ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সবার আয়কর বাড়বে
বেনিফিটগ্রহীতাদের জন্য বাড়তি সহায়তা
ঘন্টাপ্রতি মজুরি হবে ১০ দশমিক ৪২ পেন্স
জ্বালানি বিলের সীমা বাড়িয়ে ৩ হাজার পাউণ্ড
পত্রিকা প্রতিবেদন
লণ্ডন, ২১ নভেম্বর: অবশেষে ঋষি সুনাকের সরকার প্রতিশ্রুত বাজেট ঘোষণা করলো। গত ১৭ নভেম্বর বৃহস্পতিবার হাউজ অব পার্লামেন্টে চ্যান্সেলার জেরেমি হান্ট শরৎকালীন বাজেটের বিস্তারিত তুলে ধরেন। বাজেটে অর্থনীতিতে সুষ্ঠু অস্থিরতা এবং মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের সংকট মোকাবেলায় অনেকটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে সরকার। একদিকে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সবার যেমন বাড়তি আয়কর দিতে হবে, তেমনি সরকারী ব্যয়ও কর্তন করা হবে অনেক। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক সংকটে থাকা ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য বিশেষ আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে এ বাজেটে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রী হয়েই ধনীদের আয়কর কর্তনের একচেটিয়া ঘোষণা দিয়ে এক মিনিবাজেট ঘোষণা করলে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়। পাউণ্ডের দর পড়ে যায়। এতে আমদানী ব্যয় বেড়ে পণ্যদ্রব্যের দাম হয় আকাশচুম্বী। বেড়ে যায় সরকারের নেয়া ঋণের সুদহারও। এ অবস্থায় তুমুল বিতর্কের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন লিজ ট্রাস। ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৭ নভেম্বর নতুন করে বাজেট দেয়ার ঘোষণা দেন। এই বাজেটে মূলত লিজ ট্রাস সরকারের সৃষ্ট সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী আগামী এপ্রিল থেকে ঘন্টায় ন্যূনতম মজুরি বেড়ে হবে ১০ পাউণ্ড ৪২ পেন্স; যা বর্তমানে ৯ পাউণ্ড ৫০ পেন্স। কিন্তু বাড়বে না করমুক্ত আয়ের সীমা। ফলে আয়বৃদ্ধির পাশাপাশি সকলকে বাড়তি আয়কর প্রদান করতে হবে। ডিভিডেন্ট এবং ক্যাপিটাল গেইন টেক্সের সীমাও আগামী বছর ও ২০২৪ আরও কমিয়ে আনা হবে। এ কারণেও মানুষকে অতিরিক্ত কর প্রদান করতে হবে। বছরে এক লাখ ৫০ হাজারের বেশি আয় করলে এতদিন ৪৫ শতাংশ হারে কর দিতে হতো। এই সীমা কমিয়ে নতুন বাজেটে ১ লাখ ২৫ হাজার ১৪০ পাউণ্ড করা হয়েছে। ফলে এর বেশি আয় করলেই ৪৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। আয়মুক্ত কর সীমার এ হার ২০২৮ সাল পর্যন্ত বজায় থাকবে। ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স এবং ইনহেরিটেন্স ট্যাক্সের করমুক্ত সীমাও ২০২৮ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এছাড়া স্থানীয় কাউন্সিলগুলো চাইলে ৫ শতাংশ পর্যন্ত কাউন্সিল ট্যাক্স বাড়াতে পারবে। এতদিন তারা ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারতো। আয়করের এই চাপ বৃদ্ধির বিপরীতে সরকার বেনিফিট গ্রহীতাদের জন্য নগদ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। বেনিফিটগ্রহীতারা আগামী বছর মোট ৯শ পাউণ্ড অতিরিক্ত পাবেন। এর পাশাপাশি পেনশনাররা পাবেন অতিরিক্ত ৩শ পাউণ্ড। আর যারা ডিসএবিলিটি বেনিফিট পান তারা ১৫০ পাউণ্ড অতিরিক্তি পাবেন। আসছে এপ্রিলে বেনিফিট ও পেনশনের হার মূল্যস্ফীতির সাথে মিল রেখে ১০ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়ানো হবে। এতে বেনিফিট ও পেনশন বাবদ বাড়তি অর্থ পাবেন গ্রহীতারা। এদিকে বিদ্যুত বিলের ক্যাপ আরও এক বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সেই ক্যাপের সীমা ২ হাজার ৫শ পাউণ্ড থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার পাউণ্ড করা হয়েছে। তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোর ওপর উইণ্ডফল ট্যাক্সের হার বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ হার ২০২৮ সালের মার্চ পর্যন্ত বজায় থাকবে। আর যেসব কোম্পানি বিদ্যুত উৎপাদন করে তাদের ওপর ৪৫ শতাংশ আয়কর আরোপ করা হয়েছে। অফিস ফর বাজেট রেসপনসিবিলিটি (ওএনএস) সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং এই বাজেট বিশ্লেষণ করে বলছে, যুক্তরাজ্য বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দার কবলে রয়েছে। তারা বলেছে, চলতি বছর সামগ্রিকভাবে ৪ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যের সার্বিক অর্থনীতির আকার ছোট হবে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২৪ সালে ১ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০২৫ সালে ২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ২ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ওএনএস। এছাড়া বেকারত্বের হার বর্তমানের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। ওএনএস এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর শেষে যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতির হার গড়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হবে। আগামী বছর তা আরও কমে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হবে।
আগামী তিন বছরের মধ্যে সরকার রাষ্ট্রীয় ঋণ কমিয়ে আনার পরিবর্তে ৫ বছরের মধ্যে ওই অবস্থানে পৌঁছানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সরকারের পূর্বঘোষিত জনকল্যাণ ব্যয়গুলো ২০২৫ সাল পর্যন্ত বলবদ থাকবে। এরপর থেকে কিছুটা বাড়ানো হবে। তবে এনএইচএস-এর জন্য আগামী দুই বছর অতিরিক্তি ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন পাউণ্ড দেয়া হবে এবং স্কুলের জন্য অতিরিক্ত দেয়া হবে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন পাউণ্ড। ন্যাটো জোটের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতিরক্ষা ব্যয় রাষ্ট্রীয় আয়ের ২ শতাংশ বলবৎ থাকবে। বৈদেশিক সহায়তা তহবিলে জাতীয় আয়ের শূণ্য দশমিক ৭ শতাংশের পরিবর্তে ব্যয় করা হবে শূণ্য দশমিক ৫ শতাংশ। আগামী পাঁচ বছর ব্যবসাগুলোতে সহায়তা দিতে ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন পাউণ্ড বরাদ্দ ধরা হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের দাম কমাতে একশর বেশি খাদ্যপণ্যের আমদানী শুল্ক বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী, সোশ্যাল হাউজিং টেনেন্টদের বাসাভাড়া আগামী এপ্রিলে ১১ শতাংশের পরিবর্তে ৭ শতাংশ হারে বাড়বে। ইলেকট্রিক কার, ভ্যান ও মোটরসাইকেলের জন্য ২০২৫ সাল থেকে রোড ট্যাক্স প্রদান করতে হবে। সোশ্যাল কেয়ারের আজীবন খরচ সীমা ২০২৩ সালের অক্টোবরে কার্যকর করা হবে। এতে প্রায় দুই বছর পিছিয়ে গেলে এটি কার্যকরের সিদ্ধান্ত। চ্যান্সেলার জেরেমি হান্ট সতর্ক করে বলেছেন, পরিবারগুলো ‘প্রকৃত চ্যালেঞ্জের’ সম্মুখীন হবে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ারও পূর্বাভাস দিয়েছেন তিনি। অফিস ফর বাজেট রেসপনসিবিলিটির বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতির কারণে আগামী ১৮ মাসে ব্রিটেনে পরিবারের গড় আয় সাত শতাংশ কমে যাবে। চ্যান্সেলার দাবি করেছেন, কর বৃদ্ধি এবং ব্যয় সংকোচনের বিষয়টি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে।
তিনি আরো বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের আমলে যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের ওপর যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে এটা প্রয়োজন ছিল। হান্ট বলেছেন, যুক্তরাজ্যের আর্থিক বাজারের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে বেদনাদায়ক এই কর রাজস্ব নীতি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না।