পত্রিকা প্রতিবেদন ♦
লণ্ডন, ০৭ আগস্ট: ‘সাউথ এশিয়ান হেরিটেজ মান্থ’ বা দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্য উদযাপন মাস পালনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। ০৭ আগস্ট সোমবার টাওয়ার হ্যামলেটস ’সাউথ এশিয়ান হেরিটেজ মান্থ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এই আহবান জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে দক্ষিণ এশিয়ান জনগোষ্ঠীর বসতি হিসেবে টাওয়ার হ্যামলেটস অন্যতম, যার মধ্যে বেশির ভাগই বাঙালি (বাংলাদেশি এবং ভারতীয় বাঙালি)। পূর্ব লণ্ডনে বাঙালি বসতির একটি বৈশিষ্টপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে, যা প্রায় ৪শ বছর বিস্তৃত- ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক বিচরণের সময় পর্যন্ত। সুবিধা বিবেচনায় কোম্পানির সদর দপ্তর ছিলো ওল্ডগেইটের কাছাকাছি এবং এই পূর্ব লণ্ডনের বন্দর (ডক) ও গুদামগুলো কোম্পানির ব্যবসার মূল কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কোম্পানির বাণিজ্যের যতই উন্নতি হয়েছে ততই এই পূর্ব লণ্ডনে বেড়েছে বাঙালিদের আগমন। একেবারে শুরুর দিককার নিবন্ধিত আগমনকারীদের একজন ছিলেন ইতিসাম-উদ-দ্বীন। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি মুসলমান। তিনি ১৭৬৬ সালে ব্রিটেনের মাটিতে পা রাখেন, পরবর্তীতে ১৭৮৫ সালে “শিঘার্প নামা আই ভিলায়াত” (দ্য ওয়াণ্ডার্স অব ইউরোপ) শীর্ষক এক রচনার মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতা নথিবদ্ধ করেন। তাঁর ওই আগমন এমন এক প্রবণতা শুরু করে যা এখনও চলছে। বাংলা কিংবা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে আসা লোকদের কাছে এখনও পূর্ব লণ্ডনের প্রাণবন্ত বাজারগুলো প্রাথমিক গন্তব্য। পার হওয়া শতাব্দীগুলোতে প্রতিটি প্রজন্ম পূর্ব লণ্ডনের সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যে অবদান রাখার মাধ্যমে নিজেদের বৈচিত্র এবং ঐতিহ্যের সংযোগকে উজ্জীবিত রেখেছে।
‘সাউথ এশিয়ান হেরিটেজ মান্থ’ বা দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্য উদযাপন মাস- এর লক্ষ্য হলো দক্ষিণ এশিয়ার জনগোষ্ঠীগুলোর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং উদযাপন করার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একটি অর্থপূর্ণ সংযোগ স্থাপন করা। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ব্যক্তিগত গল্পগুলো তুলে ধরতে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা অপরিহার্য, যাতে তারা নিজেদের অতীতকে তুলে ধরতে পারেন এবং সেই অতীত কীভাবে তাদের বর্তমানকে প্রভাবিত করে চলেছে সেদিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়ান হওয়ার প্রকৃত অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন।
মাসব্যাপী এই উদযাপনের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট। এই সময়টি ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ১৯৪৭ সালের এই সময়ে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন এবং ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ প্রকাশিত হয়েছিলো। এই ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ এর ভিত্তিতে ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) মধ্যকার সীমানা নির্ধারিত হয়েছিলো। চলতি বছর ‘সাউথ এশিয়ান হেরিটেজ মান্থ’ উদযাপনের অংশ হিসেবে দুটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন ক্যাম্পেইনাররা। ‘সিলেট ১৯৪৭’ শীর্ষক একটি আয়োজন হবে ১২ আগস্ট রোববার। এদিন হোয়াইটচ্যাপেলের হাসন রাজা সেন্টারে দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ আয়োজন চলবে। ‘স্ট্রিট মার্কেটস কনফারেন্স’ শীর্ষক দ্বিতীয় আয়োজনটিও একই সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২১ আগস্ট। দিনব্যাপী এই আয়োজন চলবে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত।
ক্যাম্পেইনার ও লেবার দলীয় সাবেক কাউন্সিলার পুরু মিয়া বলেন, “অন্যান্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ‘সাউথ এশিয়ান হিস্টোরি মান্থ’ কে গ্রহণ করেছে এবং এর কার্যক্রমে অর্থায়ন করছে- যেমন নিউহ্যাম কাউন্সিল। টাওয়ার হ্যামলেটস এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যে ঐতিহাসিক সংযোগ- বিশেষ করে বাংলার সঙ্গে- সেই বিবেচনায় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং অর্থায়নের সময় এসেছে।” গ্রেটার লণ্ডন অথোরিটির সাবেক সদস্য মুরাদ কুরেশি বলেন, “১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশের বিভাজনের ইতিহাস শুধুমাত্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নয়; এটি সিলেটের বংশোদ্ভূতদের জন্যও বিশেষভাবে সংকটপূর্ণ। কারণ স্বাধীনতার আগে সিলেটে গণভোট ওই অঞ্চলের মানুষদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলো এবং এর ফলে আজকের যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বব্যাপী ওই অঞ্চলের মানুষের অভিবাসন ঘটে। যেহেতু আমাদের ‘সাউথ এশিয়ান হেরিটেজ মান্থ’ রয়েছে তাই যুক্তরাজ্যের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার সিলেটি বংশোদ্ভূত হিসেবে আমাদের উচিত অন্তত বিষয়গুলো স্মরণ রাখা এবং প্রতিবছর উদযাপন করা।
পূর্ব লণ্ডনে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা ক্যাম্পেইনার সাইফ ওসমানী বলেন, “ব্রিটেনের বাজারগুলো জাগিয়ে রাখতে বাংলাদেশিদের অবদান অনেক; কিন্তু জন-নীতিগুলো প্রায়ই তাদের টিকে থাকার বিরুদ্ধে কাজ করে- যেমন টাওয়ার হ্যামলেটসের ক্রিস্পস স্ট্রীট মার্কেট এবং নিউহামের কুইন্স মার্কেট। বেঁচে থাকার ব্যয় সংকটের এই সময়ে আমরা বৈচিত্রপূর্ণ এই খুচরা বাজারগুলোর সুরক্ষা দেখতে চাই। লণ্ডন একটি বৈশ্বিক নগরী- তাজা, সহনীয় দাম ও সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত খাবার এবং পোশাক আমাদের এখানকার কমিউনিটির প্রধান খুঁটি। এবার আমরা ইস্ট লণ্ডনে ‘স্ট্রীট মার্কেট কনফারেন্স’ আয়োজনের মাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তুলে ধরবো।”