পত্রিকা প্রতিবেদন ♦
লণ্ডন, ০৯ জানুয়ারি: পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন প্রথিতযশা সাংবাদিক অজয় পাল। তাঁর জীবনাবসানে বিলাতের বাঙালি কমিউনিটি এবং সিলেটের সাংবাদিক ও সাহিত্য সংস্কৃতিমহলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। গত ৭ জানুয়ারি শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় তিনি যুক্তরাজ্যের রয়েল লণ্ডন হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে ৪ জানুয়ারি বুধবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।
তিনি পূর্ব লণ্ডনের বাসিন্দা ছিলেন। স্ত্রী শীলা পাল, দুই পুত্রসহ অসংখ্য সতীর্থ সাংবাদিক সংস্কৃতিকর্মী ও বন্ধুবান্ধব রেখে গেছেন তিনি। বিলেতে পাড়ি দেয়ার আগে বসবাস ছিলো সিলেট শহরের দাড়িয়াপাড়ায়। সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অজয়পাল একজন সংগ্রামী কর্মী হিসাবে সক্রিয় ছিলেন সর্বদা। খেলাঘর, উদীচী ও নাট্যসংগঠনগুলোর ছিলেন কর্মী ও নেপথ্য সংগঠক। ছিলেন সিলেট বেতারের ফিচার লেখক ও পাঠক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন একজন কলমযোদ্ধা। ভারতের হাইলাকান্দি থেকে প্রকাশিত ‘জাগরণ’ পত্রিকায় নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবিরাম লিখেছেন।
অজয় পালের জন্ম ১৯৫৩ সালে হবিগঞ্জ আদ্য পাশা গ্রামে মামার বাড়িতে। তাঁর পরিবারের আদি নিবাস ছিলো হবিগঞ্জের বাহুবল। ১৯৭০ সালে তরুণ অজয় পাল সাংবাদিকতায় যোগদান করার পর সত্তরের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে তার সরেজমিন রিপোর্ট ছিল মানবিক বিপর্যয়ের লণ্ডভণ্ড চিত্র সম্বলিত হাহাকারের এক করুণ ধ্বনি। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক যুগভেরীতে। সেই থেকে তার প্রতিটি রিপোর্ট পাঠকমহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। আধুনিক, প্রাঞ্জল এবং সহজ ভাষার জাদুকর হিসাবে তিনি অচিরেই তরুণ সাংবাদিক মহলে আদৃত হয়ে উঠেন।
অজয় পাল শুধু সাংবাদিকতায়ই নয়, সহজ ভাষায় ছড়া ও গান রচনায় বিশেষ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নিবন্ধিত জনপ্রিয় গীতিকার। সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিক অজয় পাল বাংলাদেশে সামরিক ও অগণতান্ত্রিক শাসনামলে শাসকদের রোষানলে পড়ে কয়েকবার কারাবরণ করেন। নিপীড়ন ও নির্যাতন ভোগের পরও সাংবাদিকতা জীবনে আপসহীন হিসাবে তার তুলনা ছিল বিরল।
বর্ণাঢ্য সৃষ্টিশীল জীবন
জীবনভরই তিনি নানামাত্রিক সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন ছিলেন। সাংবাদিকতা জীবনে সমাজের সব অসঙ্গতি, অন্যায়-অবিচারসহ সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর পক্ষে কলম ধরে নির্ভীকতার সঙ্গে এই পেশাকে তিনি এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আপোষহীন সাংবাদিকতার কারণে মিথ্যা মামলায়?তাকে জেলও খাটতে হয়েছে। ১৯৮০ সালে দৈনিক সংবাদে কর্মরত থাকাকালে সিলেটের স্থানীয় একজন সাংসদের গাড়ি পোড়ানোর মিথ্যা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে পাঠানো অজয় পালের প্রথম রিপোর্টটি ছাপা হয় আমিনুর রশীদ চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘যুগভেরী’ পত্রিকায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আগরতলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘জাগরণ’ পত্রিকায়ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখি করেন।
৫০ বছরের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় সিলেটের স্থানীয় ও জাতীয় এবং প্রবাস থেকে প্রকাশিত অগণন সংবাদপত্রে কাজ করার গৌরব অর্জন করেন। জাতীয় দৈনিকের মধ্যে বাংলার বাণী, দৈনিক সংবাদ, দেশবাংলা ও বাংলাবাজার পত্রিকা ছাড়াও সিলেটের স্থানীয় দৈনিক সিলেট বাণী পত্রিকায়ও কাজ করেন কিছুদিন। আর সাপ্তাহিকের মধ্যে যুগভেরী, সিলেট সমাচার, দেশবার্তা ও সিলেটধ্বনি পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন বহুদিন। শুরুর দিকে সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সূর্যের দেশ পত্রিকায় কিছুদিন সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। আশির দশকে বিলাতবাসী হলে কাজ করেছেন সাপ্তাহিক সুরমায়। যুক্ত ছিলেন লণ্ডন থেকে প্রকাশিত জাগরণ, পত্রিকা, দেশবার্তা, পূর্বদেশ ও কানাডা থেকে প্রকাশিত বাংলা নিউজ পত্রিকার সঙ্গে। ২০০৮ সালে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত মাসিক হৃদয়ে বাংলাদেশ ম্যাগাজিনের ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। বাংলাবাজার পত্রিকা টানা দুবছর অজয় পালকে দেশের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি গীতিকার ও ছড়াকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। এর পাশাপাশি দুই বছর সিলেট বেতার কেন্দ্রে স্থানীয় সংবাদও পাঠ করেন। পাঁচ দশকের অধিক সাংবাদিকতা জীবনে বহু স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য তাকে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা একাধিকবার দেশসেরা সাংবাদিক নির্বাচিত করে।
১৯৭৬ সালে সিলেট প্রেসক্লাব নবরূপে গঠিত হলে তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এছাড়া বিলাতে এলে লণ্ডনবাংলা প্রেসক্লাবেও সদস্য হিসাবে তিনি যোগদান করেন। ২০০৮ সালে ক্লাবের নির্বাহী সদস্যপদে নির্বাচিত হন। সাংবাদিক হিসাবে অজয় পাল ২০০১ সালে কিউবার হাভানায় ইন্টার-পার্লামেন্টারি কনভেনশনে বাংলাদেশ সংসদীয় দলের সঙ্গে সাংবাদিক প্রতিনিধি হিসাবে কিউবা সফর করেন।
লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব ও বাংলাদেশ হাইকমিশনের শোক
লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক নির্বাহী সদস্য, একাত্তরের কলমযোদ্ধা, বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় পালের মৃত্যুতে ক্লাব নেতৃবৃন্দ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। প্রেস ক্লাব সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ ও কোষাধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ এক শোকবার্তায় শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।
শোকবার্তায় নেতৃবৃন্দ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আগরতলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জাগরণে অজয় পালের কাজের কথা স্মরণ করে বলেন, তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই একাত্তরের কলম সৈনিক। এছাড়া অর্ধশতাব্দী ধরে বাংলাদেশ ও বিলেতের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তাঁর নিষ্ঠা ও মেধাবী সাংবাদিকতার কথা উল্লেখ করে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে জনাব অজয় পাল তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের কথাও উল্লেখ করেন নেতৃবৃন্দ। অজয় পালের মৃত্যুতে বাংলা সংবাদ-মাধ্যম এবং বিলেতের বাংলাদেশী কমিউনিটি একজন অভিজ্ঞ ও নিবেদিত সাংবাদিক ব্যক্তিত্বকে হারালো।
হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমের শোক
এদিকে, সাংবাদিক অজয় পালের মৃত্যুতে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। গত ০৮ জানুয়ারি দূতাবাসের মিনিস্টার প্রেস আশেকুননবী চৌধুরী প্রেরিত এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রদূত বলেন, বিশিষ্ট বাংলাদেশী-ব্রিটিশ সাংবাদিক ও সিলেটের কৃতি সন্তান জনাব অজয় পালের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত ও দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশেষকরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পরলোকগত অজয় পালের অবদানের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত সাইদা মুনা তাসনিম আরো বলেন, জনাব অজয় পাল পাঁচ দশকেরও অধিক সময় সাংবাদিকতা পেশায় নিবেদিত ছিলেন। ১৯৭০ সালে সিলেটের প্রাচীনতম সংবাদপত্র যুগভেরী থেকে শুরু করে সিলেটের স্থানীয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় জনাব অজয় পাল তাঁর মেধাবী সাংবাদিকতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতের আগরতলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জাগরণেরও সাংবাদিক ছিলেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে অবদান রেখে গেছেন। বিলেতেও বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে জনাব অজয় পাল তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। মান্যবর রাষ্ট্রদূত অজয় পালের বিদেহী আত্মার পরম শান্তি কামনা করে বলেন, জনাব অজয় পালের মৃত্যুতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের বাংলা সংবাদ-মাধ্যম ও সাংবাদিকগণ, তদুপরী ব্রিটিশ বাংলাদেশী-ব্রিটিশ কমিউনিটি একজন অভিজ্ঞ ও নিবেদিত সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিত্বকে হারালো।
সাংবাদিক অজয় পালের তিরোধানে তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন ও সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে শোক প্রকাশ করা হয়েছে লণ্ডনবাংলা প্রেসক্লাব, সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিবার, সাপ্তাহিক সুরমা, সাপ্তাহিক জনমতসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে।
এছাড়া সাংবাদিক অজয় পালের মৃত্যুতে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ শোক প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ থেকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ডা. জিয়া উদ্দিন, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী হিমাংশু গোস্বামী, সুরমার সাবেক সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাসন, সুরমা পরিবারের পক্ষ থেকে বর্তমান সম্পাদক শামসুল আলম লিটন, জনমত সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা, সাংবাদিক হামিদ মোহাম্মদ, বিসিএর সাবেক সভাপতি খন্দকার নুরুর রহমান পাশা, কবি ও ছড়াকার দিলু নাসেরসহ বিলেতের সাহিত্য-সংস্কৃতিজগতের বিশিষ্টজনেরা।
সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিবারের শোক
সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করে প্রয়াত অজয় পালের পরকালীন শান্তি কামনা করেছেন প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আহমদ। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, তাঁর মতো একজন গুণী সাংবাদিক ব্যক্তিত্বের সাথে প্রেস ক্লাবের কমিটিতে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তাঁর মৃত্যুতে আমরা একজন সত্যিকারের নিবেদিত সৃষ্টিশীল মানুষ, প্রতিভাবান সাংবাদিক ও সর্বোপরি এক গুণী ব্যক্তিত্বকে হারালাম। মোহাম্মদ বেলাল আহমদ অজয় পালের স্বজনদের প্রতি সমবেদনা গভীর জ্ঞাপন করেন।