পত্রিকা ডেস্ক ♦ লণ্ডন, ১০ অক্টোবর: ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক দাতব্য সংগঠন অক্সফাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকে বহুমুখী সেবা প্রদান করে আসছে। দীর্ঘ ৫০ বছর যাবত সংগঠনটির বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকার এই অনন্য অবদানকে বিশেষ আয়োজনে উদযাপন করলেন যুক্তরাজ্যের প্রবাসীরা। গত বুধবার (৫ অক্টোবর) পূর্ব লণ্ডনের ইম্প্রেশন ব্যাঙ্কুয়েটিং হলে অক্সফামের কাজের নানা চিত্র প্রদর্শনী, চ্যারিটি ডিনার ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্যদিয়ে উদযাপিত হয় বাংলাদেশে অক্সফামের ৫০ বছর। একই সঙ্গে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার ৮০ বছর পাড়ি দেয়ার মাইলফলকও উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশি ব্রিটিশ ফ্রেণ্ডস অফ অক্সফাম’ এ উদযাপনের আয়োজন করে।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক দাতব্য সংগঠন অক্সফাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকে বহুমুখী সেবা প্রদান করে আসছে। দীর্ঘ ৫০ বছর যাবত সংগঠনটির বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকার এই অনন্য অবদানকে বিশেষ আয়োজনে উদযাপন করলেন যুক্তরাজ্যের প্রবাসীরা।
গত বুধবার (৫ অক্টোবর) পূর্ব লন্ডনের ইম্প্রেশন ব্যাঙ্কুয়েটিং হলে অক্সফামের কাজের নানা চিত্র প্রদর্শনী, চ্যারিটি ডিনার ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্যদিয়ে উদযাপিত হয় বাংলাদেশে অক্সফামের ৫০ বছর। একই সঙ্গে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার ৮০ বছর পাড়ি দেয়ার মাইলফলকও উদযাপন করা হয়। ‘বাংলাদেশি ব্রিটিশ ফ্রেন্ডস অফ অক্সফাম’ এ উদযাপনের আয়োজন করে। এ আয়োজনে বাংলাদেশি কমিউনিটির গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পাশাপাশি অক্সফামের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ ছিলো লক্ষ্যণীয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম। অতিথি ছিলেন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির চেয়ারম্যান এনেলিজ ডডস, মুক্তিযুদ্ধকালীন অক্সফামের শরণার্থী ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমের সমন্বয়ক জুলিয়ান এইচ ফ্রান্সিস ওবিই, ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, বাংলাদেশের মাদার তেরেসা খ্যাত ভ্যালারি টেইলর, কিংবদন্তী ক্রিকেটার স্যার গর্ডন গ্রিনিজ, ব্রিটিশ এমপি স্টিফেন টিমস ও লিজ ব্রাউন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা জুলিয়ান এইচ ফ্রান্সিস ওবিই মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থী সংকট ও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অক্সফামের নানা কার্ক্রমের কথা তুলে ধরেন। যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশের মানুষের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কি ধরণের সহায়তা প্রয়োজন। জবাবে তিনি পাল্টা জানতে চান ওই সময়ে কি করে আমি ঢাকা যেতে সক্ষম হলাম। বলেছিলাম- ভারত সীমান্ত থেকে সড়কযোগে এসেছি। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনি তো আমার চাইতে বেশি দেখেছেন আমার দেশের মানুষের অবস্থা। আপনি আমার চাইতে ভালো জানেন তাদের কি প্রয়োজন।’ জুলিয়ান বলেন, ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ওই সাক্ষাতের কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে ঢাকায় ফিরেছিলেন। ভ্যালেরি টেইলর বাংলাদেশের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার অসীম ক্ষমতার প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, দারিদ্রসহ নানা প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। অক্সফামের কর্মকর্তা এন্ডি বাস্টেবল ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশে যাতায়ত করেন জানিয়ে বলেন- তিনি দেখেছেন, বাংলাদেশের মানুষ কতটা সহজে নানা কঠিন সমস্যার সমাধান বের করে নিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি আর্সেনিক মোকাবেলা ও স্বাস্থ্যকর টয়লেট নির্মাণের কথা তুলে ধরেন। লেবার দলের চেয়ারপার্সন এনেলিজ ডডস্ ব্যতিক্রমী এই আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, অক্সফামের মত সংগঠনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মানবসেবায় যুক্তরাজ্যের অগ্রণী ভূমিকা আরো বেগবান করতে আগ্রহী তাঁর দল। অক্সফামের পেট্রন মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, মানুষকে সাবলম্বী করা, জীবন রক্ষা এবং দুর্যোগ-দুর্বিপাকসহ নানা সংকটকালে নানা উদ্ভাবনী উপায়ে সাহায্য নিয়ে পাশে দাঁড়ায় অক্সফাম। যার সরাসরি উপকারভোগী আমরা বাংলাদেশিরা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে অক্সফাম বাংলাদেশে চমৎকার সব কাজ করে চললেও তারা নিজেরা এসব নিয়ে খুব একটা প্রচার করে না। কিন্তু উপকারভোগী হিসেবে আমাদের উচিত তাদের ধন্যবাদ জানানো।
