লণ্ডন, ০৭ আগস্ট: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী ডা: জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে গত ২ আগস্ট বাংলাদেশের আদালতে দেয়া রায়কে ‘ফরমায়েশি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেছে যুক্তরাজ্য বিএনপি। গত ৪ আগস্ট পূর্ব লণ্ডনে লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাব কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদ। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমান মুজিব, তৈমুছ আলী, সলিসিটর ইকরামুল হক মজুমদার, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পারভেজ মল্লিক, যুগ্ম সম্পাদক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ খান, গুলজার আহমেদ, মিসবাহুজ্জামান সোহেল, ডঃ মুজিবুর রহমান, সহ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বাসিত বাদশা, এডভোকেট খলিলুর রহমান, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক (সহসভাপতি পদমর্যাদা) ও যুক্তরাজ্য স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নাসির আহমেদ শাহিন, যুক্তরাজ্য বিএনপির সহ দপ্তর সম্পাদক সেলিম আহমেদ, সিনিয়র সদস্য ও ইস্ট লণ্ডন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম লিটন, যুক্তরাজ্য স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন, আইনজীবী ফোরামের সভাপতি ব্যারিস্টার আবুল মনসুর শাহজাহান, কেন্দ্রীয় যুবদলের সদস্য বাবর চৌধুরী, যুক্তরাজ্য বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক মইনুল ইসলাম, সহ তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক সোহেল আহমেদ সাদিক, লণ্ডন মহানগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ চৌধুরী প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিনাভোটে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে মাফিয়া চক্রের কবলে পড়ে রাষ্ট্রের সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কোনো রাষ্ট্র বিপথগামী হলে মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল হলো বিচারবিভাগ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখন খোদ বিচার বিভাগই পথ হারিয়ে ফেলেছে। বিচার বিভাগেই মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি অবিচারের শিকার। আর দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক এখন দুর্নীতিবাজদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। রামদা লীগ, হেলমেট লীগ আর চাপাতি লীগের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ’বিচার বিভাগ’ এবং ’দুদকে’ও জন্ম হয়েছে ’দুদক লীগ’ এবং ’বিচারক লীগ’। শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করে দুদকে’র কোন কোনো দুর্নীতিবাজ যেভাবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করছে, একইভাবে শেখ হাসিনার ইচ্ছেপূরণের রায় দিয়ে জুনিয়র বিচারকরাও হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট দখল করছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিচারক লীগের এক কর্মকর্তা আদালতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তাঁর সহধর্মিনী ড. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে ’জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের কল্পিত অভিযোগে তথাকথিত একটি মামলার রায় দিয়েছেন। এটি একটি বিচারিক আদালতের রায় বলে জনগণ বিশ্বাস করেনা। জনগণ মনে করে, ক্ষমতাসীনদের লিখে দেয়া একটি মনগড়া রায় আদালতকে ব্যবহার করে পড়িয়ে নেয়া হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, এর আগে ২০১৩ সালে একটি মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন বিচারপতি মোতাহের হোসেন। এ কারণে ফ্যাসিস্ট কায়দায় বিচারপতি মোতাহের হোসেনকে দেশ ছাড়া করা হয়। শেখ হাসিনার স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় ২০১৭ সালে একজন সিটিং চিফ জাস্টিসকেও একইভাবে দেশ ছাড়া করা হয়। ফজলে নূর তাপস নামক একজন আইনজীবী সম্প্রতি নিজেই হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, ’একজন চিফ জাস্টিসকে নামিয়ে দিয়েছিলাম’। আমাদের মনে রাখা দরকার, ’চিফ জাস্টিস একজন ব্যক্তি মাত্র নয় বরং একটি প্রতিষ্ঠান’। সুতরাং, তাপসের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেয়ার পরেও কোনো আদালতই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সাহস করেনি। এতে প্রমাণিত হয়েছে আদালত এখন মাফিয়া চক্রের কাছে জিম্মি। এই শাসনামলে যেখানে খোদ চিফ জাস্টিসেরই নিরাপত্তা নেই, সেখানে নিম্ন আদালতের একজন বিচারকের কাছে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা সঠিক বিচার পাবেন, এটি কেউ কল্পনাও করেনা। সুতরাং, আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তাঁর সহধর্মিনী ডক্টর জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে ক্যাঙ্গারু কোর্টের এই তথাকথিত রায় দেশের জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিচারকরা এখন শেখ হাসিনা চক্রের ভয়ে তটস্থ। ফলে, শেখ হাসিনার শাসনামলে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রায় দেয়াটাই অনেক বিচারক ’নিজেদের জন্য নিরাপদ এবং লাভজনক’ মনে করেন। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে একজন নিম্ন আদালত থেকে প্রমোশন পেয়ে উচ্চ আদালতের বিচারক হয়েছেন। ফলে এবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তাঁর সহধর্মিনী ড. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে তথাকথিত রায় দিয়ে আরো একজন বিচারক হয়তো প্রমোশন পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু গণতন্ত্রকামী জনগণের পক্ষ থেকে আমরা স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই, শেখ হাসিনার অবৈধ ক্ষমতার লালসা মেটাতে আদালতকে ব্যবহার করার দিন শেষ হয়ে আসছে। তখন বিচারক নামধারী আওয়ামী ক্যাডারদেরকেও একদিন আদালতের মুখোমুখি হতে হবে।
লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, দেশের জনগণ সাক্ষী, হাতুড়ি ও লগি-বৈঠা হাতে দিয়ে ছাত্রলীগ- যুবলীগ এবং পুলিশের ইউনিফর্ম পরিয়ে বিপ্লব-মেহেদী-হারুন চক্রকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা একইভাবে আইনকে বেআইনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে কতিপয় দলীয় ক্যাডারকে বিচারকের চেয়ারে বসিয়ে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং, অপ্রিয় হলেও সত্য এই যে, অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ করে বিরোধী দলের ক্ষেত্রে বর্তমানে বিচার বিভাগের আচরণ ছাত্রলীগ-যুবলীগ কিংবা র্যাব-পুলিশের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের চেয়েও নিম্নমানের। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তাঁর সহধর্মিনী ড. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ মামলার রায়ে প্রমাণিত হয়েছে বিচার বিভাগ স্বাধীন হতে পারেনি। সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ৪০ লাখেরও বেশি মামলা বিচারাধীন। যুগ পেরিয়ে গেলেও এইসব মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছেনা। অথচ শেখ হাসিনার অবৈধ ক্ষমতার লালসা মেটাতে কিছু কিছু বিচারক বেছে বেছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিচারের নামে অবিচার করেই চলছেন। অপরদিকে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা দখল করার সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি চাদাঁবাজিসহ কমপক্ষে ১৫টি মামলা ছিল। আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের এবং শেখ সেলিম আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে শেখ হাসিনা এবং জয়ের দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি সম্পর্কে জবানবন্দিও দিয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ হওয়া সেইসব জবানবন্দি জনগণ এখনো ভুলেনি। অথচ ক্ষমতা দখলের পরপরই কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকে বিচারক বানিয়ে তাদেরকে দিয়ে শেখ হাসিনা মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই নিজের নামে থাকা ১৫টি মামলা খালাস করিয়ে নিয়ে নেন। ১২ কোটি ভোটারের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের জন্য হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারাদেশ। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজধানী ঢাকায় সমবেত হয়ে স্লোগান তুলেছে ‘দফা এক, দাবি এক- শেখ হাসিনার পদত্যাগ’। চলমান গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার ভীত হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্র-মানবাধিকার-ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারেক রহমান। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে শেখ হাসিনা জনগণের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে ছাত্র লীগ-যুবলীগ এবং র্যাব-পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত কতিপয় সন্ত্রাসী এবং দুদকের পাশাপাশি বিচার বিভাগকেও ব্যবহার করছে। সেই কারণেই আদালতকে ব্যবহার করে এ ধরণের উদ্ভট রায় দেয়া হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ বলেন, একইসঙ্গে আমরা মনে করি, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্ববাবধানে শেখ হাসিনার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা এখন সময়ের দাবি। জনগণ বিচার বিভাগকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সঙ্গে দেখতে চায়। কিন্তু বিরোধী দলের সঙ্গে বিচার বিভাগ যেভাবে শেখ হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনী কিংবা র্যাব-পুলিশের মতো আচরণ করছে সেটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। বিচারপতিদেরকে জনগণ সম্মানের চোখে দেখে, বিশ্ব সভ্যতায় এটাই নিয়ম। বিএনপিও সব সময় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সম্মান রক্ষায় সচেষ্ট। কিন্তু শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করার নীতি গ্রহণ এবং কতিপয় বিচারকের লাভ-লোভের কারণে বর্তমানে দেশের বিচারবিভাগ দেশ-বিদেশে সম্মান ও মর্যাদা হারিয়েছে। ’বাংলাদেশে কেউ সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে তিনি ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন’ সম্প্রতি এমন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। লজ্জার বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের এমন ভিসানীতির আওতায় বাংলাদেশের বিচারপতিগণও রয়েছেন। এর অর্থ, ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন অথবা ভবিষ্যতে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনার তালিকায় বাংলাদেশের বিচারপতিদের নামও রয়েছে, এই বিষয়টিতে বিচারপতিদের জন্য লজ্জার কারণ হয়েছে কিনা তারাই ভালো জানেন, তবে জনগণ এতে লজ্জিত। খোদ বিচারালয়ের প্রতি আস্থার সংকট এখন শুধু বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যেও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শেখ হাসিনার অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য জেনেও যেসব বিচারকরা বিচারের নামে অবিচার করে চলছেন, আমরা সেইসব বিচারপতিদেরকে তাদের বিবেকের মুখোমুখি হওয়ার আহবান জানাই। বিএনপির রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস জনগণ। দেশের জনগণ শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করে না। শেখ হাসিনাও জনগণকে বিশ্বাস করেন না। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন জনগণ শেখ হাসিনার কবল থেকে বিচারালয়কে উদ্ধার করে দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করবে। দেশে পুনরায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, হাসিনা সরকারের কাছে ন্যায়বিচার আশা করে লাভ নেই। সুতরাং, দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করতে এখন গণতন্ত্রকামী জনগণের স্লোগান হচ্ছে ‘হটাও মাফিয়া বাঁচাও দেশ, টেইক ব্যাক বাংলাদেশ’।