্ডনের মেয়র সাদিক খান, স্কটিশ লেবার নেতা আনাস সারওয়ার এবং গ্রেটার ম্যানচেস্টারের মেয়র অ্যাণ্ডি বার্নহ্যামসহ দলের অনেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু দলীয় সভাপতি স্টারমার বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি (হামাস) ইসরায়েলে ১ হাজার ৪০০ জনকে হত্যার তিন সপ্তাহ পর একটি যুদ্ধবিরতি পেলে আরও “উৎসাহিত” হবে।’
গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবি জানানোয় এবং এই দাবিতে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেওয়ার কারণে অন্তত দুইজন নেতাকে বহিষ্কার করেছেন স্টারমার। স্টারমারের এই অবস্থানের প্রতিবাদে ৩৪ জন বেশি কাউন্সিলার দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। এখন বার্নলি কাউন্সিলের নেতা আনোয়ার এবং পেণ্ডন কাউন্সিলের নেতা মাহমুদ তাঁকে পদত্যাগের আহ্বান জানালেন। মাহমুদ বলেন, দলের নেতা সবার কথা ‘শুনতে ব্যর্থ হয়েছেন’। এমন একজনকে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য স্টারমারের পদত্যাগ করা উচিত যিনি হবেন সহানুভূতিশীল এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ।
আনোয়ার বলেন, গাজায় মানবিক বিরতি ‘যথেষ্ট নয়’। তিনি বলেন, ‘আমরা যা বুঝি সেটি হলো, বিরোধী দলের নেতার অন্ততপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত, যাতে যুদ্ধবিরতি এবং সমস্ত জিম্মিদের মুক্তির আহ্বান জানানো হয়। তিনি যোগ করেন, ‘মানবিক বিরতি যথেষ্ট না হওয়ার কারণ হলো, স্পষ্টতই গাজায় ত্রাণ ঢুকবে কিন্তু এরপর আবার বোমা হামলা, আবার আক্রমণ শুরু হবে। আমরা যা দেখছি তা হলো, গাজার নিরপরাধ বেসামরিকদের পালানোর কোনো জায়গা নেই।’
এই দুই কাউন্সিল এমন সময় দলীয় প্রধানের পদত্যাগ চাইলেন যখন লেবার পার্টির কাউন্সিলারদের একটি নতুন জরিপে দেখা গেছে, দলের মাত্র ৩৭ শতাংশ স্থানীয় প্রতিনিধি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের বিষয়ে দলের অবস্থান নিয়ে ‘সন্তুষ্ট’, আর ৪৩ শতাংশ ‘অসন্তুষ্ট’।