সাংবাদিক উদয় শঙ্কর দাশ ১৯৭১ সালে অক্সফামের শরণার্থী ত্রাণ কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করে বলেন, আমাদের মাতৃভূমির মানুষের জীবন-মান রক্ষা ও উন্নয়নে সংস্থাটির ভূমিকা সুদূরপ্রসারী এবং প্রশংসাযোগ্য। আমরা যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছি; তখন এই স্বাধীন বাংলাদেশে অক্সফামের মত আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থার চমৎকার মানবিক কাজগুলোর দিকে ফিরে তাকানো এবং এর সাফল্য উদযাপনও জরুরি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শরণার্থী অধ্যায়টিকে আরও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেন তিনি। প্রধান অতিথি সাইদা মুনা তাসনীম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে দীর্ঘ ৫০ বছর যাবত অক্সফামের সেবার জন্য ধন্যবাদ জানান। ভবিষ্যতেও অক্সফাম এমন সেবা অব্যাহত রাখবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
জাকির খান ও মনজিল কোরেশির য্যেথ সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাহের আহমদ। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এমপি স্টিফেন টিমস ও লিজ ব্রাউন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন কের করে বক্তব্য রাখেন রাজিয়া লতিফ। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে অক্সফামের দাতব্য কাজের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হয়। কিংবদন্তী ক্রিকেটার ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক কোচ স্যার গর্ডন গ্রিনিজ তাঁর এবং ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি বিজয়ী বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি ক্রিকেট ব্যাট নিলামের জন্য দান করেন। এ আয়োজনের মূল সমন্বয়ক ছিলেন উদয় শঙ্কর দাশ, মাহির আহমদ, মমতাজ খান ও রাজিয়া লতিফ। উপস্থিত অতিথিরা অক্সফামের চমৎকার কাজগুলোর উদযাপনের সুযোগ করে দেয়ায় আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান।
প্রসঙ্গত, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে বাংলার মানুষের পাশে রয়েছে অক্সফাম। ১৯৭০ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের শিকার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে অক্সফামের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ লোকের খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসা সামগ্রী প্রদানে অক্সফাম অভাবনীয় ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতার পর শরণার্থীদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সদ্যস্বাধীন দেশের দারিদ্র বিমোচনেও অক্সফামের ভূমিকা অনন্য।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরুর পর (অপারেশন সার্র্চলাইট নামে পরিচিত) অক্সফামের তৎকালীন সহকারী ফিল্ড ডিরেক্টর অ্যালান লেদার ছিলেন বিদেশী এনজিও কর্মীদের মধ্যে অন্যতম, যিনি এপ্রিলের শেষের দিকে/মে মাসের শুরুতে সীমান্ত এলাকায় হাজার হাজার বাংলাদেশি শরণার্থীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তখন ভারত প্রান্তে গান্ধীবাদী আশ্রমের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক শরণার্থীদের সেবায় কাজ শুরুর জন্য কলকাতায় অ্যালানের সাথে যোগ দেন। জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। অক্সফামের পূর্ব ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের নবনিযুক্ত ফিল্ড ডিরেক্টর রেমন্ড কোরনোয়ার শরণার্থী সেবার কাজটি দেখভাল করেন। অক্সফামের নানা সেবামূলক কাজের সবচেয়ে চোখে পড়ার মত বিষয় ছিলো ৭২ ঘন্টার মধ্যেই কলেরা ভ্যাকসিনের এক মিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করা। জেট ইনজেক্টর সম্বলিত এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য কোনো সূঁচের প্রয়োজন ছিলো না। অক্সফামের অর্থায়নে উত্তরপ্রদেশের কারখানার চিনাবাদাম থেকে তৈরি উচ্চ প্রোটিন খাদ্য পাউডার সংযোজন। অক্সফাম ১০টি স্কোয়াটিং প্লেটসহ ক্যাম্পে ব্যবহারের জন্য পরীক্ষামূলক বিউটাইল রাবার ল্যাট্রিন ইউনিট সরবরাহ করে। এর দুর্দান্ত সাফল্য দেখে স্বাধীন বাংলাদেশেও এগুলো সরবরাহ করা হয়। গরম কাপড় ও কম্বলের জন্য বড় আকারের ক্যাম্পেইন পরিচালনা। যার মধ্যে ছিলো যুক্তরাজ্যে বিশাল প্রচারাভিযান- “আপনার বিছানা থেকে একটি কম্বল নিন এবং অক্সফামকে দিন”। অক্সফামের কাছে কম্বল পৌঁছে দেয়ার জন্য পোস্ট অফিস কোনো খরচ নেয়নি।
উল্লেখ্য, ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি অক্সফামের অন্যতম বড় কাজ ছিল ‘দ্য টেস্টিমনি অফ সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল’ (বাংলার সংকট নিয়ে ষাট জনের সাক্ষ্য) শীর্ষক প্রকাশনা। এতে মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, অ্যান্টনি মাসকারেনহাস, জন পিলজার, নিকোলাস টমালিন, ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ ও মার্টিন উলাকটের মতো বিখ্যাত সাংবাদিকদের নিজ চোখে দেখা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার মানুষের পরিস্থিতির কথা স্থান পেয়েছিলো। বাংলার ক্রমবর্ধমান ট্র্যাজেডির প্রতি বিশ্ব নেতাদের চোখ খুলতে এবং জাগিয়ে তুলতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো।
১৯৭১ সালের অক্টোবরে এটি প্রকাশিত হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ‘দ্য টেস্টিমনি অফ সিক্সটি’ মার্কিন সিনেটের নজরে আনেন। এরপর এটি ২৮ অক্টোবর মার্কিন কংগ্রেসনাল রেকর্ডে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়।