পত্রিকা প্রতিবেদন ♦
লণ্ডন, ১৬ জানুয়ারি: যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্যতম বৃহত্তম সংগঠন গ্রেটার সিলেট কাউন্সিলের (জিএসসি) নির্বাচনকে ঘিরে রীতিমত তুঘলগি কাণ্ড চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংবিধান অনুযায়ী প্রতি দুই বছর পর পর নির্বাচন হওয়ার কথা।
সমালোচকরা বলছেন, সেই হিশেবে সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যারিস্টার আতাউর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০১৯ সালে। সংগঠনের যারা সদস্য তাদের সদস্যপদের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তাদের মতে, ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি এবং বৈধ সদস্যবিহীন একটি অকার্যকর সংগঠনে পরিণত হয়েছে এক সময়ের স্বনামধন্য এই সংগঠনটি।
সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ও সদস্য ফি জমার মধ্যে ব্যাপক গড়মিল
নিজেদের গড়া আর্বিট্রেশন কমিটির সুপারিশ অগ্রাহ্য
কমিটির দায়িত্বশীলরা আবারও প্রার্থী, তারাই নির্বাচন নিয়ন্ত্রক
সংবাদ সম্মেলনে আইনী পদক্ষেপের ঘোষণা প্রতিবাদীদের
রীতি অনুযায়ী, বিশেষ সাধারণ সভা ডেকে কমিটি এবং সদস্যদের মেয়াদ বৃদ্ধি করে বৈধতা নিশ্চিত করার সুযোগ ছিলো এবং এখনো আছে। কিন্তু অভিযোগ হচ্ছে, বর্তমান কমিটি এবং সদস্যদের সদস্যপদ নিয়মতান্ত্রিকভাবে নবায়ন না করে আগামী ২৯ জানুয়ারি নির্বাচন করতে যাচ্ছেন বর্তমান কমিটির দায়িত্বশীলরা। ফলে এটি হবে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক।
সংগঠনটির মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার আতাউর রহমান। সাধারণ সম্পাদক খসরু খান এবং ট্রেজারার হিসেবে আছেন সালেহ আহমদ। কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও যথাযথ সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অবলম্বন ছাড়াই দায়িত্বে থাকা এই শীর্ষ তিনজন আসন্ন নির্বাচনেও স্ব স্ব পদে প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরাই নির্বাচনের কমিশনার নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্বাচনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ। এমনকি প্রার্থী মনোনয়ন ফরমেও নির্বাচন সংক্রান্ত যোগাযোগের জন্য তাঁদের নম্বর দেয়া হয়েছে। প্রার্থী হয়ে নির্বাচন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের এই দৃষ্টান্ত কেবল বিরল এবং বেপরোয়াই নয়; এসব কর্মকাণ্ড যেকোনো বিচারের মানদণ্ডে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিপন্থী বলে মনে করছেন কমিউনিটির বিশিষ্টজনরা।
জানা গেছে, যুক্তরাজ্য জুড়ে জিএসসির ১২টি রিজিওনাল কমিটির মধ্যে এখন রয়েছে ১১টি। এসব রিজিওনাল কমিটির অধীনে আবার শাখা কমিটি রয়েছে। এক সময় এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ছিলো প্রায় ১৯ হাজার। তা থেকে কমে বর্তমানে রয়েছে প্রায় ৯ হাজার। রিজিওন থেকে নির্বাচিত ১০ শতাংশ ডেলিগেটের ভোটে নির্বাচিত হয় কেন্দ্রীয় কমিটি। জিএসসির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ও ট্রাস্টি ড. মুজিবর রহমান এবার সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন। তিনি সাপ্তাহিক পত্রিকাকে বলেন, দুই বছর পর পর নির্বাচন। এই হিসাবে ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর সংগঠনের সদস্য গ্রহণ ও নবায়ন শেষ হয়। এর পর থেকেই সদস্য গ্রহণ, ডেলিগেট নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে আসছে। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনও হয়নি।
সর্বশেষ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হবে বলে জানায় কমিটি। কিন্তু তা হয়নি। কয়েক দফা পিছিয়ে ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ চূড়ান্ত হয়। ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর মনোনয়ন জমাদানের তারিখ ঘোষণা করে কমিটি। তারা চারজন কমিশনার নিয়োগ দেয়। ১৮ ডিসেম্বর ছিলো মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। কিন্তু নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করেন। এরপর তা বাড়িয়ে আবার ২ জানুয়ারি করা হয়।
নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়ম ও অব্যবস্থার কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুর রকিব সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে অপারগতা জানিয়ে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করেন আরেক নির্বাচন কমিশনার জাকির খান।
