রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস সংক্ষেপে আরএসভি দ্বারা সৃষ্ট ফুসফুসের গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে প্রতি বছর আমাদের হাজার হাজার বয়স্ক মানুষ এবং শিশু হাসপাতালে ভর্তি হন। এক্ষেত্রে আপনার কী জানা দরকার সে বিষয়ে জিপি ডাঃ মোহিত মন্দিরাদত্তা এবং ডা. ওজি ইলোজু ব্যাখ্যা করছেন।

রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাসে আক্রান্ত অনেকের বেলায় এক্ষেত্রে সর্দি-জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে যা তাদের সুস্থ হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত দুই থেকে তিন সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে।
তবে এটি নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ব্রঙ্কিওলাইটিসের মতো গুরুতর ফুসফুসের সংক্রমণও ঘটাতে পারে।
ওয়েস্ট মিডল্যাণ্ডসে কর্মরত জিপি ডাঃ মোহিত মন্দিরাদত্তা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “আরএসভি আক্রান্ত হলে তা কেবল সর্দি-জ্বরের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু এটি জীবন-হুমকি সৃষ্টির মতো রোগে পরিণত হতে পারে।”
তিনি আরো বলেন, “প্রতি বছর যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩০,০০০ শিশু এবং প্রায় ৯,০০০ বয়স্ক ব্যক্তি এই সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। দুঃখজনক হলো যে, এদের কেউ কেউ মারাও যায়।
ডাঃ মোহিত জানান, “তবে সৌভাগ্যক্রমে এটি থেকে সুরক্ষার জন্য বিনামূল্যে এনএইচএসের একটি টিকা আছে। এটি ৭৫ থেকে ৭৯ বছর বয়সী ব্যক্তিদের বিনামূল্যে দেয়া হয় যেহেতু তারা অধিক ঝুঁকিতে থাকেন। এছাড়া গর্ভবতী নারীরাও এটি পাবেন। কারণ তারা টিকা নিলে তাদের শিশুদেরও এটি সুরক্ষা দিয়ে থাকে।”
বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য আরএসভি কেন একটি বড় সমস্যা?
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই আমাদের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি হয়ে থাকে। আমরা বেশি সহজেই এটিতে আক্রান্ত হতে পারি এবং এক্ষেত্রে গুরুতর উপসর্গ সৃষ্টির আশঙ্কাও বেশি।

এছাড়া আমাদের অন্যান্য শারিরীক অসুস্থতা থাকার সম্ভাবনাও বেশি থাকে যেমন- ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিসঅর্ডার (সিওপিডি) যা ফুসফুসের তীব্র প্রদাহজনক রোগ, বা কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ (হৃদরোগ), কিডনি ডিজিজ (কিডনি রোগ) কিংবা টাইপ-২ ডায়াবেটিস ইত্যাদি। এসব শারিরীক অবস্থাও নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
লণ্ডনে কর্মরত ডাঃ ইলোজু বলেন, “কেয়ার হোমে কিংবা যেখানে বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষ একসাথে বসবাস করে সেখানে ভাইরাস সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং আপনি সুস্থ এবং সমর্থ বোধ করলেও আপনার ঝুঁকিতে থাকার বহু কারণ রয়েছে।”
শিশুদের আরএসভিতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি নিয়ে আমাদের এতো দুশ্চিন্তা কেনো?
আরএসভি-এর আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শিশুদের থাকে না। আর শিশুদের ফুসফুস এত ছোট থাকে যে তারা সহজেই রোগে কাবু হয়ে যেতে পারে।

শিশুদের ব্রঙ্কিওলাইটিস রোগে আক্রান্ত হবার প্রধান কারণ হচ্ছে আরএসভি সংক্রমণ। বিশেষ করে এক বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ বিপজ্জনক। কারণ ব্রঙ্কিওলাইটিস তাদের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস এবং খাওয়া কঠিন করে তুলে। শিশুকালে গুরুতর সংক্রমণ পরবর্তী জীবনে তাদেরকে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে এবং যা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
ডা. ইলোজু বলেন, “আরএসভি আক্রান্ত হলে বেশিরভাগ শিশুর বেলায় সর্দি-জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দেয় যা কয়েকদিনে সেরে যায়। কিন্তু এক বছরের কম বয়সী শিশু আরএসভি আক্রান্ত হলে এটি তাদের গুরুতর অসুস্থ হবার ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।”
“কাশি বেড়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, নিঃশ্বাসে শব্দ হওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হওয়া কিংবা এর মাঝখানে দীর্ঘ বিরতি- এসবই আরএসভিতে আক্রান্ত হবার সতর্কবার্তা। শিশুদের বেলায় তাদের খাওয়ানোতে সমস্যা হতে পারে, তাদের প্রচুর লালা ঝরতে পারে অথবা প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তারা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে এবং তাদের উচ্চ মাত্রার জ্বর হতে পারে। কিন্তু স্পর্শ করলে তাদের শরীর ঠাণ্ডা অথবা ঘাম অনুভূত হবে।”
“এক্ষেত্রে জিপি প্র্যাকটিসের সাথে বা ১১১ নম্বরে এনএইচএসে ফোন করে বাবা-মায়ের জরুরীভিত্তিতে চিকিৎসা পরামর্শ নেয়া দরকার। যদি আপনার শিশুর শ্বাসকষ্ট প্রকট হয়, সে যদি কাহিল হয়ে পড়ে, তাকে ঘুম থেকে জাগানো না যায় অথবা সে না ঘুমিয়ে থাকে এবং চামড়া নীল বা ধূসর হয়ে যাচ্ছে এমন হয় তাহলে ৯৯৯-এ ফোন দিন।”
তাহলে গর্ভবতী নারীদের টিকা কেন দেয়া হয়?
গর্ভবতী নারীদের কিছু টিকা অফার করা হয়। কারণ এর ফলে তাদের দেহে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হয় তার ভাগ তাদের শিশুরা পেয়ে থাকে যা জন্মের পর শিশুকে সুরক্ষা দিতে সহায়ক হয়।

