যুক্তরাজ্যে ফেরার অনুমতি দেয়নি উচ্চ আদালতও: মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে গড়াতে পারে
পত্রিকা ডেস্ক ♦
লণ্ডন, ২৬ ফেব্রুয়ারি: ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগমকে সিরিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে ফেরার অনুমতি দেননি আপিল আদালত। নাগরিকত্ব বাতিলের ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে তাঁকে দেশে ফেরার সুযোগ দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে গত শুক্রবার আদেশ দেন কোর্ট অব আপিল। কোর্ট অব আপিলের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এদিন সর্বসম্মতিক্রমে রায় দেন। রায়ে বলা হয়, শামীমা বেগম যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারেন। তাই তাঁর নাগরিকত্ব বাতিলে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তাঁকে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া উচিত হবে না।
যুক্তরাজ্যের আপিল আদালত বলেছেন, আইনসিদ্ধভাবেই শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। আদালতের এই আদেশের অর্থ শামীমাকে সিরিয়ায় থাকতে হবে এবং তাঁর যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই।
শামীমার পরিবার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। ২০১৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি তাঁর স্কুলের দুই বন্ধুর সঙ্গে সিরিয়ায় যেতে পূর্ব লণ্ডনের বাসা ছাড়েন। পরে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের এক যোদ্ধাকে বিয়ে করেন শামীমা। সেখানে তাঁর তিনটি সন্তান হয়। তবে সন্তানেরা কেউ বেঁচে নেই। শামীমার বর্তমান বয়স ২৪ বছর।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে শামীমার সাক্ষাত পান ব্রিটিশ একজন সংবাদিক। ওই সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাতকারে শামীমা যুক্তরাজ্যে ফেরার আকুতি জানান। কিন্তু ওই সময়কার ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি সাজিদ জাভিদ জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে শামীমার নাগরিকত্ব বাতিল করেন।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রহীন করার নিয়ম নেই। কিন্তু যুক্তরাজ্য সরকার বলে আসছে, শামীমার বাবা-মা বাংলাদেশি। ফলে বাংলাদেশি আইন অনুযায়ী শামীমা বেগম জন্মগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের অধিকারী। ব্রিটিশ নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার ফলে শামীমা রাষ্ট্রহীন হয়ে যাননি। তিনি বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন।
শামীমা বেগমের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার বিষয়টি যুক্তরাজ্যের আদালতে গড়ায়। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করার সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিলো যুক্তরাজ্যের হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেছিলেন, নাগরিকত্ব বাতিলের ফলে শামীমা বেগম রাষ্ট্রহীন হয়ে যাননি। বংশগতভাবে তিনি ‘বাংলাদেশের নাগরিক’। তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দাবি করতে পারেন। তবে শামীমা বেগমের বিষয়ে বাংলাদেশের কিছুই করার নেই বলে জানিয়ে দেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছিলেন, ‘শামীমা সে দেশের (যুক্তরাজ্যের) নাগরিক। তিনি কখনো বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেননি। কাজেই তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশের কিছু করার নেই।’ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, শামীমা বেগমের জন্ম ও বেড়ে উঠা যুক্তরাজ্যে। তিনি যুক্তরাজ্যে থেকে উগ্রবাদে জড়িয়েছেন এবং সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। ফলে যুক্তরাজ্যকেই শামীমার দায়ভার নিতে হবে।
গত শুক্রবার কোর্ট অব আপিলের আদেশকে সামনে রেখে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে শামীমার আইনজীবীরা যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, আদালতে সুষ্ঠু শুনানি না হলেও তিনি নাগরিকত্ব ফেরতসংক্রান্ত এ মামলায় আপনা থেকেই জয়ী হবেন। বর্তমানে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় এক শরণার্থী শিবিরে আছেন তিনি। যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় অবস্থান করায় তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে বা শুনানিতে অংশ নিতে পারছেন না। আদেশে বিচারকগণ বলেছেন, শামীমা বেগমের বিষয়টি কঠোরভাবে দেখা হচ্ছে এবং নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য তিনিই দায়ী- এসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। ‘কিন্তু এ বিষয়ে একমত হওয়া বা কোনো বিষয়েই ভিন্নমত দেখানো আদালতের কাজ নয়। আমাদের একমাত্র দেখার বিষয়, তাঁর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বেআইনি ছিল কি না। আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, তা বেআইনি ছিল না এবং আপিলটি খারিজ করা হল।’ শামীমা বেগম ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুই বান্ধবীসহ সিরিয়ায় পাড়ি জমান। তাঁরা তিনজনই ছিলেন বাংলাদেশি অধ্যুষিত পূর্ব লণ্ডনের বেথনাল গ্রিন একাডেমির ছাত্রী। সিরিয়ায় পাড়ি দিয়ে শামীমা ডাচ বংশোদ্ভূত আইএস জঙ্গি ইয়াগো রিদাইককে বিয়ে করেন। এর আগে বেথনাল গ্রিন একাডেমির আরেক ছাত্রী সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন যার সূত্র ধরে পরবর্তীতে এই তিন বান্ধবী সিরিয়ায় পাড়ি দেন বলে জানা যায়। কানাডার এক গোয়েন্দা তিন বান্ধবীকে সিরিয়ায় পাড়ি দিতে সাহায্য করেছে বলেও খবর বের হয়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্তের উদ্যোগ নেয়নি।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ এক সাংবাদিক সিরিয়ার এক শরণার্থীশিবিরে শামীমার সাক্ষাৎ পান। তখন শামীমা যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার আকুতি জানান। কিছুদিন পর শামীমা একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। এরও কিছুদিন পর শিশুটির মৃত্যু হয়। ইয়াগো-শামীমা দম্পতির আগেও দুটি সন্তান হয়েছিল। তবে কোনো সন্তানই বেঁচে নেই। পুষ্টিহীনতা ও অসুস্থতায় তারা মারা যায় বলে জানিয়েছিলেন শামীমা। আইএসে যোগ দিতে যুক্তরাজ্য থেকে প্রায় ৯০০ ব্যক্তি বিভিন্ন সময় সিরিয়া ও ইরাকে গেছেন। ব্রিটেনের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তাঁদের মধ্যে প্রায় দেড় শ ব্যক্তির নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। সিরিয়ায় দুবছর আগে ধুলায় মিশে যায় আইএসের আধিপত্য। ওই সময় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার শামীমার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। গত বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যের কোর্ট অব আপিল এক আদেশে বলেন, শামীমা ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার ন্যায্য সুযোগ পাননি। কেননা, দেশের বাইরে শরণার্থীশিবিরে থেকে তিনি সরাসরি মামলায় লড়তে পারছেন না। শামীমা বেগমের মামলাটি এখন সুপ্রিম কোর্টে গড়াতে পারে।