মন্ত্রীসভায় দলীয় ঐক্যের প্রাধান্য | পিছিয়েছে বাজেট পেশ পরিকল্পনা
পত্রিকা প্রতিবেদন
লণ্ডন, ৩১ অক্টোবর: যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে প্রথম কোনো অশেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় সকলের চোখ এমনিতেই ঋষি সুনাকের দিকে। তাঁর বক্তব্য, বাচন ভঙ্গি, সংসদ বিতর্কে কতটা মানান সই- সব বিষয়ে তীক্ষ¦ দৃষ্টি সকলের। আর মন্ত্রীসভা গঠন ও সরকার পরিচালনার কৌশল নিয়ে আগ্রহ তো সকলের বেলায় সমান।
হাউজ অব কমন্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে রাজা তৃতীয় চার্লসের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন কনজারভেটিভ দলের নব নির্বাচিত নেতা ঋষি সুনাক। গত মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করেন।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই ঋষি সুনাক মন্ত্রীসভা গঠনে হাত দেন। দলের প্রভাবশালী কয়েকজনকে সামনের সারিতে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। বহাল রেখেছেন সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের মন্ত্রীসভার অনেককে। লিজ ট্রাস যেখানে কেবল নিজের সমর্থকদের নিয়ে মন্ত্রী সভা গঠন করেছিলেন। কিন্তু ঋষি সুনাক সকল পক্ষকে একত্রিত করে মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এটিকে ঋষির নেতৃত্বের দুর্বলতা বলে মন্তব্য করেছেন। তবে অনেকের মতে ঋষি দলীয় ঐক্যকে প্রাধন্য দিয়ে সঠিক কাজ করেছেন। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের অন্তকলহের জেরে সম্প্রতি দুই প্রধানমন্ত্রীর বিদায়ের প্রতি ইঙ্গিত করে তাঁরা বলছেন, ঋষির সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য এমন মন্ত্রীসভা অনিবার্য ছিলো। তবে মন্ত্রিসভায় সুয়েলা ব্র্যাভারম্যানকে হোম সেক্রেটারি হিসেবে ফিরিয়ে আনায় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁকে সুয়েলার নিয়োগ নিয়ে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। গণমাধ্যমগুলোও বিতর্কিত এই নিয়োগ নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে।
মাত্র এক সপ্তাহ আগে লিজ ট্রাসের সরকার থেকে পদত্যাগ করেছিলেন সুয়েলা। পদত্যাগপত্রে সুয়েলা নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে, সরকারি নিয়ম লঙ্ঘনের দায় নিয়ে হোম সেক্রেটারির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেছেন। তিনি দাবি করেন, সরকারের খসড়া ইমিগ্রেশন পরিকল্পনা সংক্রান্ত একটি ইমেইল ভুল করে দলের এক এমপির কাছে পাঠিয়েছিলেন, যা ওই এমপির দেখার কথা নয়।
কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় ঋষি সুনাক সুয়েলাকে হোম সেক্রেটারি পদে পুনরায় নিয়োগ দেন। বিরোধী দল লেবারের নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার পার্লামেন্ট বিতর্কে এই নিয়োগের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তিনি সরাসরি বিতর্কে ঋষি সুনাকের উদ্দেশে বলেন, ঋষি সততার সঙ্গে সরকার পরিচালনার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ২৪ ঘন্টারও কম সময়ে তাঁর সেই সততার নমুনা পাওয়া গেল সুয়েলাকে নিয়োগের মাধ্যমে। লেবার নেতা অভিযোগ করেন, ঋষি সুনাক নিজের নেতৃত্ব ঠিক রাখার জন্য সুয়েলা ব্রেভারম্যানের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেছেন। সুয়েলার নিয়োগ নিয়ে লেবার পার্টি স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছে।
