-শামীমা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন এবং পাচারের শিকার- শামীমার আইনজীবী
-আদালতে মা আসমা বেগমের আবেগঘন বক্তব্য
-পাচারের শিকার ব্যক্তিও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে- হোম অফিসের আইনজীবী
পত্রিকা প্রতিবেদন
লণ্ডন, ২৮ নভেম্বর: ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে সিরিয়ার সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইএস-এ যোগ দেয়া শামীমা বেগমের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে নতুুন করে আইনী লড়াই চলছে। শামীমা বেগমের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ফেরত দেয়ার দাবির পক্ষে-বিপক্ষে সপ্তাহজুড়ে চলা পাঁচদিনের শুনানী শুক্রবার শেষ হয়েছে।
একদিকে, শামীমার নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার দাবীতে রাষ্ট্রের সাথে আইনী লড়াই চলছে। অন্যদিকে, আট বছর পেরিয়ে?গেলেও থামেনি শামীমার মায়ের কান্না।
আদালতে শুনানীতে শামীমার পক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, শামীমা বেগম পাচারের শিকার হয়েছিলেন। কারণ তিনি তখন অপ্রাপ্তবয়ষ্ক ছিলেন এবং নিজের ভালো মন্দ বোঝার মত যথেষ্ট পরিপক্ক তিনি ছিলেন না। তাঁকে মগজধোলাই করে যৌন বিলাসে ব্যবহারের উদ্দেশে সিরিয়ায় নেয়া হয়। এ পাচার কাজে কানাডার হয়ে কাজ করা একজন গোয়েন্দার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও তাঁরা তুলে ধরেন।
আদালতে শামীমা বেগমের আইনজীবী শামীমার মা আসমা বেগমের এক আবেগঘন বক্তব্যের অংশবিশেষ পড়ে শোনান। এতে আসমা বেগম বলেছেন, তাঁর সন্তানকে যেভাবে তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, তা তখন তিনি বুঝতে পারেননি। তিনি আরো বলেন, এক মুহূর্তের জন্যও সন্তানকে ভুলে যাননি, তাঁর প্রতি ভালোবাসা কমেনি এবং তাঁর ঘরে ফিরে আসার অপেক্ষা থামেনি।
তবে শামীমার নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে হোম অফিসের আইনজীবী বলেছেন, অপ্রাপ্ত বয়সে পাচার হওয়া ব্যক্তিও রাষ্ট্র ও জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারেন। যৌন কিংবা অন্যান্য নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারেন। সন্ধান মেলার পর শামীমা বেগম যে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন সেখানে তিনি আইএস-এ যোগ দেয়ার জন্য কোনো ধরণের অনুশোচনা দেখাননি। চোখ-কান খোলা রেখেই তিনি নিজের ইচ্ছায় সিরিয়াতে গিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, শামীমা বেগম বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান। পূর্ব লণ্ডনের বেথনাল গ্রিন একাডেমির শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে আরও দুই বান্ধবীসহ সিরিয়াতে পাড়ি জমান। সেখানে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইএস এ যোগ দেন। ২০১৯ সালে আইএস সন্ত্রাসীদের পতনের সময়ে টাইমস সংবাদপত্রের একজন সাংবাদিক সিরিয়ার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে শামীমার সন্ধান পান। তিনি শামীমা বেগমের একটি সাক্ষাতকার প্রচার করেন। ওই সাক্ষাতকার প্রচারের পর তৎকালীন যুক্তরাজ্যের হোম সেক্রেটারি সাজিদ জাভিদ শামীমা বেগমের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করেন। সরকার যুক্তি দেখায় ব্রিটিশ নাগরিকত্ব হারালে শামীমা রাষ্ট্রহীন হবেন না, কার তিনি তাঁর মা-বাবার দেশ বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারবেন।
সরকারের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালিযে যাচ্ছে শামীমা বেগম। বর্তমানে স্পেশাল ইমিগ্রেশন অ্যাপিলস কমিশনে (এসআইএসি) এই মামলাটি আছে। এ আদালতেই শামীমার নাগরিকত্ব বাতিলের বৈধতা নিয়ে ৫ দিনের শুনানি হয়েছে। উভয়পক্ষে যুক্তি-তর্ক শেষ হলেও আদালতের এখনও রায়ের তারিখ ঘোষণা করেনি। আগামী জানুয়ারিতে এ মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে।
স্পেশাল ইমিগ্রেশন অ্যাপিলস কমিশনের মর্যাদা হাইকোর্টের সমান। এ আদালতে প্রয়োজনে গোপনে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে সাক্ষ্য-প্রমাণ দাখিল করা যায়। শামীমা বেগমের মামলার শুনানীতেও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সদস্য পর্দার আড়াল থেকে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁরা শামীমা বেগমকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করার পক্ষে তাদের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।
প্রায় আট বছর আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন শামীমা। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। পূর্ব লন্ডনের অন্য দুই স্কুলছাত্রী খাদিজা সুলতানা (১৬) ও আমিরা আবাসের (১৫) সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন শামীমা। শামীমার পারিবারিক আইনজীবী বলেছিলেন, সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান হামলায় খাদিজা নিহত হয়। আর ২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে শামীমা বলেছিলেন, তিনি শুনেছেন, আমিরা আবাসী বেঁচে আছেন। কিন্তু আদালতের শুনানীতে যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দারা বলছেন আমিরা আবাসি বেঁচে নেই। শুনানীতে শামীমা বেগমের আইনজীবী ডেন স্কয়ার্স কেসি শামীমা বেগমের মা আসমা বেগমের একটি লিখিত বক্তব্যের কিছু অংশ পড়ে শোনান। এতে আসমা বেগম বলেন, আমার সন্তান শামীমাকে যে উপায়ে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, তা আমি তখন বুঝতে পারিনি। আমি এক মুহূর্তের জন্যও আমার সন্তানকে ভুলে যাইনি, তাঁর প্রতি ভালোবাসা কমেনি এবং তাঁর ঘরে ফিরে আসার অপেক্ষা থামেনি। আদালতের আপিল শুনানিতে শামীমার পক্ষের আইনজীবী ড্যান স্কয়ারেস কেসি বলেন, এটা স্পষ্ট যে নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত শামীমা বেগমকে কার্যত রাষ্ট্রহীন করে তুলবে এমন সম্ভাবনার কথা সাজিদ জাভিদ বিবেচনা করেননি। এমনকি তিনি এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের মনোভাব জানার চেষ্টাও করেননি। আদালতের দাখিল করা নথিতে দেখা গেছে, শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ার আগের দিনই তার রাষ্ট্রহীনতা নিশ্চিত করা হয়েছিল। তিনি বলেন, এসব বিষয়ের মধ্যে বড় প্রশ্ন হচ্ছে শামীমা বেগমকে তাঁর মা-বাবার সূত্রে বাংলাদেশ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে কি না এবং কোনো সুরক্ষা বা ব্যবহারিক সহায়তা প্রদান করবে কি না? কারণ, ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চিত করেছিলেন যে শামীমা বেগম বাংলাদেশে গেলে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার জন্য মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন। আপিল শুনানিতে শামীমা বেগমের আইনজীবী আরও বলেন, এটা স্পষ্ট যে সাজিদ জাভিদ যদি আপিলকারীকে তাঁর নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার বাস্তব প্রভাব সম্পর্কে অনুসন্ধান করতেন, তবে তিনি সম্ভবত বুঝতে পারতেন যে আপিলকারীকে কোনো রাষ্ট্রের সুরক্ষা ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া যায় না। তাঁর অন্তত এটুকু বোঝা উচিত ছিল যে একজন রাষ্ট্রহীন মানুষের বাস্তব জীবন কেমন হতে পারে। ইংল্যান্ডের নিযুক্ত আইনজীবী যুক্তিতর্কে বলেন, বিষয়টি কি এমন যে সেক্রেটারি অব স্টেইট তাঁর দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিলের পূর্বে অন্য দেশের সরকারের মতামত নেবে? গত আগস্ট মাসে বিবিসি নিউজের এক অনুসন্ধানে জানা যায়, শামীমাকে সিরিয়ায় পাচার করা হয়েছিল। একটি গোয়েন্দা সংস্থা সে সময় কানাডার হয়ে কাজ করছিল। ওই সংস্থাই শামীমাকে পাচারের জন্য দায়ী। কানাডীয় সরকার তখন বলেছে, তারা এই অভিযোগের তদন্ত চালাবে। সিরিয়ায় শামীমার সঙ্গে নেদারল্যান্ডের নিযুক্ত আইএসের এক সদস্যের সঙ্গে বিয়ে হয়। আইএসের অধীনে তাঁরা তিন বছরের বেশি সময় বসবাস করেন।
২০১৯ সালে ব্রিটিশ টাইমস পত্রিকার এক খবরে জানা যায়, শামীমা ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি সিরিয়ার একটি শরণার্থীশিবিরে আছেন। পরে শামীমার সন্তান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। শামীমা বলেন, এর আগেও তিনি দুই সন্তানকে হারিয়েছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিবিসির আই অ্যাম নট আ মনস্টার পডকাস্টে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শামীমা বলেন, আইএস দলে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি অনুতপ্ত। জীবনে যে কয় দিন বাঁচবেন, এই অনুতাপ তাঁর থাকবে। বাকি জীবন যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করবেন তিনি। শামীমা ওই পডকাস্টে আরও বলেন, ম্যানচেস্টার অ্যারেনা এলাকায় ২০১৭ সালে বোমা হামলায় ২২ জন নিহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে আইএস জড়িত ছিল। এটি ছিল আইএসের ঘাঁটিতে সামরিক হামলার প্রতিশোধ। বিবিসির ওই পডকাস্টে একান্ত সাক্ষাৎকারে শামীমা বলেন, যুক্তরাজ্য ছাড়ার আগে তিনি পাচারের শিকার হয়েছিলেন। আইএস এ বিষয়ে তাঁকে বিস্তারিত যেসব নির্দেশনা দিয়েছিল, তা-ও তিনি বলেন। শামীমা আরও বলেন, আইএসের মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির সহায়তা ছাড়া তিনি কখনোই সিরিয়ায় যেতে পারতেন না। আইএসের মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ওই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আল রাশেদ বলে জানান শামীমা। হোম অফিসের আইনজীবীরা বলেন, শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। তাঁরা বলেন, শামীমা নিরাপত্তার জন্য আইএস এলাকা থেকে পালিয়েছিলেন। কিন্তু আইএসের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট নন, তা বলা যাবে না। তাঁরা আরও বলেন, শামীমাকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত কয়েক ধাপে পর্যালোচনা করে নেওয়া হয়েছে। শামীমা জঙ্গি দলে যোগ দেওয়ার জন্য কোনো অনুতাপ করেননি। তিনি যখন সিরিয়ায় যান, তখন আইএসের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সব জানতেন শামীমা। যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইফাইভের পরিচালিত এক প্রতিবেদন বলছে, যাঁরা আইএস-অধ্যুষিত এলাকায় ভ্রমণ করেছেন, তাঁরা সবাই আইএসের সহিংস কার্যক্রম সম্পর্কে জানতেন। শুনানি চলাকালে শামীমার আইনজীবীরা এমআইফাইভের এক কর্মকর্তাকে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হাজির করেন। ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, শামীমা মানবপাচারের শিকার হতে পারেন। তবে তিনি হুমকিও হতে পারেন।