ডাঃ মোহিত মন্দিরাদত্তা বলেন, “শিশুর জীবনের প্রথম ছয় মাস তাদের ফুসফুসে গুরুতর আরএসভি সংক্রমণের ঝুঁকি এই টিকা প্রায় ৭০% কমিয়ে দেয়। এটি আসলে আপনার শিশুর জন্য সবচেয়ে ভালো সুরক্ষা।”
“যদি আপনার গর্ভাবস্থা ২৮ সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশী হয়ে থাকে এবং আপনাকে টিকার জন্য বলা না হয়ে থাকে, তাহলে দয়া করে আপনার প্রসূতি পরিষেবা (মেটারনিটি সার্ভিস) বা জিপি প্র্যাকটিসের সাথে কথা বলুন।”
আমি কেন কখনও আরএসভি সম্পর্কে শুনিনি?
প্রায় সকলেরই অন্তত একবার হলেও আরএসভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। আসলে, প্রায় ৯০% শিশু দুই বছর বয়সের মধ্যে এটিতে আক্রান্ত হয়।
ডাঃ মন্দিরাদত্তা বলেন, “আরএসভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষ এটিকে কেবল স্বাভাবিক সর্দি-জ্বর মনে করে, যদিও এটি তাদের বেশ অসুস্থ করে ফেলতে পারে। কিন্তু পরীক্ষা করা না হলে এটি কী তা হয়তো তারা কখনোই জানতে পারবেন না। আর হাসপাতালের বাইরে সাধারণত এই পরীক্ষা করা হয় না।
“টিকা দিলেই আপনি যে এটিতে আক্রান্ত হবেন না সেটি নিশ্চিত করা যাবে না। তবে গুরুতর উপসর্গ কমানোর সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে টিকা নেওয়া এবং এটি আপনার জীবন বাঁচাতে পারে।”
আপনি কীভাবে এটিতে আক্রান্ত হন?
ফ্লু কিংবা কোভিড-১৯ ভাইরাসের মতোই আরএসভি ভাইরাস কাশি বা হাঁচির মাধ্যমে ছড়ায় যা কেউ শ্বাস গ্রহণের সময় সংক্রমিত হতে পারেন। এছাড়া মুখ থেকে নির্গত তরল ফোঁটা (ড্রপলেট) যা বিভিন্ন জিনিষপত্রের পৃষ্ঠের উপর পড়ে । সেটি হাত দিয়ে স্পর্শ করলেও এই ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন।

ডাঃ মান্দিরাত্তা বলেন, “একবার ব্যবহারযোগ্য (ডিসপজেবল) টিস্যু ব্যবহার করে এবং হাত ও জিনিষপত্রের পৃষ্ঠ পরিষ্কার রাখার মাধ্যমে শ্বসনতন্ত্রের এই ভাইরাসের বিস্তার পরিহার করতে আমরা সবাই আমাদের করনীয়টুকু করতে পারি।”
ডাঃ ইলোজু আরো বলেন, “আরএসভিসহ ফ্লু কিংবা কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া এবং তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়টি এতো সহজেই ঘটে থাকে যে আপনি অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তা বুঝতেই পারবেন না। তাই এক্ষেত্রে গুরুতর উপসর্গ থেকে সর্বোত্তম সুরক্ষা হলো টিকা নেওয়া ।”
আমি কখন টিকা নিতে পারবো?
আরএসভি টিকা পেতে পারেন:
• গর্ভবতী নারীরা, গর্ভধারণের ২৮ সপ্তাহ থেকে।
• ৭৫ থেকে ৭৯ বছর বয়সী ব্যক্তিরা
• ২০২৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বরের পর থেকে ২০২৫ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত যাদের ৮০ বছর পূর্ণ হবে

আরএসভি টিকা সারা বছর ধরে পাওয়া যায় এবং এ পর্যন্ত ১.৫ মিলিয়ন ব্যক্তিকে এই টিকা দেওয়া হয়েছে।
নবজাতক শিশুকে সুরক্ষা দিতে প্রতিটি গর্ভাবস্থায় নারীদের জন্য টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে আপনার প্রসবপূর্ব পরিষেবা (এন্টিনেটাল সার্ভিস) বা জিপি প্র্যাকটিসের সাথে কথা বলুন।
বয়স্কদের জন্য একটি ডোজ দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা প্রদান করে। আপনার বয়স ৭৫ থেকে ৭৯ বছরের মধ্যে থাকলে যদি এই টিকা আপনি এখনো না নিয়ে থাকেন তাহলে অনুগ্রহ করে আপনার জিপি প্র্যাকটিসের সাথে যোগাযোগ করুন।
আরএসভি সম্পর্কে আরও তথ্যের জন্য এনএইচএস www.nhs.uk/rsv ওয়েবসাইট পড়ে দেখুন।
• আপনার ফ্লু’র টিকা নিতে ভুলবেন না। আপনি এর উপযুক্ত হলে আপনার জিপি প্র্যাকটিসের সাথে যোগাযোগ করুন অথবা ফার্মেসিতে যান যারা ৩১ মার্চ পর্যন্ত টিকা অফার করছে।