এছাড়া অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, কীভাবে ঋষি সুনাক এমন একজনকে পুনর্নিযুক্ত করলেন, যিনি নিরাপত্তা লঙ্ঘনের কথা স্বীকার করেছেন। সংবাদ মাধ্যমগুলো বিভিন্ন উপাত্ত হাজির করে বলছে, পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করা সুয়েলার বর্ননা সঠিক নয়। তিনি প্রশ্নে নিয়ম ভঙ্গ করে সরকারী ওই নথি নিজের ব্যক্তিগত জিমেইলে নিয়েছেন। তারপর নিজের জিমেইল থেকে ওই এমপিকে পাঠিয়েছেন। সুয়েলা নিজের ভুল বুঝতে পেরে সাথে সাথে বিষয়টি সংশোধনের যে দাবি করেছেন সেটিও সঠিক নয় বলে জানিয়েছে বিবিসি। কারণ, সুয়েলা নিজের থেকে বিষয়টি মন্ত্রীপরিষদ সচিবকে জানাননি। বরং মন্ত্রীপরিষদ থেকে তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি স্ব-ইচ্ছায় পদত্যাগ করেননি। বরং তাঁকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিলো। এদিকে সুনাকের মন্ত্রীসভার চ্যান্সেলার হিসেবে বহাল আছেন জেরেমি হান্ট। উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরিয়ে এনেছেন ডোমিনিক রাবকে। আর হাউজ অব কমন্সের লিডার হিসেবে বহাল রেখেছেন পেনি মরডন্টকে। পেনি দুই দফা লিডারশিপ নির্বাচনে ঋষি সুনাকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ফলে পেনিকে মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা ঋষির বড় উদারতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বহাল আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি। এদিকে সুয়েলার পদত্যাগের পর গ্রান্ট শ্যাফটসকে হোম সেক্রেটারি নিযুক্ত করেছিলেন লিজ। এবার তাঁকে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। ঋষি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন জ্যাকব রিস-মগ, ব্র্যাণ্ডন লুইস, ক্লোই স্মিথ ও ভিকি ফোর্ডসহ কয়েকজন মন্ত্রী।
এদিকে গত মঙ্গলবার সুনাক টেলিফোনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় দুই নেতা রাশিয়ার ‘আগ্রাসন প্রতিরোধে’ ইউক্রেনকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এ ছাড়া দুই দেশের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে চীনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ নিতে সম্মত হয়েছেন। এর আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও টেলিফোনে কথা বলেন ঋষি সুনাক। বাজেট পেশ ১৭ নভেম্বর বাজেট পরিকল্পনা উপস্থাপন পিছিয়ে দিয়েছেন দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। সাবেক প্রধামন্ত্রী লিজ ট্রাসের মিনি বাজেটের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অস্থীরতার পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ অক্টোবর নতুন সংশোধনী বাজেট ঘোষণার দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। এখন সেই বাজেট ঘোষণার জন্য নতুন দিনক্ষণ জানানো হলো। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১৭ নভেম্বর ওই বাজেট ঘোষণা করা হবে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়ে ঋষি সুনাক বলেন, ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে আমাদের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সামনে যখন কঠিন সময় আসে, তখন আমরা সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা মানুষদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি। করোনা মহামারির সময় আমরা এমনটাই করেছিলাম, এবারও তা-ই করা হবে।’
এদিকে অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট জানান, নতুন বাজেট পরিকল্পনা ও করনীতি পেশ করতে তাঁর দুই সপ্তাহের বেশি সময় লাগতে পারে। ইতিমধ্যে তিনি সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের বিপুল কর ছাড়ের পরিকল্পনা থেকে সরে আসবেন বলে জানিয়েছেন। ট্রাসের এই পরিকল্পনার কারণে বাজারে অস্থিরতা ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছিল। এর জেরেই পদত্যাগ করতে হয় ট্রাসকে। এ পরিস্থিতিতে সুনাক ও হান্ট নতুন করে কর ছাড়ের ঝুঁকি নেবেন না বলে মত বিশ্লেষক অনেকের।