এদিকে পদত্যাগ করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুর রকিবের স্থলে ব্যারিস্টার আবুল কালামকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ব্যারিস্টার আবুল কালামের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ নতুন বিতর্কের সূচনা করে। কারণ, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ব্যারিস্টার আতাউর রহমান এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যারিষ্টার আবুল কালামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা কমিউনিটিতে অজানা নয়। ফলে স্বাভাবিক কারণেই তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্বের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যারিস্টার আতাউর রহমানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা গেছে, নির্বাচন নিয়ে নানা তরফ থেকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ ডিসেম্বর নির্বাহী কমিটি এক জরুরি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অভিযোগগুলোর বিষয়ে সুপারিশ চেয়ে সংগঠনের দুই পেট্রন- ড. হাসানাত হোসাইন এমবিই এবং আবু তাহের চৌধুরীকে আর্বিট্রেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। দুই পেট্রন সদস্য সংগ্রহ, সদস্য ফির হিসাব নিয়ে আপত্তি এবং ডেলিগেট নির্বাচনসহ বিভিন্ন অভিযোগগুলো তদন্ত করে গত ৬ জানুয়ারি কমিটির ও অভিযোগকারীদের কাছে তাদের সুপারিশমালা পেশ করে। যেখানে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা এবং এর বিপরীতে সদস্য ফি জমার মধ্যে বড় ধরনের গড়মিল উঠে আসে। পাশাপাশি ডেলিগেট নির্বাচনসহ আরও কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের পর নতুন করে নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু কমিটি পেট্রনদের সুপারিশগুলো উপেক্ষা করেছে এবং কোনো অভিযোগের সমাধান ছাড়াই ২৯ জানুয়ারি নির্বাচন করার পক্ষে অনড় রয়েছে বলে জানা গেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও অভিযোগকারীরা ১৬ জানুয়ারি সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ ও ঘটনা প্রবাহের বিস্তারিত তুলে ধরে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্তের কথা জানান। আসন্ন নির্বাচনে ঘিরে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে সংগঠনের এই অংশের নেতৃবৃন্দ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন স্থগিত করে নতুন নির্বাচন দাবী করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন বিশিষ্ট কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ড. মুজিবুর রহমান। উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মসুদ আহমদ, হেলেন ইসলামসহ বেশ কয়েকজন নেতা।
তারা লিখিত বক্তব্যে বলেন, সংগঠনের বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতৃবৃন্দ ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, আর্থিক অনিয়ম, সংবিধান লঙ্ঘন করে স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা ঘোষিত আসন্ন নির্বাচন স্থগিত করে নতুন নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা ও নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠনের দাবী জানান।
লিখিত বক্তব্যে এসব অনিয়মের বর্ণনা দিয়ে তারা অভিযোগ করে বলেন, জিএসসি বাঙালি কমিউনিটির একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। এটিকে কয়েকজন কায়েমী স্বার্থবাদী ব্যক্তি তাদের ইচ্ছামাফিক পরিচালনা করছেন। সংবিধানের নিয়মনীতি বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে কার্যকরী কমিটির মেয়াদ ২ বছর হলেও ৫ বছরের অধিককাল তারা ক্ষমতায় রয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী কোন সাধারণ সভা গত তিন বছর যাবৎ করেননি। এছাড়া তাদের পছন্দমাফিক সদস্য নবায়ন করে নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পায়ঁতার করছেন। ভিন্ন মতামতের সদস্য পদ কেড়ে নিয়ে পছন্দের ব্যক্তিদের দ্বারা নির্বাচনের তহশিল ঘোষণা করেছেন। নানা অনিয়মের কারণে সংগঠন কর্তৃক নিয়োজিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মুহম্মদ আবদুর রাকীবসহ দুইজন ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। এরপরও তারা নির্বাচনের আয়োজন চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিষয়টি নিস্পত্তির জন্য?সংগঠনের দুইজন এনইসি কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্যাট্রন বিভিন্ন সাংগঠনিক ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখে সবকিছু ঠিকঠাক করে নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন ইতোমধ্যে কমিটিসহ সংশ্লিষ্টদের দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান দায়িত্বশীলরা তা অগ্রাহ্য করে চলেছেন। আমাদের দাবী সম্মানিত পেট্রন মহোদয়ের সুপারিশ ও নির্দেশনা মত সংগঠন পরিচালনা করলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু তা তারা করছেন না। লিখিত বক্তব্যে এবং উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা আইনি প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংগঠনের পেট্রন আবু তাহের চৌধুরী সাপ্তাহিক পত্রিকাকে বলেন, জিএসসি আমাদের কমিউনিটির একটি স্বনামধন্য বড় সংগঠন। আমাদের কাছে আব্রিটেশনের দায়িত্ব দেয়ার পর আমরা তদন্ত করে বেশকিছু সমস্যা চিহ্নিত করি। সেগুলো কমিটিকে জানিয়ে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করি। কিন্তু তারা সেটি মানছেন না।
উল্লেখ্য, এখন কমিটি পেট্রনদের সুপারিশগুলো শুধু উপেক্ষাই করেছে না বরং উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছে।