শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় এনাম আলীকে স্মরণ
পিতার স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা চাইলেন পুত্র
লণ্ডন, ০৫ ডিসেম্বর: কারী অস্কার খ্যাত ‘ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়াডর্স’-এর প্রবর্তক মরহুম এনাম আলী এমবিইকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণের মাধ্যমে সম্পন্ন হলো অ্যাওয়ার্ডের অষ্টাদশ আয়োজন। গত ২৮ নভেম্বর সোমবার সেন্ট্রাল লণ্ডনের বাটারসি এভুলেশন পার্কে নির্মিত কারি অস্কারের সুবিশাল হলে চোখধাধাঁনো আয়োজনে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ কারী অ্যাওয়ার্ড মঞ্চকে বরাবরের মতোই বর্ণিল করে তুলেন বিশ্বখ্যাত সেলিব্রেটিরা। কারি শিল্পের এই অভিজাত আয়োজনে যেমন থাকে ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির বর্ণিল পরিচয়। তেমনি শৈল্পিক ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডকে অন্য সব আয়োজন থেকে ব্যতিক্রমী করে তোলার মাধ্যমে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ‘ইভেন্ট মাস্টার’ খ্যাত এনাম আলী এমবিই।
দীর্ঘ দেড় যুগের পথচলায় এনাম আলী এমবিই পূর্ব পুরুষের শ্রম ও ঘামে গড়ে উঠা ব্রিটিশ অর্থনীতিতে সরাসরি বিলিয়ন পাউণ্ডের অবদান রাখা কারি শিল্পকে শুধু ব্যবসা নয়, একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই খাতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন ৪৫ বছর।
চলতি বছরের জুলাই মাসে মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন কারি শিল্পের এই নিবেদিতপ্রাণ। তাই এবারের ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের আয়োজনে ছিলো যেনো গভীর বেদনার আবহও। এই অ্যাওয়ার্ডের প্রবর্তক এনাম আলীর অনুপস্থিতির বিষাদ টের পাওয়া যাচ্ছিলো উপস্থিত অতিথিদের চোখেমুখে। তাঁরা তাকে স্মরণ করেছেন গভীর শোক ও শ্রদ্ধায়। পাশাপাশি অনুষ্ঠানে ছিলো কারী শিল্পের বিকাশে তাঁর অনন্য কাজগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার শপথ।
এই অনুষ্ঠানে নবগঠিত এনাম আলী ফাউণ্ডেশনের জন্য অনুষ্ঠিত অকশনে উপস্থিত মানুষ দুই হাত খুলে এগিয়ে আসেন। ১০টি আইটেম থেকে প্রায় কোটি টাকার (প্রায় ৮০ হাজার পাউণ্ড) ফাণ্ড সংগ্রহ করা হয় তাৎক্ষণিকভাবে। শুধুমাত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল স্বাক্ষরিত একটিট চিঠি অকশনে বিক্রি হয় ৫০ হাজার পাউণ্ডে। এই অর্থ বিলেত ও বাংলাদেশে ক্যান্সার সংক্রান্ত চ্যারিটিতে খরচ করা হবে বলে জানা গেছে। ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড এর প্রযোজক এনাম আলী এমবিই কন্যা জাস্টিন আলীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও সেলিব্রেটি প্রেজেন্টার ও কমেডিয়ান, অভিনেতা ও লেখক হিউ ডেনিসের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন ব্রিটিশ কারী অ্যাওয়ার্ড’র ডিরেক্টর মরহুম এনাম আলী এমবিই পুত্র জেফ্রি আলী।
অনুষ্ঠানে এনাম আলীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। উদ্বোধনী বক্তব্যে শোকে আপ্লুত জেফ্রি আলী বাবার জন্য দোআ কামনা করে বলেন, জীবনের ৪৫ বছর আমার বাবা এনাম আলী এমবিই কারি ইণ্ডাস্ট্রির উন্নতি ও এ শিল্পের সাথে জড়িতদের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি বলতেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা সাধারণ কোনো ব্যবসা নয়, এটি একটি শিল্প এবং এর আধুনিকায়নে তাঁর কাজ ছিল গতানুগতিক ধারার বাইরে। বাবা স্বপ্ন দেখতেন, নতুন প্রজন্মকে কারি ইণ্ডাস্টির সাথে সম্পৃক্ত করার এবং এ জন্য যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এর আধুনিকায়নে তিনি ব্রিটিশ সরকারের সর্বোচ্চ মহলে দাবি জানাতেন।
ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড ডিরেক্টর জেফ্রি আলী বর্তমান কারী শিল্পের সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন, এক দিকে স্টাফ সংকটের কারণে যখন বিলিয়ন পাউণ্ডের কর প্রদানকারী শিল্পটি ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হচ্ছিলো তখনও ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা ছিল, কিন্তু এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য প্রায় ৪৫ ভাগ বৃদ্ধির কারণে টিকে থাকা এখন যুদ্ধের মতো হয়ে যাচ্ছে। জেফ্রি বলেন, পেঁয়াজের দাম এখন আকাশচুম্বী। তেল ছাড়া যেখানে খাবার তৈরীর সম্ভব নয় সেখানে তেলের দাম এখন ধরাছোঁয়ার বাহিরে চলে গেছে। জেফ্রি পরিস্থিতিকে সংকটময় উল্লেখ করে বলেন, আমার বাবা সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন। আসুন আমরা এ সংকট উত্তরণে এক সাথে কাজ করি।
অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, আমার জীবনে কাজের সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র ছিল কারি হাউজে কাজ করা। এ কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি একটি রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার, শেফ, ওয়েটার, ডেলিভারি ড্রাইভার কতটা পরিশ্রম করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে সেই অভিজ্ঞতা আমাকে যে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সেটা হলো, মানুষের সাথে ন্যায্য আচরণ করার গুরুত্ব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্রিটিশ এশিয়ান শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে আইকনিক শিল্প হলো কারি শিল্প। তিনি মরহুম এনাম আলী এমবিই ও তাঁর অনবদ্য তৈরী ব্রিটেনের ‘কারী অস্কার’-কে সমর্থন করতে পেরে আনন্দিত উল্লেখ করে বলেন, এনাম আলী এমবিই আপনি আমাদের জন্য এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যা কিছু করেছেন এবং রেখে গেছেন এ জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। যুক্তরাজ্যের কারী শিল্পের অভিজাত অনুষ্ঠান হিসাবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এ অ্যাওয়ার্ডকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ‘কারি অস্কার’ উল্লেখ করে বলে ছিলেন, ব্রিটেনের মানুষের হাউজ হোলড খাবার চিকেন টিক্কা মসল্লা। ব্রিটিশ নাগরিকরা এ খাবার ছাড়া সপ্তাহের একটি দিনও চিন্তা করে না। এ শিল্পকে উচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যেতে কাজ করছেন এনাম আলী এমবিই। বরাবরের মতোই ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড-এর আঠারোতম অনুষ্ঠানে রাজনীতি, খেলাধুলা, শোবিজ এবং খ্যাতনামা ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন টিভি ব্যক্তিত্ব ক্রিস ট্যারান্ট, নাদিয়া এসেক্স (সেলেব গো ডেটিং), ডঃ রঞ্জ সিং, মার্লিন গ্রিফিথস, হেইলি পার্কস (দিস মর্নিং), ড্যানিয়েল ম্যাসন, সায়রা খান, অভিনেতা জেমস কসমো, নিনা ওয়াদিয়া, প্রাক্তন ইংল্যাণ্ড ফুটবলার ডেভিড সীম্যান, আইস স্কেটার ফ্রাঙ্কি পোলটনি, সাবেক ইংল্যাণ্ড ক্রিকেটার ফিল টাফনেল, রিয়েলিটি টিভি তারকা ফারাহ সাত্তার, শিক্ষানবিশ প্রতিযোগী নিক শাওয়ারিং এবং এমপি ক্রিস গ্রেলিং। অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল শীর্ষস্থানীয় অনলাইন ফুড অর্ডারিং এবং ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম জাস্ট ইট।
২০২২-এর ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড যারা পেলেন
স্কটল্যাণ্ডের সেরা রেস্টুরেন্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে গ্লাসগো’র ‘স্বদেশ রেস্টুরেন্ট’, নর্থ-ইস্ট ইউকের সেরা রেস্টুরেন্টের অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে নিউক্যাসেলের ‘খাই খাই’ ইণ্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট, নর্থ-ওয়েস্ট ইউকের সেরা রেস্টুরেন্টের অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে লিভারপুলের মোগলি স্ট্রিট ফুড, ইস্ট মিডল্যাণ্ডস’র সেরা রেস্টুরেন্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে নটিংহাম-এর ‘ক্যালকাটা ক্লাব’ রেস্টুরেন্ট, ওয়েস্ট মিডল্যাণ্ডসের সেরা অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে বার্মিংহামের ‘লাসান রেস্টুরেন্ট’, ওয়েলসের সেরা রেস্টুরেন্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে কার্ডিফের ‘পার্পেল পাপাডম’, সাউথ ইস্ট এর সেরা রেস্টুরেন্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে কেন্টের ওয়েস্টারহ্যামের ‘শ্যাম্পান অ্যাট পিনিং হুইল’ রেস্টুরেন্ট, দক্ষিণ পশ্চিমের সেরা রেস্তোরাঁ পৃথ্বী, চেলটেনহ্যাম সেন্ট্রাল লণ্ডন এবং সিটির সেরা অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে মেফেয়ার-এর বেনারস রেস্টুরেন্ট, লণ্ডন সিটির পার্শ¦বর্তী এলাকার সেরা রেস্টুরেন্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে ব্রমলি’র ‘কপার সিলন’, সেরা টেকওয়ে’র অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে জেরার্ডস ক্রস এর ‘মালিকস এক্সপ্রেস কিচেন’, সেরা নিউ কামার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে হলবর্ণের ‘কর্নেল সাব’ এবং বর্ষসেরা কারী ব্যক্তিত্বের অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল পুরস্কার প্রাপ্ত শেফ ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান। অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ সংখ্যক লাইভ, পাবলিক ভোটের ভিত্তিতে ডিনারস চয়েস অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে ব্রিস্টলের আরবান তান্দুরি।