কাউসার চৌধুরী, সিলেট | শফিকুল ইসলাম, লন্ডন
লণ্ডন ২৬ সেপ্টেম্বর: ছয়দিন ধরে ঢাকায় জেল খেটে বাংলাদেশে বিনিয়োগের খেসারত দিচ্ছেন বিলেতের সাত বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ছয়দিনেও নানা টালবাহানায় তাদের জামিন হয়নি। ‘হোমল্যাণ্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’-এর এই সাত পরিচালককে গত বুধবার তাদের কোম্পানীর কার্যালয়ে বার্ষিক সাধারণ সভা চলাকালে আকস্মিকভাবে পুলিশ উপস্থিত হয়ে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর গত কয়েকদিন ধরেই এ নিয়ে বিলেতে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে সোমবার নথি পৌঁছায়নি এই অবিশ্বাস্য অজুহাতে দ্বিতীয় দিনেও জামিন না দিয়ে?‘আসামী হাজির’ করার নির্দেশ দিয়ে শুনানী স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন মাগুরার আমলী আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট সুমনা পাল। সোমবার দুপুরে এই খবর লণ্ডনে ছড়িয়ে পড়ার থেকেই ক্ষোভে ফুঁসছেন প্রবাসীরা। উল্লেখ্য, গ্রাহকদের পলিসির টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ‘হোমল্যাণ্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’-এর ৭ পরিচালককে রাজধানী ঢাকার মতিঝিলের ‘হোমল্যাণ্ড লাইফ’-এর প্রধান কার্যালয় থেকে গত বুধবার বিকেলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত সকলেই বিলেতের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। গ্রেফতারকৃত সকলেই সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বাসিন্দা এবং ব্রিটিশ নাগরিক। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াসির আরাফাত খান গত রোববার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদককে এ বিষয়ে বলেন, ‘ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কোর্টের পরোয়ানার ভিত্তিতে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পরপরই তাদের সকলকে আদালতে সোপর্দ করা হয়’। জানা গেছে, ঢাকার মতিঝিলের (১১, এল্লাল চেম্বার-৩য় তলা) হোমল্যাণ্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় থেকে মতিঝিল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) কাজী মো. নাসিরুল আমিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন- কোম্পানির ভাইস-চেয়ারম্যান জামাল মিয়া, পরিচালক যথাক্রমে আব্দুর রব, কামাল মিয়া, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল আহাদ, জামাল উদ্দিন মকদ্দুস ও আব্দুল হাই। এর মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান জামাল মিয়া ও পরিচালক কামাল মিয়া সহোদর। তাদের বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায়। বসবাস লণ্ডনে। পরিচালক আব্দুল আহাদ ও আব্দুল হাইও সহোদর। তাদের বাড়ি বিশ্বনাথ উপজেলায়। মিলটন কীনসের প্রসিদ্ধ ‘জয়পুর’ রেন্টুরেন্টের মালিক তারা। পরিচালক জামাল উদ্দিন মকদ্দুস সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মণ্ডলপুর গ্রামের বাসিন্দা। এসেক্সের একাধিক রেস্টুরেন্টের মালিক এবং?ব্রিটেনের বিসিএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইউকেবিসিসিআইর সিনিয়র নেতা। বসবাস এসেক্সে। পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহরের বাসিন্দা। যুক্তরাজ্য জাসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তিনি। থাকেন পশ্চিম লণ্ডনের হানসলোতে। অপর পরিচালক আব্দুর রবের বাড়ি ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়ায়। তিনি ব্রিটেনে লেস্টারের বাসিন্দা। গ্রেফতারকৃত সকলই ব্রিটিশ নাগরিক এবং বাংলাদেশ ও লণ্ডনে তাদের অনেকগুলো সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতরাসহ ফয়জুল হক নামের আরেক ব্যবসায়ীসহ মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি খুলনা বিভাগের মাগুরার আদালতে পৃথক ৪টি মামলা দায়ের করা হয়। সিআর মামলা নং-২২৭/২২,২২৮/২২,২২৯/২২,২৩০/২২। ধারা নং ৪০৬ ও ৪২০ দণ্ডবিধি। মাগুরা জেলার সদর উপজেলার মৃত সৈয়দ বেলায়েতের পুত্র সৈয়দ মোফাক্কার আলী, একই উপজেলার বুধইরপাড়ার মৃত ধলা বিশ্বাসের পুত্র মো. আজর আলী, ওই উপজেলার ছয়চার গ্রামের মৃত সাদেক আলী মোল্লার পুত্র মো. নায়েব আলী ও পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ জেলার কালিয়াগ উপজেলার সড়াবাড়ীয়া গ্রামের মো. নওশের আলীর পুত্র মো. হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে এ সকল মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাগুলো আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানার কপি ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাঠানো হয়। সিএমএম আদালত পরোয়ানার কপিটি তামিলের জন্য মতিঝিল থানায় পাঠান। আদালতের পরোয়ানার ভিত্তিতেই তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে মতিঝিল থানার ওসি জানিয়েছেন। ৪টি মামলার এজাহারেই মাগুরা জেলার শালিখা থানাধীন আড়পাড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের অধীন বীমা গ্রাহকদের পলিসির টাকা আত্মসাত করে প্রতারণামূলকভাবে বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। তবে, মামলায় কোম্পানির চেয়ারম্যান, এমডি, জিএমসহ পদস্থ কাউকেই আসামি করা হয়নি। ঘটনা, মামলাসহ পুরো বিষয়ে রোববার সন্ধ্যায় দুই বাদীর সাথে প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা মামলার বিষয়ে নানা কথা বললেও চেয়ারম্যান, এমডি, জিএমসহ পদস্থ কর্মকর্তাদের আসামী না করার বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি। বাদী সৈয়দ মোফাক্কার আলী নিজে আড়পাড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ে ব্রাঞ্চ কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন জানিয়ে বলেন, কোম্পানিতে অনেককে পলিসি করানোর পর এখন গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। এমনকি বাড়িতে শান্তিতে ঘুমোতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়েই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। মামলার বিষয়টি নতুন নয় জানিয়ে তিনি বলেন, প্রায় দেড় বছর আগেও এভাবে মামলা করেছিলাম। ওই সময়ে কোম্পানি ৪৭ জন গ্রাহককে চেক দিয়েছিল। নতুন মামলার ফলে গ্রাহকরা অর্থ ফেরত পেতে পারেন-এই আশায় মামলা দায়ের করেছেন বলে জানান তিনি। অপর বাদী মো. নায়েব আলীও অনুরুপ অভিযোগ করেছেন। চাকুরির পাশাপাশি নিজেও বীমা করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকটা নিরুপায় হয়ে তিনি মামলা করেছেন। ঘটনাস্থল মাগুরা জেলার শালিখা থানার ওসি সিরাজুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমার থানায় এ রকম কোনো মামলা হয়নি। এ রকম ঘটনা আমার জানা নেই। কেউ কখনো বলেওনি। মাগুরা সদর থানার ওসি মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ রকম কোনো মামলা আমাদের কাছে নেই। থানায় এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেওনি। তবে, হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছে বলে লোকমুখে শুনেছি। এদিকে, এ বিষয় হোমল্যাণ্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল রোববার বলেছেন, মামলার বিষয়টি আমরা আগে জানতাম না। বিষয়টি জেনে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু সোমবার তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। পরে কেনো কোম্পানীর বিরুদ্ধে মামলায়?দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের এড়িয়ে শুধু প্রবাসীদের গ্রেফতার করা হলো এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেন। পরে তাকে বার বার ফোন করে পাওয়া যায়নি। তাঁর ওয়াটসআপে পাঠানো বার্তা তিনি দেখলেও এর জবাব দেননি। এদিকে, রোববার গ্রেফতার হওয়াদের জামিন দেয়া হয়নি, ইমেইলে পাঠানো নথি গ্রহনযোগ্য নয় এই অজুহাতে। পরদিন সোমবার আদালতে ‘নথি পৌঁছায়নি’ অজুহাতে জামিন নামঞ্জুর করেন মাগুরা আমলী আদালতের ম্যাজিস্টেট সুমনা পাল। পরে বিবাদীদের আইনজীবী ‘নথি পৌঁছায়নি’ অজুহাত চ্যালেঞ্জ করলে তিনি এর জবাব না দিয়ে?আগামী বৃহস্পতিবার শুনানী ও জামিন আবেদনের জন্য বিবাদীদের নিয়ে আদালতে উপস্থিত হবার নির্দেশ দেন বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারটি লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশকে বুধবার রাতেই জানানো হয়। সোমবার আবারো তাদের কাছ থেকে তথ্য জানতে চাইলে বলা হয়, আমরা বিষয়টি বিস্তারিত জানতে চেয়ে ঢাকায় যোগাযোগ করেছি। সেখান থেকে তথ্য পাওয়ার পরই আমরা এ ব্যাপারে জানাতে পারবো। এসব ঘটনায় হতাশ হয়ে ভূক্তভোগীদের পরিবার তাদের এলাকার ব্রিটিশ এমপিদের কাছে অভিযোগের চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এছাড়া, ব্রিটেনের বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠন ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গ্রেফতার হওয়া সকলেই কেবল লন্ডন নয়, নিজ নিজ এলাকায় সমাজসেবামূলক নানা কর্মকান্ডে জড়িত। জামাল উদ্দিন মখদ্দুস এলাকার শিক্ষা প্রসারে নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন জামাল উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের অদূরে এডভেঞ্চার ওয়ার্লড নামক পার্কের অন্যতম উদ্যোক্তা ও পরিচালক। হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অভ্যন্তরে নানা অনিয়মের ব্যাপারে এসব প্রবাসী পরিচালক সোচ্চার থাকায় তাদেরকে শিক্ষা দিতে এই মামলার আয়োজন করা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। লন্ডন-বাংলা প্রেসক্লাবের ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট ও নতুন দিন সম্পাদক মহিব চৌধুরী ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়ে বলেন, ব্রিটিশ-বাংলাদেশীরা মাতৃভূমির টানেই এখানে বিনিয়োগ করেন। তাদের বিনিয়োগ নিরাপদ রাখার দায়িত্বও সরকারের। এসকল প্রবাসীর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। কারণ সাধারণত কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা হলে এর চেয়ারম্যান, এমডি-জিএমের বিরুদ্ধে মামলা হয়ে থাকে। কিন্তু এ ঘটনায় এরকম কিছুই নেই। এতে ঘটনার ব্যাপারে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। রহস্য উদঘাটন করে মূল ঘটনা বের করতে তিনি দাবি জানিয়েছেন। ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক এক পরিচালক বলেন, সরকারিভাবে বিভিন্ন সময়ে প্রবাসীদেরকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও দেশে বিনিয়োগ করে প্রবাসীরা অনেক সময় হয়রানির শিকার হন। হোমল্যান্ড লাইফের এই ঘটনাটি এর জ্বলন্ত প্রমাণ। গ্রেফতারকৃতরা বিলেতে ও সিলেটের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও সম্মানিত ব্যক্তি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজ তারা অর্থ আত্মসাত ও প্রতারণার মামলায় জেল হাজতে। এটি লন্ডন প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। কোম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্তদের আসামী না করে ৭ জন প্রবাসী পরিচালককে গ্রেফতার নিয়ে প্রবাসীদেরকে সোচ্চার হবার পরামর্শ দেন। তিনি এ ঘটনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ আইনশৃংখলা বাহিনীর দৃষ্টি কামনা করেন। এ ঘটনা নিয়ে বিলেতে বাংলাদেশী কমিউনিটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।